ড্রাইভিং

আমার বাসা ছিল গ্রীনরোড।
গ্রীনরোড থেকে আমার গ্রামের বাড়ীর দূরত্ব সড়ক পথে প্রায় ২৯ কিলোমিটার।
 
২০০৪ বা ২০০৫ সালের কথা। তখন এই দূরত্বটুকু যেতে অর্থাৎ ঢাকায় আমার বাসা থেকে গ্রামে আমার বাড়ীতে যেতে সময় লাগতো প্রায় দেড় ঘন্টা। আমি সাধারণত মাসে একবার (কোন এক শুক্রবার) সকালে বাড়ীতে যেতাম, আর ঐদিনই রাতে ঢাকায় ফিরতাম।
 
আর ২০১৩ বা ২০১৪-তে ঐ একই দূরত্ব পারি দিতে আমার সময় লাগতে প্রায় ২ ঘন্টা।
 
আমি খুবই যাচাই বাছাই করে এবং কম করে হলেও ন্যূনতম ১০ বছরের অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন ড্রাইভার নিয়োগ দিতাম। এবং তারা বেশ ভালই ড্রাইভ করতো।
 
উন্নয়নের জোয়ারে দেড় ঘন্টার রাস্তা দুই ঘন্টায় পৌছে যেত- হয়তো বা।
 
সে যাই হোক।
আমি ড্রাইভ করতে জানতাম না।
ড্রাইভারের দক্ষতাতেই আমাকে ভরশা করতে হতো।
 
গত তিন মাস হলো আমি নিজে ড্রাইভ করছি।
ড্রাইভিংটা আমার এখন বেশ ভালই লাগছে; খুব এনজয়ও করছি।
 
আমার বাসা থেকে আমার বর্তমান অফিসের দূরত্ব ১৮ মাইল।
মজার বিষয়টা হলো- ১৮ মাইলকে কিলোমিটারে কনভার্ট করলে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ঐ ২৯ এ। অর্থাৎ ২৯ কিলোমিটার।
 
আমি এখন প্রতিদিন নিজে এই ১৮ মাইল মানে সেই ২৯ কিলোমিটার রাস্তা ড্রাইভ করে অফিসে যাই এবং সন্ধ্যায় এই একই ১৮ মাইল রাস্তা ড্রাইভ করে আবার বাসায় ফিরে আসি।
 
যেই ১৮ মাইল রাস্তা ড্রাইভিং এ বাংলাদেশে সময় লাগতো প্রায় ২ ঘন্টা, সেই একই ১৮ মাইল রাস্তা নিউ ইয়র্কে ড্রাইভ করতে আমার সময় লাগছে গড়ে প্রায় ৩৫ মিনিট।
 
ঢাকা থেকে আমার গ্রামে যেতে আমাকে ৩টি ব্রীজের টোল পরিশোধ করতে হতো। আর নিউ ইয়র্কে আমি যদি টোল ব্রীজ দিয়ে অফিসে যাতায়াত করি তাহলে দূরত্ব কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৮ মাইলে এবং তখন সময় লাগে মাত্র ২২ মিনিট। আমি উভয় পথে দুবার করে ৫.৬৫ ডলার সেভ করতে টোল ব্রীজ পরিহার করি।
 
যাই হোক, ঢাকায় থাকতে আমি প্রতিদিন ২৯ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে প্রতিদিন অফিস করার সাহস করতাম না। কিন্তু এখানে এটা অতি সামান্য বিষয়। এখানে মানুষ ১০০ মাইল দূর থেকেও প্রতিদিন কর্মস্থলে যাতায়াত করে থাকে।
 
প্রসংগ পরিবর্তন করি, মূল কথায় আসি।
গত তিন বছর আমি মান্থলি ১৩২ টাকার আনলিমিটেড মেট্রোকার্ড ব্যবহার করে অফিসে যাতায়াত করতাম। ঐ ১৮ মাইল তখন পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কারণে বেড়ে যেত এবং এবং আমার প্রতিবার যাতায়াতে সময় লাগতো প্রায় দেড় ঘন্টা। ২/৩টা ট্রেন বদল করতে হতো।
 
প্রচন্ড অনিচ্ছা নিয়ে ড্রাইভিং শিখলাম।
তারপর একটা পচা গাড়ী কিনে মাস দুয়েক হাত পরিস্কার করলাম। এখন একটা বিএমডব্লিও চালাই, ফোর হুইল ড্রাইভ সেডান কার (এডব্লিওডি)। আমেরিকায় বিএমডব্লিও গাড়ী কেনায় আহামরি কোন বাহাদুরী নেই- বাচ্চারাও কিনে।
 
দীর্ঘদিন সাবওয়েতে চলাফেরা করায় নিউ ইয়র্ক শহর সম্পর্কে সত্যি বলতে আমার বাস্তব কোন ধারণাই গড়ে উঠতে পারেনি। কার ড্রাইভিং শুরু করার পর আমি সত্যিই হতবাক হয়ে গিয়েছি। নিউ ইয়র্কের মতো অতি ব্যস্ত একটা শহরের বুক চিড়ে এতএত হাইওয়ে, এক্সপ্রেস ওয়ে, সার্ভিস রোডগুলি মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আঁকরে রয়েছে- এটা আমার চিন্তারও বাইরে ছিল।
 
আমি কোনদিন ধারণাও করতে পারিনি যে ‘নিউ ইয়র্ক এর মতো একটা ব্যস্ত শহরে’র ভেতরে এভাবে রোড-নেটওয়ার্ক থাকতে পারে!
 
বাংলাদেশে কোন হাইওয়ে বা এক্সপ্রেসওয়ে নেই।
ঢাকা-সিটাগং রোডকে আমি লোকাল সার্ভিস রোড এর বেশী কিছু বলতে অপারগ।
 
ঢাকার প্রবেশমুখগলিতে দিনের বেলা লাইন ধরে অসহায় মালবোঝাই ট্রাকগুলি ঝিমুতে থাকে কখন রাত হবে- রাজধানী অতিক্রম করার লাইসেন্স পাবে! বন্ধ হয়ে থাকে ব্যবসায়ীদের পণ্যপরিবহন আর সেই বৃদ্ধি পাওয়া পরিবহন খরচটা শেষটায় গিয়ে পরে দেশের গরীব জনগনের দৈনন্দিন বাজার খরচে!
 
দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে রাজধানীকে ব্যবহার করতেই হয়- দিনের বেলা রাজধানীর উপর দিয়ে কোন ট্রাক চলতে পারে না। দৈনিক একটা ট্রাকের ভাড়া যেন কত? কত শত শত ট্রাক পণ্য নিয়ে বেকার বসে থাকে প্রতিদিন শনির আখড়া, সাভার, টংগীতে? হিসাব রাখার কেউ নেই।
 
৫০টা ষ্টেটের বিশাল দেশ আমেরিকা ১টি সেকেন্ড এরজন্যও থেমে থাকে না কখনও।
 
দেশকে থামিয়ে দিতে নেই।
 
দেশ মানে মাটি নয়, দেশ মানে মানুষ।
যতদিন আপনি দেশ মানে ‘মাটি’ বুঝবেন ততদিন দেশ উন্নত হবে না।
যেদিন থেকে আপনি দেশ মানে ‘মানুষ’ বুঝতে শুরু করবেন, ঠিক সেদিন থেকেই দেশ ঘুরে দাঁড়াবে।
 
আমেরিকার রাস্তা সম্পর্কে আমার অন্য একটা লেখায় অনেক গল্প করেছি, এখানে অার নতুন করে কিছু বলবো না। তবে একটা কথা বলতেই হবে, সেটা হলো- ‘আমেরিকা রাস্তা-মাতৃক দেশ’!
 
যাই হোক, নতুন গাড়ী ড্রাইভিং মানে অনেকটা ছোট বাচ্চাদের নতুন হাঁটা শেখার মতো। না পাড়লেও দৌড়াতে ইচ্ছে করে।
 
আমি একটা কাজের উছিলায় গেল শনিবার চলে গেলাম প্যানসালভ্যানিয়া।
 
১২৫ মাইল রাস্তা, যেতে সময় লাগলো প্রায় দেড় ঘন্টা। রাস্তার বর্ণনা দিচ্ছি না, তবে আমার মতো নতুন ড্রাইভার যখন কোন রাস্তায় ঘন্টায় ১০০ মাইল স্পীডে (১৬০ কিলোমিটার/ ঘন্টা) গাড়ী ড্রাইভ করতে পারে- তখন বাকীটুকু বুদ্ধিমান পাঠক বুঝে নিবেন নিশ্চয়ই।
 
শেষটায় শুধু একটা কথা বলা বাকী থাকলো।
লেখাপড়া না শিখলে মানুষকে মূর্খ বলা হয়। কিন্তু ড্রাইভিং শেখার পর আমি বুঝতে পারলাম, যারা ড্রাইভিং জানে না- তারাও মূর্খ। এতটাই মূর্খ যে- ড্রাইভিং না জানাটা যে মূর্খতা- সেটুকুও বুঝতে পারে না।
 
যেমন আমিও বুঝতাম না।
   Send article as PDF