আরাকান আর্মি

ঠিক সাড়ে ৮টায় আমাকে পিক-আপ করার জন্য মাইক্রোবাসটি আমার হোটেলের নীচে এসে দাঁড়ালো। গাড়ীতে উঠে বুঝতে পারলাম আমিই এই গাড়ীর শেষ প্যাসেঞ্জার।

একটাই সীট ফাকা ছিলো, আমি উঠে বসলাম এবং সকলকে ‘হাই, হাও ইউ অল আর ডুয়িং‘ বলে আমার উপস্থিতি জানান দিলাম। কয়েকজন হোয়াইট পিপলস আমাকে ’হ্যালো, গুড মর্ণিং’ বলতে কার্পন্য করলো না।

আমার ডান পাশে একটি সুদর্শন ছেলে বসা ছিলো।

ওর সংগে হাত মিললাম এবং জানতে চাইলাম তুমি কোন দেশ থেকে এসেছো? আমার ধারণা ছিলো ছেলেটি পাকিস্তানী অথবা ভারতীয়। দেখতে বেশ স্মার্ট।

যাই হোক, সে জানালো যে সে ‘মিয়ানমার’ থেকে এসেছে।

তারপর টুক-টাক কথা হলো এবং আমি চুপ হয়ে গেলাম। বাইরের সুন্দর প্রকৃতি দেখতে শুরু করলাম।

আমাদের সারাদিনের ট্যুরটি ছিলো ফিফি আইল্যান্ডস-এ। অতি চমৎকার ও মনোরম পরিবেশ, অশান্ত আন্দামান সাগরের সবুজ পানি। চোখ জুড়িয়ে যায়।

কিন্তু একটা সময় লক্ষ্য করলাম, বেশ রূপবতী একটা মেয়ে খুবই সংক্ষিপ্ত পোষাক পরে সাগরের বুকে বারবার হারিয়ে যাচ্ছে যেন; আর সেই মেয়েটিকে সংগ দিচ্ছিলো আমার সংগে গাড়ীতে পরিচিত হওয়া সেই মিয়ানমারের ছেলেটি।

এবং ফেরার দিকে শেষ একটি রাইডে ওরা এবং আমিসহ আর এক-২ জন একই বোটে স্থান পেলাম। সংক্ষিপ্ত পোষাকের মেয়েটি ওই ছেলেটির সংগে কিছু ছবি তুলতে চায়, আমাকে ছবি তুলে দেবার অনুরোধ জানালে আমি ওদের বেশ কিছু ছবি তুলে দিলাম।

ফিফি আইল্যান্ডস এর ভ্রমণ শেষ হলো।

আমরা এবার ফিরতি গাড়ীতে এবং কাকতালিয়ভাবে সেই ছেলেটি এবারও আমার পাশেই এসে বসলো। প্রথমে খেয়াল করিনি, কিন্তু একটু পরই বিষয়টা খেয়াল হলো।

আমি বরাবারই একটু বেশী কৌতুহলী মানুষ।

কোন সুযোগকেই হাতছাড়া করতে রাজী নই। তাই ছেলেটাকে বললাম, ’আমি যদি তোমার দেশের বিষয়ে তোমার সংগে কিছু আলোচনা করি – তুমি কি তাতে মাইন্ড করবে?’

ছেলেটি স্মিত হেসে জবার দিলো, ‘না মাইন্ড করবো না, তুমি যে-কোনও প্রশ্ন করতে পারো।’

আমি ছেলেটিকে প্রথম প্রশ্নটি করেছিলাম, ‘তোমার দেশে তুমি ঠিক কোন সিটিতে থাকো? ইয়াংগুন না কি অন্য কোনও সিটিতে।’

ওর ইংলিশ মোটামুটি ভালো ছিলো।

জানালো ইয়াংগুন থাকে। আমি ওর কাছ থেকে জেনে নিলাম মিয়ানমারে রেঙ্গুন এবং ইয়াংগুন দু’টো শব্দই ব্যবহৃত হয়। সুতরাং আমি যে-কোনটাই বলতে পারি।

সে নিজে থেকেই আন্তরিকভাবে নিজের পরিচয় দিলো।

ওর বাবার গাড়ীর ব্যবসা রয়েছে ইয়াংগুনে এবং সে পৈত্রিক ব্যবসায় পুরোপুরি সময় দেয়। ওদের ব্যাবসা বেশ লাভজনক এবং তারা বেশ ভালোই জীবন-যাপন করছে ওদেশে।

আমি আস্তে আস্তে ওর সংগে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। বিশেষ করে অং সান সুচি দেশের নেতা হিসাবে কেমন? বর্তমান সামরিক শাসকরাই বা কেমন, দেশের অবস্থা কেমন ইত্যাদি।

ও জানালো, ‘সুচি গণতান্ত্রিক নেত্রী। তবে, সে সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত সেজন্য, এবং তার পিতা খুবই জনপ্রিয় নেতা ছিলেন বিধায় সুচিও সেখানে যথেষ্ঠ জনপ্রিয় নেত্রী; সে নিজেও তাকে পছন্দ করে। যদিও সুচি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে যথেষ্ঠ প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেনি, তারপরও ওদেশে বিকল্প কেউ নেই সূচি ছাড়া।’

আমি ছেলেটির সংগে কথায় কথায় ওদের দেশের আরও অনেক গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনায় এগুচ্ছিলাম। সে ছিলো খুবই স্বতস্ফূর্ত, দ্বিধাহীনভাবে সে আমার সব কথার জবাব দিচ্ছিলো। খুবই খোলা মনের একটি মানুষ সে আমি বুঝে ফেললাম।

একটা পর্যায়ে আমি জানতে চাইলাম যে, নিউ ইয়র্কে আমার একজন বাংলাদেশী উপজাতি ফ্রেন্ড রয়েছে যে মিয়ানমারের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে এবং সে ২-এক বছর পরপরই মিয়ানমারে যায় শ্বশুরবাড়ীতে বেড়াতে এবং খুবই সুন্দর সুন্দর ছবি পোস্ট করে। দেশটি খুবই সুন্দর এতে আমার কোনই সন্দেহ নেই। আমিও সেখানে যেতে আগ্রহী। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমি নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা হলেও আমি একজন বাংলাদেশী এবং বাঙালী। ইয়াংগুন শহরটি আমার ভ্রমনের জন্য যথেষ্ঠ নিরাপদ বলে তুমি মনে করো?

ছেলেটি জবাব দিলো, হ্যা, নতুন রাজধানী নেপিডো হলেও ইয়াংগুন সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এবং ভ্রমণের জন্য নিরাপদ।

এবার আমি জানতে চাইলাম, আমি আসলে ইয়াংগুন ভ্রমণে যতটা আগ্রহী তারচে শতগুন বেশী আগ্রহী সিটওই শহরটি ভ্রমণে। কারণ এক সময় এই শহরটি সংগে বাংলাদেশের চট্রগ্রাম এর খুব ঘনিষ্ঠ ব্যবসা ও যোগাযোগ ছিলো।

এবার ছেলেটি নড়েচরে বসলো।

জানালো, ’আমি ইয়াংগুনের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও আমার স্থায়ী ঠিকানা কিন্তু সিটওই। আমার জন্মও সেখানে, ওটা আমার নিজের শহর। আর আমি মিয়ানমারের নাগরিক হলেও আমি কিন্তু একজন রাখাইন। এবং আমি আমার রাখাইন পরিচয়টিতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। এবং তুমি অবশ্যই সিটওই যাবে না; সিটওই তোমার জন্য মোটেও নিরাপদ শহর নয়।’

এবার ছেলেটির সরলতায় সত্যিই খুব মুগ্ধ হলাম।

কারণ আমিও ধারণা করতাম যে সিটওই বাঙালীদের জন্য মোটেও নিরাপদ শহর হতে পারে না। কারণ, এই যে লাখ লাখ রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ থেকে ঢুকে পরেছে তাদের নিজ প্রদেশটির নাম হচ্ছে ‘রাখাইন’ এবং সিটওই হচ্ছে রাখাইন প্রদেশের রাজধানী শহর। যেখান থেকে বাঙালী-রোহিঙ্গাদের বিতারিত করা হয়েছে, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের সেই শহর অবশ্যই কোন বাঙালীর জন্য নিরাপদ হতে পারে না।

আমি এবার ছেলেটিকে প্রশ্ন করলাম, তোমাদের স্টেটটির নাম কি রাখাইন না কি আরাকান?

ও উত্তর দিলো, ‘রাখাইন’।

আমি জানতে চাইলাম, তোমার স্টেটে যে সুচির সরকারের সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হলো, নির্যাতন করা হলো, সেখান থেকে তাদের বিতারিত করা হলো প্রায় দেড় মিলিয়ন রোহিঙ্গাদের – সেটাকে তুমি কোন দৃস্টিতে দেখ? এই বিষয়ে তোমার দৃস্টিভংগি কি? যেহেতু তুমি নিজেও একজন রাখাইন?

ছেলেটি আমার চোখের দিকে তাকালো, অন্ধকারে আমি পরিস্কার বুঝতে পারলাম।

বললো, দেখ আমি বয়সে তখন আরও তরুন। উম্মাদনা আমার ভেতরেও ছিলো, তখন আমি বিষয়টিকে সমর্থনও করেছিলাম কিন্তু এখন আমি অনুতপ্ত। শুধুমাত্র আমি একা অনুতপ্ত নই, আমাদের রাখাইনদের অধিকাংশই এবং এই বিষয়ে অনুতপ্ত। আমরা ওদের পছন্দ করি না তার একটা বড় কারণ রয়েছে। কিন্তু তারাও তো এই ভূমিরই সন্তান, তাদের বাড়ীঘর এখানেই – কেন তাদের বিতারিত করা হবে?

আমি ওকে থামালাম। প্রশ্ন করলাম, সরি, একটু বলবে কেন ওদের তোমরা পছন্দ করো না। ওদের সমস্যাটা কি অপছন্দ করার?

ছেলেটি বললো, প্রথমত ওরা অশিক্ষিত। স্কুলে যেতে চায় না। তারচেও বড় সমস্যা হচ্ছে ওদের প্রজনন হার। যে হারে ওরা সন্তান উৎপাদন করে চলে তাতে আগামী ২০ বছরের মধ্যে আমরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবো; এটা আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ।

আবারও আমি ওকে থামালাম। তোমরা কি ওদের সচেতন করার কোন চেস্টা নাওনি? সচেতন না করে ওদের দেশ থেকে নির্যাতন করে, গণহত্যা করে দেশ থেকে বের করে দেয়াটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত?

উত্তরে সে জানালো, আমরা চেস্টা করেছি যদিও তা অপ্রতুল ছিলো। ব্যর্থতা আমাদেরও আছে। আর সেজন্যই আমরা অনুতপ্ত। ওদের আরও একটা বড় সমস্যা হচ্ছে – ছোট খাটো কোন ইস্যু পেলেই ওরা ওটা নিয়ে বিরাট বিশৃংখলা সৃস্টি করে ফেলতো। ওদের বোঝানো যেত না; ওরা আচরণে উগ্রতা প্রকাশ করতো। আমরা রাখাইনরা কিন্তু মোটেও উগ্র নই। কিন্তু একটা পর্যায়ে সরকার ও সেনাবাহিনীর সংগে আমরাও চাইলাম ওদের দেশ থেকে বিদায় করে দিতে। আমরা স্থানীয় রাখাইনরা ওদের বিদায় করতে অনেক বাড়াবাড়ি করেছি। এমনটা আমরা ঠিক করিনি।

ছেলেটির প্রতি আমার বেশ মায়া জন্মালো।

আমি এবার ওকে একটা খুব কঠিন বিষয়ে জানতে চাইলাম। আমি বললাম, আচ্ছা তুমি কি আমাকে আরাকান আর্মি’র বিষয়ে কিছু জানাতে পারো? এরা কারা? আমি যদ্দুর জানি রাখাইন এবং আরাকান মুলত একই বিষয়। তোমরা রাখাইন আর তোমাদের রাজ্যটি হবার কথা আরাকান।

এবার ছেলেটি আবারও আমার মুখের দিকে তাকালো এবং নম্র স্বরে যা জানালো তাতে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। সে বললো, আমাদের স্টেটটির নাম রাখাইন; আসলে রাখাইন বা আরাকানী দু’ভাবেই আমাদের বলা হয়। আমাদের রাখাইনরাই মুলত আরাকান আর্মির সদস্য। ওরা আমাদের মুক্তিদূত। আমি নিজেও আরাকান আর্মির একজন সমর্থক। এবং আমাদের রাখাইন স্টেটের সকলেই আরাকান আর্মিকে অন্তর থেকে সমর্থন করে। আমরা মাইয়ানমারের সংগে আর থাকতে আগ্রহী নই। আমরা আলাদা দেশ গঠন করবোই এবং সেই দেশের নাম হবে আরাকান। আর এটাই আরাকান আর্মির একমাত্র লক্ষ্য। আজ হোক, ১০ বছর সময় লাগুক আমরা বিচ্ছিন্ন হবোই। মাইনমারকে আমরা আর সহ্য করবো না। আমাদের আরাকান আর্মির সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলছে। তরুনরা দলে দলে আরাকান আর্মিতে যোগ দিচ্ছে। এবং আরাকান স্বাধীন হলে আমরা বিতারিত বাঙালীদের ফিরিয়ে আনবো, তাদের শিক্ষিত করে তুলবো এবং তারাও আমাদের মতোই আরাকানি। আমরা চাই ওরা আমাদের সংগে যোগ দিক। কিন্তু ওদের এবং আমাদের ইস্যু একটু ভিন্ন, তাছাড়া ওরা আমাদের বিশ্বাস করে না। কিন্তু আমাদের প্রধান নেতা ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে ঘোষনা দিয়েছে যে, বিতারিত রোহিঙ্গা-বাঙালীদের নিজ দেশে ফেরত আনা হবে।

আমি হতভম্ব হয়ে পরলাম।

এমন উত্তর পাবো বুঝতে পারিনি।

তুমি কি সত্যিই বলছো যে, আরাকান স্বাধীন দেশ হবে? তোমরা সকলেই মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন আরাকান বানাবে?

সে জানালো, হ্যা, অবশ্যই। আমরা ঐক্যবদ্ধ। সিটওই এখনও মিয়ানমার সেনাদের দখলে, শহরটি মোটেও এখন নিরাপদ নয়। কিন্তু সিটওই বাদ দিলে প্রায় পুরো দেশটিই বা কম করে হলেও ৮০ শতাংশ ভূমি আমাদের আরাকান বাহিনীর দখলে রয়েছে। আমরা এখনও প্রশাসন চালাতে পারছি না – কিন্তু শিগগিরই আমরা প্রশাসনও গঠন করে ফেলবো।

আমি ওকে বললাম, মিয়ানমার একটি বিশাল দেশ। চায়না মিয়ানমার সরকারের দৃঢ় সমর্থক। তোমরা কিসের ভরসার আরাকানকে বিচ্ছিন্ন করবে, আলাদা দেশ গঠন করবে? তোমাদের কি কোন দেশ সমর্থন দিচ্ছে?

ও জানালো, হ্যা। ভারত আমাদের সমর্থন দিচ্ছে কিন্তু খুব গোপনে। ভারত আমাদের অস্ত্র দিচ্ছি, ট্রেনিং দিচ্ছে। ভারতও চায় আরাকান স্বাধীন হোক কিন্তু তারা সরাসরি ঘোষনা দিচ্ছে না। এবং ভারতীয় বর্ডার সংলগ্ন বিশাল অঞ্চলটি আরাকান বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানে মিয়ানমার বাহিনীর কেউ নেই, আসতেও পারে না।

আমি শেষটায় বললাম, আমি মনে প্রানে চাই তোমরা সফল হও।

ছেলেটি হেসে দিয়ে বললো, আমরা স্বাধীন রাস্ট্র গড়ার পর ভারত ও বাংলাদেশের সংগে সবচে সুন্দর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবো। আমরা রোহিঙ্গাদের কাছে ক্ষমা চাবো এবং তাদের ফিরিয়ে নিবো। তুমি দেখে নিও। আর আমরাও ইয়াঙ্গুনের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবো এবং সিটওইতে ফেরত যাবো। তুমি তখন বেড়াতে এসো।

আমি হেসে বললাম, আমিও খুব খুশী হবো।

যাই হোক, গাড়ী ওদের হোটেলে এসে দাড়ালো।

ছেলেটি গাড়ী থেকে নেমে গেলো। কিন্তু পেছনে ফিরে একটি বারের জন্যও ওর বান্ধবীর দিকে ফিরেও তাকালো না। পরে মেয়েটি নেমে হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলো।

আমি যা বোঝার বুঝে নিলাম।

আর মনে মনে ভাবলাম বাংলাদেশ অথরিটি সামান্য দূরদর্শি হলেই আরাকান আর্মির সংগে রোহিঙ্গাদের টাই করিয়ে দিতো এবং তাতে ওরা আরও দ্রুত স্বাধীন দেশ গড়তে পারতো।

   Send article as PDF