হায়রে সভ্যতা!

সাদাদের প্রতি আমার দূর্বলতা সেই ছোট বেলা থেকেই।
 
একটি আমেরিকান মিশনারী স্কুলে আমি পড়াশোনা করেছি যেই স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন একজন আমেরিকান (ব্রাদার জন ষ্টেফিন) এবং আমাদের ইংলিশ পড়াতেন আরেকজন আমেরিকান ব্রাদার ডানাল্ড; সেটা যদিও আমার ক্লাস ফাইভ আর সিক্স এর কথা; কিন্তু এসব ভূলার নয়।
 
সাদাদের এক কথায় সবাই বলে বর্ণবাদী।
কিন্তু, আজ পর্যন্ত নিজের চোখে দেখা কোন সাদা মানুষদেরকেই আমার কাছে কোনদিনও বর্ণবাদী মনে হয়নি। এখনও না। আর এখন তো আমি সাদা মানুষদের দেশেই বসবাস করছি।
 
নিউ ইয়র্ক সিটিতে একমাত্র ম্যানহ্যাটন ছাড়া অন্য কোথাও সাদা’দের তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না। সাদারা নরমালী সাধারণের সাথে মিশে না। এটাকেই অনেককে বর্ণবাদী আচরণ বলতে পারে।
 
কিন্তু আমার আছে যুক্তি।
 
আচ্ছা, আপনি বা আমি, আমরা কি কখনও আমাদের দেশের খুব গরীব, ছেড়া, নোংড়া জামা-কাপড় পড়া অথবা বাসার কাজের মেয়েটিকে ‘নিজেদের আপন-জনের’ মতো করে কোনদিনও কাছে টেনে নিয়েছি!
– কেউ কি আছেন বলতে পারবেন?
– কোন নোংড়া জামা-কাপড় পড়া লোকজনকে আপনার বাসার দামী সোফায় বসতে দিতে স্বাচ্ছন্ন বোধ করেন?
না, কেউই তা করে না বা আমিও করিনা।
 
এর কারণও একটাই- সেটাও বর্ণবাদী বা নিজেকে বড় মনে করা অথবা নোংড়াকে অপছন্দ করা। আমি এখানে দোষেরও কিছু দেখি না। নোংড়া, ময়লা আমি অপছন্দ করি।
 
পোষাক-আষাক, জামা-কাপড়, গাড়ী-বাড়ী, চলা-ফেরা, কেনা-কাটা, আয়-রোজগাড়ে এবং আচার-ব্যবহারে সাদারা অনেক অনেক অনেক উপরে অবস্থান করছে। যেখানে এই নিউ ইয়র্কেও আমরা ৫০ ডলার দিয়ে একটা ড্রেস কিনতে ৭ বার চিন্তা করি, সেখানে তারা অবলিলায় ৩০০/৪০০ ডলারের ড্রেস কিনে ফেলছে কোন চিন্তা ছাড়াই।
 
আমরা এবং কালো বা স্প্যানিশরা যেখানে ৮ থেকে ১০ ডলারের খাবারের বিল দিতেই অসহায় হয়ে পরি সেখানে সাদারা ২/৩ জন মিলে এক ভোজেই ২০০ ডলার বিল করে ফেলছে।
 
তাহলে, ওরা আমাদের কি কোলে নিয়ে হাঁটবে? কোন যোগ্যতায় আমরা ওদের সমান হবো, শুনি?
 
যাই হোক, কিছুদিন আগে ডালাসের ইউনিয়ন ষ্টেশনে একদিন ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় প্লাটফর্মে বসে আছি। প্রচন্ড গরম, ঘামে ভিজে আছি। হঠাৎ ঠিক আমার সামনে লক্ষ করলাম একটা ২ বা আড়াই বছর বয়সের ছোট সাদা বাচ্চা হাতে একটা চিপসের খালি প্যাকেট হাতে আমার সামনে দিয়ে একবার একটু যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে তার মা’র কাছে। আমার কৌতুহল বেশী। বাচ্চাটার কান্ডটা দেখতে মন চাইলো। ওকে ফলো করলাম যে দেখি সে করে? তারপর সে আমার কৌতুহল এর অবসান করে দিল। এক পর্যায়ে দেখতে পেলাম- দৌড়ে সে একটা ডাষ্টবিনের কাছে যেয়ে ওই খালি প্যাকেটি তার মধ্যে ফেলে দিল।
 
আমি লজ্জা পেলাম। আমার দেশ আমাকে এই শিক্ষাটা দেয়নি। আমার বাবা-মাও আমাকে এই শিক্ষাটা দেননি আমার শিশু বেলায়। আমি আমার পরিবেশ থেকে শিখেছি হাতের ময়লা বা ব্যবহৃত সবকিছু উম্মুক্ত রাস্তা বা চলন্ত গাড়ীতে যেখানে পারি ছুড়ে ফেলতে।
 
আমি বিশেষতঃ ট্রেনেই চলাফেলা বেশী করি। সাদা-কালো নির্বিশেষে সবাইকেই দেখি তাদের খাবারগুলি শেষ করার পর উৎছিষ্ট বা খালি প্যাকেটটি নিজ নিজে ব্যাগের প্যাকেটে ভরে ফেলে, কাউকে এখানে সেখানে কোন কিছু ছুড়ে মারতে দেখি না।
 
আরেকদিন আমার ডান পাশে একটা সাদা মেয়ে বসা, সিক্স ট্রেনে ল্যাক্সিনটন থেকে এইটি-সিক্স যাচ্ছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একটা কালো মহিলার শিশু বাচ্চাটা তার ক্যারিয়ার গাড়ীতে থেকে একটা ছোট খেলনা ছুড়ে মারলো আমাদের দিকে। ঠিক আমার পায়ের কাছেই এসে পড়লো। আমার পাশের সাদা মেয়েটি সেই খেলনাটি তুলে নিয়ে সিট থেকে উঠে ওই বাচ্চাটার হাতে দিয়ে আবার নিজ সিটে এসে বসলো। একটু পরই সেই পিচ্চি ওই একই কাজ করলো, খেলনাটি ছুড়ে দিল। সেই মেয়েটিও আবার সেটি কুড়িয়ে ওর হাতে দিয়ে আসলো; মোট ৪বার ঘটনাটি ঘটলো। আমি সেদিনও কিছু শিখলাম।
 
গতকাল আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। অার ট্রেনে রুজভেল্ট থেকে ল্যাক্সিনটন যাচ্ছিলাম। ঠিক সেদিনের মতোই একটা ছোট বাচ্চা তার গাড়ীতে থেকে একটা খেলনা ছুড়ে ফেলল। আমি, আমার সেদিনের সেই শিক্ষাটাকে কাজে লাগালাম। বাচ্চাটির মা আমাকে থ্যাংকস দিল, আমি নো প্রোব্লেম বলে একটা ছোট হাসি যোগ করলাম। এই ছোট হাসি যোগ করাটাও আমি আমেরিকায় এসেই শিখেছি।
 
গেল সপ্তাহে ক্যাসেল হিল ষ্টেশনে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠছি। একটা সাদা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ মনে হলে ও হয়তো আমাকে ফলো করছে। ওর দিকে তাকালাম, বুঝলাম আমার ধারণা ভুল- আমার পেছন পেছন ওর সংগী কেউ উঠছে। আমি সম্ভবত একটু বেশীই তাকিয়ে ছিলাম। মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে দিয়ে আমাকে বলল, ‘হাই, হাও আর ইও ডুয়িং?’।
 
এটা আসলে আমেরিকার একটা কমন শিক্ষা। কেউ কারো দিকে তাকালে বা রাস্তায় পরিচিত-অপিরিচিত যে-কেউ অন্য যে-কাউকেই এই আচরণটুকু করে থাকে। এখন আমি নিজেও এটা করি। প্রাকটিস হয়ে গেছে। এই ব্যবহারটুকু আমি কালোদেরও সবসময় করতে দেখি। ওরাও সাদাদের কাছেই শিখেছে।
 
আমার দেশ, আমার পরিবেশ আমাকে আরেকটি বিষয়ও শিখিয়েছিল। সেটা হল, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বড়রা বসবে, আর ছোট বাচ্চাদের কোলে নিতে হবে। তারা তো টিকেট কাটবে না তাই।
 
আর আমেরিকায় এসে শিখলাম ঠিক তার উল্টোটা। এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে দেখি সবাই নিজে উঠে সিট খালি করে দেয় ছোট বাচ্চাদের আগে বসার জন্য। আমিও শিখে ফেলেছি, ট্রেনে যাতায়াতের সময় ছোট বাচ্চাদের দেখলে নিজে উঠে গিয়ে তাদের বসতে দিই। বৃদ্ধ বা প্রেগনেন্টদের তো বসতে দিই-ই সংগে একটু হাসিও যোগ করি। এটুকুও তো এখানেই শিখা।
 
জীবনে প্রথমবার গেলাম নেপাল। ভিসা পাসপোর্ট ছাড়াই। সেটা আমার প্রথম ভারত ভ্রমনের সময়। ভারত যাবার পর জানলাম ডাবল এন্ট্রি ভিসার কথাটা এবং আরও জানলাম ভারতের আইন হলো যে বর্ডার দিয়ে ঢুকবো সেই বর্ডার দিয়েই ফিরতে হবে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার যেমন যে পথ দিয়ে যায় আবার ঠিক সেই পথ দিয়ে ফিরে; অনেকটা সেরকম।
 
কিন্তু সেই সময় নেপাল যে আমার অতি প্রিয় দেশ। কাঠমানডু খুবই স্বপ্নময় শহড় আমার কাছে। আমি যাবই। জানলাম, ভারত-নেপালের মধ্যে চুক্তিবলে এক দেশের লোক অন্য দেশে যেতে কোন ভিসা-পাসপোর্ট বা আইডি কার্ডেরও কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং নো টেনশন। কোলকাতায় এক পরিচিত জনের বাসায় আমার ল্যাগেজ রেখে ওর ভেতরে আমার পাসপোর্ট ঢুকিয়ে রওয়ানা হলাম শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং। সেখানে ভ্রমণ শেষ করে গেলাম মিরিক। তারপর সেখানকার নেপালী বর্ডার। নিজেকে শিখিয়ে নিলাম আমি এখন ইন্ডিয়ান, বাড়ী কোলকাতায়।
 
নেপালী বর্ডার পশুপতিনাথ।
না তো। বর্ডারে কেউ নেই। দূরে দেখলাম একজন বিএসএফ সদস্য দাড়িয়ে আছে। তাকে ইংলিশে বললাম, নেপালে যেতে কোন ডকুমেন্টস লাগবে কিনা? সে বলল, কিছুই লাগবে না, তুমি চলে যাও। আবার বললাম, রুপি চেঞ্জ করবো কোথায়? তিনি বললেন, ইন্ডিয়ান রুপিও নেপালে চলে; তবে তুমি ওপারে একটা ব্যাংক দেখতে পাবে ‘নেপালকা রাষ্ট্রিয়া ব্যাংক’ ওখানেও চেঞ্জ করে নিতে পারো।
 
ঢুকে গেলাম নেপালে। বাসে করে প্রথমবার গেলাম কাঠমানডু।
কোলকাতার চেয়ে অনেক অনেক বেশী টুরিষ্ট কাঠমানডু শহরে। সাদা আর সাদা। আমি তো মহা খুশী। খুব আনন্দ নিয়ে ঘুড়ে বেরালাম ৪/৫দিন ভরে।
 
যাই হোক দেশে তো ফিরতে হবে।
চিন্তা করলাম একই পথে ফিরলে তো নতুন কিছু আর দেখতে পাবো না। কাজেই এবার অন্য পথে। কয়েকটা টুরিষ্ট অপারেটরের সাথে কথা বলে জানলাম, সোনেওয়ালী বর্ডার দিয়ে আমি দিল্লী যেতে পারি বা গোরাকপুর থেকে ট্রেনে হাওড়া ফিরতে পারবো।
 
কোন এক সন্ধ্যায় কাঠমানডু থেকে বাসে করে রওয়ানা দিলাম সোনেওয়ালী’র পথে। গাড়ী তে উঠে তো আমি আরও খুশী। কারণ গাড়ী ভরা ৮০% যাত্রীই সাদা চামড়ার। সারা-রাত ওদের হৈচৈ-তে কোন ঘুম হলো না। সকালে পৌছে গেলাম নেপালী বর্ডার সোনেওয়ালীতে।
 
আমার আবার একটা অভ্যাস, ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বাথরুম সারতে হবে। বাস থেকে নেমেই বাথরুমের খোঁজ করলাম এবং পেয়েও গেলাম। কিন্তু মাত্র ২টি বাথরুম। এবং দু’টোই বুকড। ভেতের কেউ আছে। আমি সামনে দাড়ালাম। একটু বেশী সময় পর বাথরুমে ঢুকার সিরিয়াল পেলাম।
 
মাত্র বাথরুমে ঢুকেছি, একটু পরই দরজায় ২/৩বা ঠকঠক শব্দ। আমি কিছুটা বিরক্ত; আবার ভাবলাম- থাক যতটা তাড়াতারি সম্ভব বের হয়ে যাই। অন্য কারো হয়তো বেশী প্রেশার থাকতে পারে।
 
আমি দরজা খুলে বের হবো; দেখলাম কাল রাতের বাসে আমার সংগে ফেরা একটি সাদা মেয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে শুধু একটা কথাই বলছিল, আমি অত্যন্ত দুঃক্ষিত। আমি বুঝতে পারিনি কেউ ভেতরে থাকতে পারে। আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাকে বিরক্ত করেছি- কাজটা আমার ঠিক হয়নি। আমি সত্যিই বুঝিতে পারিনি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো।
 
আমি কিছুটা বোকা, অবাক এবং হকচকিয়ে গেলাম। বাথরুমের দরজায় সামান্য টোকাতো আমরা নিয়েমিতই দিই। এজন্য এতো ক্ষমা চাইতে হবে?
হ্যাঁ। আমি সেদিনই প্রথম সাদাদের কাছ থেকে সভ্যতা, ভদ্রতা এবং অপরের সাথে কি ধরণের আচরণ করতে হবে- তা শেখা শুরু করি। এবং আজও শিখেই যাচ্ছি।
 
তাই তো সাদাদের প্রতি আমার এতো দুর্বলতা। এতো ভালোবাসা। এবং অনেক অনেক বেশী সম্মান করি- আমি সাদাদের। শুধু আরও একট ভদ্রতা শিখার আশায়।
 
পুনশ্চ: আমি ভ্রমণ পাগল মানুষ। কথায় কথায় কারণে বা অকারণে দেশ বিদেশ ঘুড়ে বেড়িয়েছি সারাটা জীবন। তো, সভ্যতার প্রসংগে কোলকাতার বাঙালী বাবুদের একটা কথা শেয়ার করা যুক্তযুক্ত হবে।
 
বনগাঁ রেলষ্টেশন থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত আমি প্রায়ই ট্রেন এ চেপে যেতাম। ৩ ঘন্টায় কোলকাতা শহড়ে পৌছে যেতাম। কিন্তু এই ট্রেনটি ছিল আমার কাছে রীতিমত আতংক। কোলকাতার বাবুরা বাংলাদেশের লোকদের সিটে বসা দেখলেই- ‘এই তুমি ওঠ। তোমরা বসছো কেন? আমরা নিয়মিত যাত্রী; এ সিট আমাদের।’ এসব বলে উঠিয়ে দিত। আমাকেও পর্যন্ত ৫/৭ বার সীট থেকে উঠে যেতে হয়েছে ওই রুটে।
 
হায়রে সভ্যতা!
 
   Send article as PDF