প্যারা-নরমাল গল্প

এই মহাবিশ্বে ’প্যারা-নরমাল’ কিছু বিষয় রয়েছে যা আমরা সকলেই জানি। যাদের অভিজ্ঞতা সীমিত অথবা বুদ্ধির ঘাটতি রয়েছে তারা ‘প্যারা-নরমাল’ এক্টিভিটিজ বা জ্বিন কিংম্বা ভুত অথবা অতৃপ্ত আত্মার উপস্থিতি হেসে উড়িয়ে দেয়।

আরও মজার বিষয় হচ্ছে এই প্যারা-নরমাল এক্টিভিটিজকে মুসলিমরা যেমন জ্বিন হিসাবে বিবেচনা করে (জ্বিনের অস্তিত্ব পবিত্র কোরআনেও অনেকভাবেই উল্লেখ রয়েছে); অপরদিকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাকে ভূত-প্রেত (মৃত মানুষের আত্মা) হিসাবে ভেবে নেয়; এবং খৃস্টানরা তাকে ভাবে অতৃপ্ত-আত্মা হিসাবে যার মানে ’এরা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে না পরা মৃত ব্যক্তির আত্মা’।

এই প্যারা-নরমাল বিষয়টি নিয়ে আমার নিজের কিছু অভজারবেশন রয়েছে। আমি কখনওই সামনে থেকে ‘প্যারা-নরমাল’ কিছু নিজের চোখে দেখিনি যদিও; কিন্তু আমি তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করেছি; নিজের কানে শুনেছি; কর্মকান্ড লক্ষ্য করেছি ঘনিষ্ঠভাবে।

আসলে আমি চোখের দেখার চেয়ে মনের দেখায় বেশী অভ্যস্ত এবং বিশ্বাসী। আমি নিজের চোখে দেখা অনেককিছুকেই বিশ্বাস করে অভ্যস্ত নই বা প্রায়শই বিশ্বাস করি না। আমি প্রতিটি বিষয়কেই চোখ বন্ধ করে দেখতে বেশী ভালোবাসি। আর সেজন্য আমার দেখাগুলো একটু ভিন্নতা পায়; যা আমি নিজেও বুঝি।

প্রতিটি দেখার বিষয়ই ‘সম্পূর্ণ’ নয়।

যারা একটু দুর্বল চিন্তার মানুষ; অথবা যাদের সাহস কম কিংম্বা যারা যুক্তি মেলাতে অনভ্যস্ত বা জীবন-যুদ্ধে যথেষ্ঠ অভিজ্ঞতাহীন – তারা চোখের দেখাতেই ’আটকে’ যায়। ‘নিজের চোখে দেখেছি’ ব্যাক্যেই তাদের সমস্যা সৃস্টি হয়। এবং এখানেই তাদের সবচে বড় ভুলটি হয়ে যায়। যা তারা বুঝতেও পারে না। আর যারা ‘সমস্যা’টিকেই সঠিকভাবে বুঝতে পারবে না তারা তার সমাধান আদৌ বের করতে পারবে না।

যে-কোন সমস্যার সমাধান করতে হলে সবার আগে ‘সমস্যা’টিকে যথাযথভাবে বিস্তারিত বুঝতে হবে। সমস্যার আগাগোড়া বুঝতে পারলে সমাধান তো তুড়ি মেরে করে ফেলা যায়। সেটা যত বড় সমস্যাই হোক না কেন?

আমার লেখা যার নিয়মিত পড়েন তারা জানেন, আমি যখন ক্লাস নাইন বা টেইনে পড়ি তখন আমাদের মসজিদে নিয়মিত ইমামের অনুপস্থিতিতে আমাকেই আজান দিতে হতো এবং নামাজে ইমামতি করতে হতো।

তখনও আমি অপরিপক্ক মানুষ; সাহসও ছিলো সীমিত।

আলমাস নামে গ্রামের একটা ছেলে আমাকে প্রতিদিন নিয়মকরে ফজরের ওয়াক্তে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যেতো আজান দেয়া ও নামাজ পরার জন্য।

এক ভোরে আলমাস আমাকে নামাজের জন্য প্রতিদিনের মতোই ডাকলো। আমি ওকে বাইরের বারান্দায় প্রতিদিনের মতো বসতে বলে অজু করে রেডী হয়ে বের হয়ে দেখি আলমাস নেই। কিছুটা অবাক হলাম। ভাবলাম হয়তো ওর প্রাকৃতির তাড়ায় আগে চলে গেছে; ভোর হয়ে যাবে ভেবে সাহস করে একাই মসজিদে চলে গেলাম। আলমাস নেই। দেরী হয়ে যাবে, তাই আরেকটু সাহস করলাম।

আমাদের মসজিদের চতুর্দিকে আমার দাদা, দাদার বাবা, তার বাবা-চাচাদের কবর। বাঁশঝোড়। অন্ধকার নিরব এলাকা। তখনও ইলেকট্রিসিটি নেই আমাদের গ্রামে।

হারিকেনের আলোয় মসজিদে ঢুকে মাইকে আজান দিলাম।

আজান শেষ কেউ আসলো না। এমনকি যে আলমাস আমাকে ডেকে ঘুম থেকে তুলেছে সেই আলমাসও না। ওদিকে সূর্য উঠে যাবে; তাই একাই নামাজ আদায় করলাম।

মসজিদ তালাবন্ধ করে বের হয়ে যাচ্ছি তখন আলমাসকে দেখতে পেলাম সে মসজিদে আসছে। আমি ওকে ধমকের স্বরে বললাম, ’তুই এটা কি করলি? আমাকে ডেকে উঠিয়ে তোর কোনও খবর নেই!’

আলমাস বললো, ’কৈ না তো! আমি তো নিজেই ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। তোর আজান শুনে আমার ঘুম ভেংগেছে। তারপর রেডী হয়ে মাত্রই আসলাম; তোকে ডাকবো কখন?’

তাহলে আমাকে কে ডেকেছিলো সেদিন!

আমি আমার কানকে অবিশ্বাস করি নি; আজও আমার নিজের চোখ ও কানের প্রতি আমার অগাধ আস্থা বিদ্যমান রয়েছে।

এরপরও দীর্ঘসময় আমি জ্বিন এর অস্তিত্ব নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলাম।

জ্বিনের অস্তিত্ব আমি বিশ্বাস করতাম শুধুমাত্র এই কারণে যে, আমি পবিত্র কোরআনের প্রতিটি আয়াতকেই বিশ্বাস করি। এছাড়া অন্য কোন কারণ ছিলো না।

আমি আপাদমস্তক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ।

নিজে প্রমাণ না পেলে একটা বড় ’খটকা’ আমার চিন্তা ও মন থেকে সড়াতে পারি না। জ্বিনের উপস্থিতির ক্ষেত্রেও সেই খটকা আমাকে নিত্য ’ঝামেলা’ করতো।

ছোট বেলা থেকেই হরর মুভি খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু কোন হরর মুভি দেখলেই আমি ভয় তো পেতামই না; উপরোন্ত হরর মুভিকে আমার কাছে কমেডি মুভি বলে মনে হতো। প্রচুর হাসতাম ওসব দেখে।

যাই হোক, আমার সেই হাসিগুলো থেমে গেলো যখন থেকে ডিসকভারী চ্যানেলে ‘আমেরিকার প্যারা-নরমাল এক্টিভিটিজ’ নিয়ে সিরিজ ডকিউমেন্টারী দেখা শুরু করলাম।

ডিসকভারীর সেই ‘আমেরিকায় ভুত আছে’ শব্দটি আমাকে বেশ ‘চঞ্চল’ করে দিতো। যেহেতু আমি আমেরিকার সবকিছুতেই আনন্দ পেতাম; সেহেতু এই আমেরিকান ভুতের বিষয়টিও আমাকে বেশ আপ্লুত করতো, ভাবাত। হালকা একটু ভয় কাজ করলেও আমি বেশ মজা পেতাম এবং প্রতিটি সিরিজ দেখতাম। সংগে ‘অতৃপ্ত আত্মা’দের কর্মকান্ডগুলো অনুধাবন করতাম। বোঝার চেস্টা করতাম।

যাই হোক, আমেরিকায় চলে আসলাম।

তখন আমি টেক্সাসের ডালাসে (আর্লিংটন) থাকি।

টেক্সাস আমেরিকার মেইনল্যান্ডের সবচে বড় স্টেট (আমেরিকার সবচে বড় স্টেট আলস্কা; টেক্সাস আয়তনে দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টেট)। টেক্সাস আসলে একটি বৃহৎ গ্রাম। গ্রামকেই শহরের রূপ দেয়া যেন। সবকিছুই সেখানে বিস্তৃত পরিসরে।

যাই হোক, আমার এপার্টমেন্টটিও ছিলো একটি কমপ্লেক্স এর মধ্যে। দ্বিতীয় তলায়। সেন্ট্রাল এসি। বাসায় অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধে বিদ্যমান। কিন্তু খুবই নীরব সবকিছু। আমেরিকানরা নিরবতা পছন্দ করে।

এই বাসায় উঠার পর লক্ষ্য করতাম বাথরুমে ঢুকলেই কেমন যেন অস্বস্তি কাজ করতো। শীতল কিছু অনুভব করতাম। ভালো লাগতো না। যদিও তার কোনই কারণ খুঁজে পেতাম না।

কয়েকদিন পরপরই বাসার ইলেকট্রিক বাল্বগুলো ফিউজ হয়ে যেত। রাতে বাসায় ‘খটখট’ ‘খটখট’ আওয়াজ শুনতে পেতাম কিন্তু কিছুই দেখতাম না। এমনকি ‘খটখট’ আওয়াজ হবার মতো কিছুই সেই বাসায় ছিলো না। অনেকভাবে আমি পরীক্ষা করেছিলাম সেই আওয়াজের উৎস খুঁজতে। কিন্তু পাইনি।

২ বার ওয়াশিং মেশিন নস্ট হয়ে গেলো। ২ বার নস্ট হয়েছে রিফ্রিজারেট। কতৃপক্ষ দু’বার করেই সবকিছু রিপ্লেস করে দিয়েছে।

ভালো ফ্রিজে অথচ ফ্রিজের ভেতরের খাবার নোনতা হয়ে যেত; অনেক সময় নস্ট হয়ে যেত। আর প্রতি রাতের খটখট খটখট তো নিত্যদিনের ঘটনা। ঈদের সময় আমার এক ফ্রেন্ড এসে দু’রাত ছিলো আমার বাসায় – সে দু’দিন শুধুমাত্র কোন খটখট খটখট আওয়াজ পাইনি।

বেডরুমেও মাঝে মধ্যেই শীতল অনুভূতি টের পেতাম।

সে তো গেল।

আবারও নিউ ইয়র্ক সিটিতে ফিরে এলাম।

২০১৮ সালে ব্রঙ্কসে আমার এক ফ্রেন্ড একটি বাড়ী কিনে।

আমার ফ্রেন্ড বাংলাদেশে বসবাস করতো, এবং ওখানে বসে বাসাটি ভাড়া দিতে হিমসিম খেতো। সে ২০১৯ সালের জুনে আমেরিকায় এসে আমাকে বেশ অনুরোধ করতে থাকে আমি যেন তার বাসায় উঠি।

তার অতি আন্তরিক অনুরোধটুকু আমি অবহেলা করতে পারিনি।

তার বাসায় উঠলাম, তখন পবিত্র রমজান মাস ছিলো – রোজের শেষের দিকে। ঈদের দিন কয়েক পর জীবনে প্রথম সরাসরি সেই অতিপ্রাকৃতিক বা অশরীরি কিছুর উপস্থিতি টের পাওয়া শুরু করলাম। (সেটা নিয়ে আমার একটি পুরো আর্টিকেলই রয়েছে যেটাতে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলাম।)

আমার বাসার রিফ্রিজারেটরে ‘টকটক’ ’টকটক’ করে টোকা দিতো। নাহ, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র এবং ইলেকট্রনিক্স এপ্লায়েন্সএর বিষয়ে হয়তো আপনার চেয়ে অভিজ্ঞতা আমার ঢের বেশী; কারণ আমার ব্যবসায়ও বড় একটা বিষয় ইলেকট্রনিক্স আইটেমস নিয়েই।

এটা কোন মেকানিক্যাল প্রব্লেম ছিলো না।

এবং তা আরও বেশী কনফার্ম করতে আমি রিফ্রিজারেটর এর পাওয়ার অফ করে দিই। এবং প্রায় সংগে সংগেই সেই খটখট আওয়াজ করতে থাকে আমার মাইক্রোওয়েভ ওভেনে। আমি অতপর সেই ওভেনের পাওয়ারও যখন অফ করে দিই তখন সেই একই ‘টকটক’ আওয়াজ হতে থাকে কিচেনের কেবিনেটের পেছনে।

আমি অনেকের সংগে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি; সকলেই যার যার মতো করে আমাকে পরামর্শ বা বুদ্ধি দিতে থাকে।

আমি অনেক কিছুই করি ঐ ‘টকটক’ আওয়াজকে থামাতে।

কিন্তু এতে সে আরও বেশী ‘ভয়ংকর’ হয়ে উঠে। আমি নিজেও তখন আনুপাতিকহারে ‘ভয়ংকর রূপ’ গ্রহন করি।

বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করি।

অনেকে আমাকে বুদ্ধি দিলো, বাসার চারদিকে আজান দিতে, কোরআন তেলাওয়াত করতে, রুকাইয়া করতে, ইত্যাদি অনেক কিছুই করতে।

আমি বুঝে না বুঝে তা করা শুরু করলাম।

আমি অসীম সাহসী মানুষ। আমি ভয় পেতাম না তেমন একটা। আমার বিশ্বাস অটুট আছে যে, ‘মানুষ অবশ্যই জ্বিনের চেয়েও শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান’। সুতরাং সে আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু একটা ভয় আমার কাজ করতো আর তা ছিলো ডিসকভারী টিভিতে দেখা তাদের ভয়ংকর আচরণগুলো (যা আমার বাসায় কখনওই হয়নি)। আমি শুধুই টকটক টকটক আওয়াজ পেতাম।

আমি ওদের বাসা থেকে তাড়ানোর জন্য আগ্রাসী হয়ে উঠলাম।

বাসায় আজান দিতাম। জোরে কোরআন তেলাওয়াত করতাম। এমনকি কিচেনে ঢুকে আজান দিতেম। কোরআন তেলাওয়াত করতাম। ইউটিউবে উচ্চস্বরে রুকাইয়ার তেলাওয়াত চালিয়ে রাখতাম।

কিন্তু লক্ষ্য করছিলাম, এতে সেও আর বেশী আগ্রাসী আচরণ শুরু করতো, তার টকটক বাড়িয়ে দিতো আমার সংগে যে যুদ্ধ করছে এমন একটা ভাব নিয়ে।

আমি তো ছেড়ে দেবার পাত্র নই।

আমিও দ্বিগুন শক্তিতে আমার কার্যক্রম চালিয়ে যেতাম; যেন ওকে আমি বিদায় করবোই এবং সাহস হারাতাম না। আমি ভাবতাম আমার হাতে পবিত্র কোরআন আছে, আমার অযু করা আছে। পৃথিবীতে কারোর কোন ক্ষমতাই নেই আমার এই ’শক্তি’কে পরস্ত করার।

এবং মজার এবং আসল বিষয়টি হচ্ছে আমার এই মনের জোর বা ‘শক্তি’র কারণেই সে আমার সংগে হেরে না গেলেও আমাকে পরাজিত করতে পারেনি।

আমার আজকের গল্প মুলত ‘পরাজিত’ না হওয়ার গল্প।

পরাজিত না হবার কৌশল সম্পর্কে। চরম বিপদে কিভাবে আপনি টিকে থাকবেন।

আপনাকে সবসময় মাথায় রাখতে হবে যে ‘আপনি জিতবেনই’।

আপনাকে চুড়ান্তভাবে কায়ামনোবাক্যে বিশ্বাস করতে হবে – কেউ আপনাকে পরাজিত করতে পারবে না।

আপনি যখন এই বিশ্বাসটাকে নিজের শরীরের অংশ হিসাবে গণ্য করতে পারবেন – তখন আপনার চতুর্দিকে একটি অদৃশ্য পবিত্র দেয়াল বা ’বাবল’ তৈরী হবে। এবং যে-কোন অশুভ শক্তির কাছে সেই ‘বাবল’টি হবে সম্পূর্ণভাবে অভেদ্য।

কেউ না দেখতে পেলেও ঐ ’বাবল’টি ঐ অশুভ শক্তি দেখতে পাবে এবং সে বুঝে ফেলবে যে ঐ বাবল ভেদ করে আমার কাছে আসার কোন ক্ষমতাই তার নেই।

সে তখন ব্যর্থ হবে।

আর ঐ অশুভ শক্তির ব্যর্থতাই হচ্ছে আপনার বিজয়।

মজার বিষয় হচ্ছে ওর আবাস ছিলো আমার বাসার কিচেনে। আরও পরিস্কার করে বললে বলতে হবে – তা ছিলো আমার বাসার রিফ্রিজারেটরে পেছন দিকটায়।

আমি প্রতিদিনই কিচেনে ঢুকে ওকে বিদায় করার জন্য, ওর টকটক বন্ধ করানোর জন্য আজান দিতাম, কোরআন তেলাওয়াত করতাম। এতে সে ক্ষুদ্ধ হতো, বিরক্ত হতো এবং তার টকটক বাড়িয়ে দিতো। বাড়িয়ে দিতো বলতে সে আমার সংগে পাল্লা দিয়ে টকটকটকটক করতে থাকতো।

একদিন এমন চললো টানা প্রায় ২ ঘন্টার ‍উপর।

আমি এক সময় ক্লান্ত হয়ে কিচেন থেকে বের হয়ে আসলাম।

রাতে বেডরুমে ঘুমাতে গিয়েছি।

প্রথমবার সে আমার বেডরুমের জানালার বাইরে থেকে টকটক করা শুরু করে দিলো। এবার আমি কিছুটা অপ্রস্তত হলাম।

আমার মন বলছিলো কৌশল পরিবর্তন করতে হবে।

এই বাসায় আমার থাকাটা ঠিক হবে না।

সেই রাতে, মানে তখনই আমি বাসা থেকে বের হয়ে গাড়ী নিয়ে অফিসে চলে গেলাম – রাতে অফিসে থাকবো। এবং সিদ্ধান্ত নিলাম এই বাসায় আমি আর থাকবো না। বাসা চেঞ্জ করবো।

বাসা চেঞ্জ করলাম।

কিন্তু তাতে কোনও লাভ হলো না। ‘সেই অশরীরি’ আমার সংগে আমার নতুন বাসায় এসে উপস্থিত। শুধুকি তাই, সে আমার সংগে আমার গাড়ীতেও অবস্থান করা শুরু করলো।

আমি তখন মার্সেডিজ বেঞ্জ এর অত্যাধুনিক সেডান (ই-350) কার ব্যবহার করি। বাসার সামনে গাড়ী পার্ক করে রাখি। সকালে গাড়ী নিয়ে অফিসে যাবো – ডোর আনলক করে বসতে গিয়ে দেখি আমার সিটের উপর, ফ্লোরে এবং সামনের সর্বত্র অসংখ্য হোয়াইট আমেরিকান পুরুষ ও মহিলাদের লালচে-সাদা চুল দিয়ে ভরা।

আমি চমকে উঠেছিলাম।

যাই হোক, তা পরিস্কার করে গাড়ী স্ট্রার্ট দিলাম।

আমি কখনওই গাড়ীতে হ্যান্ড ব্রেক ব্যবহার করি না।

কিন্তু ড্রাইভে দেবার পরই লক্ষ্য করলাম গাড়ী আমিকে হ্যান্ডব্রেক ‘আনলক’ করতে নির্দেশনা দিচ্ছে!

আমি হতবাক! আমি বিস্মিত।

কিভাবে সম্ভব! আসলে মার্সেডেজ-বেঞ্জ গাড়ীতে ঠিক কোথায় হ্যান্ডব্রেক থাকে আমি সেটাই জানতাম না।

সংগে সংগে গুগল করে, ইউটিউবে দেখলাম কিভাবে হ্যান্ডব্রেক লক-আনলক করে এবং এটার অবস্থান গাড়ীর ঠিক কোথায়। তারপর দেখলাম গাড়ীর হ্যান্ডব্রেক লক করা। তার আগে আমি এই ‘লক’টি চোখেই দেখিনি। এমনকি অসতর্কভাবে সেখানে হাত যাওয়া অসম্ভব!

সে আমাকে বিভিন্নভাবে শংকিত করে দিতে চাইতো।

সে আমাকে তার কাছে আত্মসমর্পন করাতে চাইতো।

আমাকে সে পরাজিত করাতে চেস্টা করতো।

কিন্তু আমি জানতাম, আমি একজন মানুষ।

মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ হচ্ছে সৃস্টির সেরা জীব।

মানুষের চেয়ে শক্তিশালী এই মহাবিশ্বে কেউ নেই।

এই মানুষ তার শক্তি আর বুদ্ধি ব্যবহার করে চাঁদে চলে গেছে। সেই মানুষ একটা সামান্য অশরীরি আত্মার কাছে কেন পরাজিত হবে?

আমি পরাজিত হতে মোটেও প্রস্তত ছিলাম না; তাই সে আমাকে পরাজিত করতে পারেনি। আমার সংগে তার দীর্ঘ প্রায় ৪ মাস এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে।

আমেরিকায় প্যারা-নরমাল এক্টিভিটিজ নিয়ে গবেষনা করে এমন প্রচুর প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমি তাদের কাছে আমার সংগে ঘটে চলা বিষয়গুলো নিয়ে ই-মেইলে যোগাযোগ করলাম। প্রতিষ্ঠানগুলো এলাকাভিত্তিক কাজ করে। আমার এলাকা ছিলো তখন নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ড। তারা আমার বাসায় আসতে চাইলো ’ইনভেস্টিগেট’ করতে।

তবে, স্ট্যাটান আইল্যান্ড থেকে আমাকে একটি উদ্দিপনাময় ইমেইল পাঠালো। খুব মনোযোগ দিয়ে আমি ই-মেইল নির্দেশনাটি পড়তে লাগলাম। এবং অদ্ভুৎভাবে দেখতে পেলাম ওরা আমাকে ঠিক সেই রকম পরামর্শ দিয়েছে যা আমি গত ৩ মাস যাবৎ করে চলছিলাম।

ভীষন অবাক হলাম।

ওরা আমাকে আমার ধর্মগ্রন্থ বেশী বেশী পাঠ করতে পরামর্শ দিয়েছিলো। ওরা আমাকে সাহস হারাতে বারণ করেছিলো; ওরা আমাকে সবসময় প্রবিত্র থাকতে বলেছিলো। এবং ওরাই আমাকে জানালো যে, তুমি যখন নিয়মিত ‘এমনটা করবে তখন তোমার চতুর্দিকে একটি অদৃশ্য দেয়াল (বাবল) তৈরী হবে যা তুমি দেখতে পাবে না কিন্তু ঐসব অশরীরি আত্মারা দেখতে পাবে এবং তারা ঐ ’বাবল’ ভেদ করে তোমার ধারে কাছে আসার ক্ষমতা হারাবে। এবং এটাই হচ্ছে ওদের পরাজয়।

ওরা তোমাকে ক্রমান্বয়ে পরাজিত করতে চেস্টা করে যাবে। যদি তুমি হেরে যাও তবে তুমি শেষ। এখানে তোমাকে হেরে যাওয়া চলবে না। তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে যে তুমিই জিতবে এবং তারচে তোমার শক্তি অনেকগুন বেশী।

যাস্ট এই ‘বিশ্বাস’টুকুই তোমাকে বিজয়ী করবে যে-কোনও অশরীরি হাত থেকে।

আমি নিয়মিত চার কুল (কুল দিয়ে শুরু পবিত্র কোরআনের ৪টি সুরা) তেলাওয়াত করতাম। আর আমি জানতাম এই চারকুল একজন মানুষকে কতটা আত্মিকভাবে শক্তিশালী ও দৃঢ় মনোবল জোগাতে পারে।

সেই মনোবল আমার ভেতরে তৈরী হয়ে গিয়েছিলো।

এমন মনোবল যখন আপনার ভেতরে তৈরী হবে তখন কোন জ্বি বা অশরীরি অথবা কালো যাদুই আপনাকে আর ভেদ করতে পারবে না। আপনি ‘দুর্ভেদ্য’ হয়ে উঠবেন যে-কোন ’কালো যাদু’ বা ’বান’ অথবা যে-কোনও ’অশরীরি আত্মা’ বা খারাপ ’জ্বিন’ অথবা ভুতের আঁচর থেকে।

আমরা জানি স্বয়ং মুহাম্মদ (সা) কেও যাদু করা হয়েছিলো। এবং সেই অসুভ যাদু থেকে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন।

ইহূদীদের মিত্র বনু যুরায়েক্ব গোত্রের লাবীদ বিন আ‘ছাম তার মেয়েদের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা) এর উপর এই জাদু করেছিলো। প্রথমে সে রাসূল (সা)-এর বাসার কাজের ছেলের মাধ্যমে কয়েকটি চুলসহ রাসূল (সা)-এর ব্যবহৃত চিরুনীটি সংগ্রহ করে। অতঃপর তার কন্যাদের দ্বারা উক্ত চুলে ১১টি জাদুর ফুঁক দিয়ে ১১টি গিরা দেয় ও তার মধ্যে ১১টি সুঁচ ঢুকিয়ে দেয়। অতঃপর চুল ও সুঁচ সমেত চিরুনীটি একটি খেজুরের শুকনা কাঁদির আবরণীর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ‘যারওয়ান’ কূয়ার তলায় একটি বড় পাথরের নীচে চাপা দিয়ে রাখে।

আয়েশা (রা) বলেন, উক্ত জাদুর প্রভাবে আল্লাহর রাসূল (সা) মাঝে মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়তেন। যে কাজ তিনি করেননি, তা করেছেন বলে মনে করতেন! একরাতে মুহাম্মদ (সা) এর স্বপ্নে দু’জন ফেরেশতা এসে নিজেদের মধ্যে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তাঁকে জাদুর বিষয়ে অবহিত করেন এবং সেটি কোথায় আছে বলে দেন। ফলে পরদিন আলী, যুবায়ের ও ‘আম্মার বিন ইয়াসিরসহ একদল ছাহাবী গিয়ে উক্ত কূয়া সেঁচে পাথরের নীচ থেকে খেজুরের কাঁদির খোসাসহ চিরুনীটি বের করে আনেন।

ঐ সময় সূরা ফালাক্ব ও নাস নাযিল হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) ঐ দুই সূরার ১১টি আয়াতের প্রতিটি পাঠ শেষে এক একটি গিরা খুলতে থাকেন। অবশেষে সব গিরা খুলে গেলে তিনি স্বস্তি লাভ করেন।

আমি একটু আগেই ৪-কুল সম্পর্কে বলছিলাম। তার মধ্যে দুই কুল (সুরা ফালাক্ক ও সুরা নাস) ঐ যাদুশক্তিকে পরাজিত করতেই সরাসরি নাজেল হয়েছিলো।

যাই হোক, জ্বিন, ভুত, যাদু, অশরীরি আত্মা যা-ই বলেন সবকিছুকেই পরাজিত করা সম্ভব যদি আপনি সাহস রাখেন এবং নিজেকে একটি বাবলের মধ্যে সর্বদা ঢুকিয়ে রাখতে পারেন।

কোন শক্তিই আপনার সৃ্স্ট বাবল ভেদ করে আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না।

নিজের ভেতরে আত্মিক শক্তি তৈরী করুন।

এমন শক্তিকে পরাজিত করা বা তা ভেদ করা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়।

এবং ব্যক্তি জীবনে সফলতা পাবার জন্য প্রতিটি মানুষেরই আধ্যাত্মিক (অবচেতন মনের চর্চা) জ্ঞানলাভ করা অসম্ভব জরুরী। একমাত্র আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ ও তা চর্চার মাধ্যমেই নিজেকে হেফাজতে রাখার জন্য একটি অভেদ্য বাবল তৈরী করা সম্ভব।

   Send article as PDF