প্রথমবার হংকং!

জীবনে প্রথমবার হংকং যাব।
 
ছোট একটা অর্ডার পেয়েছি, অনলাইনে কন্ট্রা্কট করলাম হংকং এর একটি কোম্পানীর সাথে। ভেরী রেয়ার আইটেম; ক্লাইন্টকে বললাম ১০০% পেমেন্ট এডভান্স করতে হবে নইলে সাপ্লাই করতে পারবো না। মালটা হংকং থেকে আনতে হবে, সেভেন বিজনেস ডে লাগবে ডেলিভারী করতে।
 
ক্লাইন্ট হিসাব নিয়ে বলল, ‘আমি যদি আপনাকে রিটার্ণ টিকেট ও হোটেল খরচ দিই, আমাকে ৩ দিনের মধ্যে ডেলিভারী দিতে পারবেন কিনা?’
আমি হংকং এর প্রিন্সিপালের সাথে যোগাযোগ করে কনফার্ম করলাম, আমার প্রিন্সিপাল মালটা তাইওয়ান থেকে আর্জেন্ট আনিয়ে রাখলো আমার জন্য।
 
এর আগে আমি শুধু দুই বার কোলকাতা, আর একবার দিল্লী গেছি; কাজেই অভিজ্ঞতা কম। আমার এক বন্ধু মিঠু ভাই মাস খানেক আগে হংকং হয়ে তাইওয়ান ঘুরে আসছে- তাকে জিজ্ঞেস করলাম হংকং সম্পর্কে; সে আমাকে মোটামুটি তথ্য দিল। তবে শেষ টায় বলল ‘সবই তো পারবে কিনতু সমস্যা হলো- ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে তোমাকে যেতে দিলেই হয়। ওরা তো ঘুষ ছাড়া তোমাকে বিমানেই উঠতে দেবে না।’
 
মিঠু ভায়ের কথাটাকে আমি কাউন্ট করলাম এবং ঢাকা এয়ারপোর্টকে মোকাবেলার মানসিক প্রসতুতি নিলাম।
 
ড্রাগন এয়ারের টিকেট কাটলাম, ইনভাইটেশন লেটার আনালাম, টিকেট ও পাসপোর্টে প্রয়োজনীয় ডলার ইনডোর্সমেন্ট করে নিলাম।
 
রাত ১.৫০ এ ফ্লাইট। আমি সাড়ে বারটায় এয়ারপোর্টে পৌছলাম। ড্রাগন এয়ারলাইন্স এর কাউন্টার থেকে লাগেজ বুকিং দিয়ে বোর্ডিং পাশ নিলাম। ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করে লাইনে দাঁড়িয়ে যথাসময়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে এক্সিট নেবার জন্য আমার পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাশ ও রিটার্ণ টিকেট জমা দিলাম।
 
ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাবেন?’
আমি উত্তরে বললাম, ‘আপনাকে হংকং এর রিটার্ণ টিকেট ও বোডিং পাশটা দিয়েছি; আমি হংকং যাবো।’
আমার দিকে খুব বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘হংকং যে যাবেন, আপনার হংকং এর ভিসা কোথায়?’
‘বাংলাদেশীদের হংকং যেতে কোন ভিসা লাগে না। হংকং এয়াপোর্ট থেকে ফর্টিন ডেইজ এর অন এরাইভ্যাল ট্রাভেল পার্মিশন দেয়া হয়।’
 
পুলিশ অফিসারটি আমার পাসপোর্টটি তার পাশের আরেক অফিসারের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘দেখেন- হংকং যাবে- বলছে ভিসা নাই; ভিসা ছাড়াই নাকি হংকং যাবে!’ কথাগুলি সে এতটা তাচ্ছিল্লের সাথে এবং অহমিকা নিয়ে বলল যে, যে কেউ তাতে গুরত্বর অপরাধ হয়েছে ভেবে ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু আমি ভয় পেলাম না; কারণ আমি তো ‘আমি’।
 
আমি তাকে পাল্টা তীর্যক প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, ‘আপনি আমার পাসপোর্ট ছুড়ে মারলেন কেন? আপনার কি অধিকার আছে আমার পাসপোর্ট ছুড়ে মারার। এটা রাষ্ট্রিয় সম্পত্তি, আমার বৈধ পাসপোর্ট; আপনার কোন অধিকার নেই আমার পাসপোর্ট ছুড়ে মারার। আপনি কাজটি খুব খারাপ করছেন। অন্যায় করছেন।’
 
আমার দৃঢ়তায় সে সম্ভবত একটু হকচকিয়ে গেল; আমাকে আর কোন উত্তর না দিয়ে সে তার উর্দ্ধতন কোন কর্মকর্তাকে ডেকে আনলো। আমি তার সামনেই আরও কড়া ভাষায় বললাম, ‘আপনি আমার পাসপোর্ট, বোডিং পাশ ছুড়ে মারতে পারেন না; আপনাকে সভ্য আচরণ করতে হবে।’
 
এবার ঐ উর্দ্ধতন কর্মকর্তা আমাকে বললেন, আপনি আসুন আমার সাথে।
তিনি আমার পাসপোর্ট, বোডিং পাশ, টিকেট হাতে নিয়ে আমাকে একটু ছোট রুমে নিয়ে গেলেন। নিজে চেয়ে বসে আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘হংকং যাবেন, আপনার ভিসা কোথায়?’
 
আমি তাকে স্পষ্টভাষায় বললাম, হংকং যেতে ভিসা লাগে না; অন-এরাইভাল ভিসা পাবো।
– অাপনি কি করেন?
– বিজনেস।
– আপনার ভিজিটিং কার্ড আছে?
আমি আমার ভিজিটিং কার্ড বের করে দিলাম।
– ইনভাইটেশন লেটার আছে?
আমি ইনভাইটেশন লেটারটি বের করে দিলাম।
 
সব দেখে বলল, দেখুন আমি তো অাপনাকে যেতে দিতে পারবো না।
আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি একুশ হাজার টাকা দিয়ে ননরিফান্ডেবল টিকেট কিনেছি। জরুরী কাজে হংকং যাব ৩ দিনের জন্য। আপনাকে- আমাকে যেতে দিতেই হবে। অন্যথায়, আপনি আমার পাসপোর্টে লিখে দিবেন ঠিক কি অপরাধে এবং কোন আইনে আমাকে যেতে দিবেন না। যদি না লিখতে পারেন, তাহলে আপনার কোন ক্ষমতা-ই আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।’আমি খুব কড়া ভাষায় জবাব দিলাম।
 
ভদ্রলোক আমাকে এবার প্রশ্ন করলেন, আপনার বাসা কোথায়?
আমি বললাম, গ্রীনরোড।
এবার উনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, গ্রীনরোড কোথায়?
আমি বললাম, পান্থপথ সিগনালে কনসেপ্ট টাওয়ারে।
উনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, আমিও তো গ্রীনরোড থাকি; আপনাকে তো কখনও দেখিনি।
 
আমি ওনাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম করে বললাম, ‘আমারও তো ঐ একই প্রশ্ন, আমিও তো অাপনাকে কখনোই দেখিনি?’
 
এবার ভদ্রলোক বুঝলেন, আমার সাথে অন্তত কথায় তিনি পেরে উঠবেন না বা ভয় দেখাতে পারবেন না। ভদ্রলোক আমাকে কিছু না বলে চলে গেলেন। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি ছোট ঐ রুমটাতে।
 
অনেকক্ষন পর, আর একজন জুনিয়র অফিসার আসলেন আমার কাছে। আমাকে বললেন, ‘ভাই, আপনি বুঝতে পারছেন না কিছু?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, খুব ভাল মতোই বুঝতে পারছি সবকিছু।’
– তাহলো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
 
আমি সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কি করবো? ঘুষ দেব? আমি তো জানি কিছু টাকা দিলেই আমাকে যেতে দেবেন; তাই না? কিন্তু আমি যে ঘুষ দেব না ভাই। আমি আমার অধিকার বলে আজ হংকং যাব; যদি আপনাদের কোন ক্ষমতা থাকে আমাকে আটকিয়ে রাখেন। দেখি, পারেন কি না! তবে হ্যাঁ, আপনার অফিসারকে বলুন একটা প্লেট নিয়ে যদি আমার সামনে এসে হাত পাতে, তবে বিশ পঞ্চাশ টাকা দিতেও পারি; ভিক্ষা হিসাবে। ঘুষ আর ভিক্ষার মধ্যে আমি কোন পার্থক্য পাই না এখানে। যান তাকে ডেকে আনুন প্লেট সহকারে।’
 
এই অফিসারও চলে গেল।
আবারও আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। এদিকে ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে।
 
অনেকক্ষন পর, আরেকজন জুনিয়র অফিসার আসলো। আমাকে বলল, ‘ভাই আপনি যান তো’।
আমি বললাম, কোথায় যাব ভাই?
– ভাই আপনি যান; আপনাকে আটকিয়ে রাখার ক্ষমতা আমাদের কারোই না। আপনি হংকং যান।
 
আমি চলে গেলাম, হংকং জীবনে প্রথম বার।
 
বি.দ্র. ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশীদের হংকং যেতে ঢাকা থেকেই ভিসা নিতে হয় এবং ভিসা পাওয়াটা অনেক কঠিন। চায়না এবং মালয়েশিয়া বা সিংগাপুরসহ ৩/৪ টা দেশ ভিজিট করা থাকলে ঢাকার চাইনিজ এম্বাসী হংকং এর ভিসা দেয় (হংকং থেকে অফিসিয়াল ইনভাইটেশন আনতে হয়); অবশ্য ড্রাগন এয়ারলাইন্সও হংকং ভিসা করে দেয় যদিও এতে অনেক সময় লাগে।
 
   Send article as PDF