বাংলাদেশ পাকিস্তান কুটনৈতিক যুদ্ধ

বাংলাদেশ পাকিস্তান কুটনৈতিক যুদ্ধ প্রসংগে কয়েকটি কথা
বর্তমান বিশ্বে ইকনোমী ফ্লাইটগুলিতে সস্তায় ভ্রমণ করা যায়, ভাড়া অবশ্যই কম; শুধুমাত্র কোন খাবার সরবরাহ করা হয় না। আমার দৃষ্টিতে এটা ভালো। যার পয়সা আছে সে কিনে খেতে পারে। অবশ্য বিমান অপারেটররা চাইলে এক বোতাল পানি সরবরাহ করতে পারে কিন্তু সেটা না করাটা তাদের দৃষ্টিকটু সীমাবদ্ধতা তথা কোম্পানীর চারিত্রিক দোষ।
ভারত সরকারের আমন্ত্রণে আমরা পাঁচজন তরুন যাচ্ছিলাম জয়পুরের সাবেক রাজধানী ‘সিটি অব লেকস’ নামের শহর উদয়পুর।
ঢাকা থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে লেটনাইটে ফ্লাই করে কোলকাতায় ঘন্টা দুয়েকের যাত্রা-বিরোতি। তারপর একই এয়ালাইন্সের দিল্লী ফ্লাইটে উঠে বসলাম; এটাও ইকনোমী ফ্লাইট- কাজেই কোন খাবার পাব না। বিমান যথা সময়ে যাত্রা শুরু করলো।
কিছুক্ষন পর একজন বিমান-বালা আমাদের সিটের সামনে এসে ‘তৌফিকুল ইসলাম’ কে খঁজছিল। আমি কিছুটা হতবাক। মধ্য আকাশে এই সুন্দরীর আবার আমাকে কি প্রয়োজন!
আমি মৃদু হাসলাম- সে বুঝতে পারলো; আমাকে সুন্দর হাসি দিয়ে বলল, তোমারা পাঁচজন আমাদের রাষ্ট্রিয় অতিথি। তোমাদেরকে আমাদের ফ্লাইটে স্বাগতম। আর, তোমাদের জন্য রয়েছে কপ্লিমেন্টালি ফুডস; তোমরা কি খেতে চাও? ভেজ অর ননভেজ।
আমি ভারতের ফ্লাইটে ভেজ খাবার বেশী লাইক করি। কাজেই বললাম, ‘৪টা ননভেজ এবং আমার জন্য অবশ্যই ভেজ’।
রাস্ট্রিয় আমন্ত্রনে এটাই আমার প্রথম বিদেশ সফর নয়; এর আগেও সিনো-বাংলা কুটনৈতিক সম্পর্কের ৩০ বর্ষ উপলক্ষে আমি চায়না সফর করেছি; তাদের আতিথেয়তা আমি জীবনে কোনদিন ভুলতে পারবো না। সে গল্প আরেকদিন।
বুঝলাম, আমাদের জন্য ভালই কিছু অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ আসছে। মুল অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ভারতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হামিদ আনসারী।
স্বামী বিবেকানন্দ এর জন্ম বার্ষিকী এবং ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসকে সামনে রেখে প্রতি বছরই ‘ন্যাশনাল ইয়ূথ ফেষ্টিভেল’ অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে ভারত বর্ষের সবগুলি ষ্টেট বা রাজ্য অংশগ্রহণ করে।
২০১১ এ উদয়পুরে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ইয়ূথ ফেষ্টিভেল এর থিম সং ছিলো- ‘সবচে পাহেলে ভারত’ এখনো আমার কানে বাজে; এতোটাই মনজুড়ানো দেশাত্ববোধক সংগিত ছলো ওটি।
দিল্লী নব-নির্মিত ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের ডোমাষ্টিক গেট দিয়ে বের হতেই মি. সিং আমাদের সাথে পরিচত হলেন এবং অভ্যর্থনা জানালেন। সত্যি বলতে বেশ উপভোগ্য অর্ভথ্যনাই ছিল সেটা।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো বিশাল ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল সাইন্স সেন্টার কমপ্লেক্স এর গেষ্ট হাউজে। বিশাল কমপ্লেক্স; রাজকীয় অভ্যর্থনা।
আমাদের আগেই ওখানে উপস্থিত ভুটানের ৫জন রাষ্ট্রিয় আমন্ত্রিত তরুন-তরুনী; ওদের তরুন-তরুনী না বলে ১ জন বাদে বাকী সবাই কিশোর-কিশোরী।
পরিচিত হলাম।
ওদের দলনেতা শেহরাব তেনজিং ফক্স Sherab Tenzin Fox একটি সরকারী স্কুলের ইংরেজী শিক্ষক; ভেরী ইয়াং ম্যান। সারাক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে বাকী ৪জনের মধ্যমনি হয়ে ব্যস্ত ওদের আনন্দ দিতে। কৌতুহল এবং কিছুটা হিংসেও হলো (পরবর্তীতে তেনজিং ফক্স আমার খুব ভালো বন্ধু)।
আমাদের বলা হল, কাল সকালের ফ্লাইটে আমরা উদয়পুর যাবো; আজ খাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন কাজ নেই।
তবে, যে-বিষয়টি আমার দৃষ্টি এড়ায়নি তা হলো ভারতীয় কর্মকর্তারা ভুটানের পিচ্চি পিচ্চি ডেলিগেটদের কোন পাত্তাই দিচ্ছে না। আমাদের (বাংলাদেশী ডেলিগেট) খুব পাত্তা দিচ্ছে; আমরা সত্যিই ভীষন মুগ্ধ ভারতীয় হাই অফিসিয়ালদের ব্যবহারে।
মি. সিং এর সাথে কথা বলে জানলাম, পরদিন সকালের ফ্লাইটে কলোম্ব থেকে শ্রিলংকান দল উদয়পুর এসে পৌছবে। আর পাকিস্তানীরা আসবে ১দিন পর। নেপাল এবং মালদ্বিপ থেকে সময়ের অভাবে এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে কোন ডেলিগেট আসছে না। এবং এবারই প্রথম সার্কভুক্ত দেশগুলি থেকে ৫ জন করে ডেলিগেটকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দিল্লী পর্যন্ত আসা-যাওয়ার গেষ্টদের বহন করতে হবে; এরপর যাবতীয় থাকা-খাওয়া-ভ্রমণ সবই ভারত সরকার বহন করবে।
পরদিন সকালে আমাদের আবার নিয়ে যাওয়া হল সেই দিল্লী ইন্দিরা গান্ধি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ডোমাষ্টিক লাউঞ্জে আমাদের অপেক্ষা করতে বলা হল। এবং বলে দেয়া হলো- সব খাবারই এখানে কমপ্লিমেন্টাল; আমরা যার যা খুশী খেতে পারি, কমপিউটার ব্যবহার করতে পারি। নবগঠিত দিল্লীর এয়ারপোর্টটি সত্যিই অনেক বিশাল, আধুনিক, পরিচ্ছন্ন এবং চমৎকার সুন্দর।
উদয়পুর মহারানা প্রতাপ এয়ারপোর্টে পৌছলাম দুপুর বেলা; আমাদের সাথে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, কয়েকজন সচিব এবং আমাদের অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা মি. সিং সহ। আমাদের আগেই ওখানে পৌছে গেছে ১জন মেয়েসমেত (সান্দেমালী) ৫জন শ্রীলংকান ডেলিগেট। এয়ারপোর্টেই পরিচিত হলাম ওদের সাথে; তারমধ্যে ২জনই আবার সিংহলিজ মুসলমান।
এখানেও দারুনভাবে উপলব্ধী করলাম, রাষ্ট্রিয় আতিথেয়তায় বাংলাদেশকেই ওরা প্রাধান্য দিচ্ছে। আমারাও মহাখুশী। আমরা ৫জন নিজেদের মধ্যে এটা নিয়ে আলোচনা করতাম। কোচে উঠতে, খাবার টেবিলে, আলোচনায় প্রথমেই বাংলাদেশীরা। আমরা সত্যিই অভিভুত। আমাদের পরের অবস্থান শ্রীলংকানদের এবং সবশেষে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো পেছনে পেছনে ভুটানিজরা।
পরদিন আমাদের আইডি কার্ড দেয়া হবে, ছবি তুললাম; প্রথমেই বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠান উদ্ভোধন হলো, ভারতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট আসলেন। খুবই প্রানবন্ত জাকজমকপূর্ণ সুশৃঙ্খল অনুষ্ঠান। আমাদের বসার স্থান হলো ভিআইপি লাইনে; আমন্ত্রিত বিদেশী পর্যবেক্ষক সাড়িতে। ভারতীয় উপ-রাষ্ট্রপতির রাষ্ট্রিয় প্রটোকল উপলব্ধি করলাম। অনেক বিষয়েই আমি ভারতকে স্যালুট করি, ওই অনুষ্ঠানটি আমাকে ভারতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
খুব ভালই চলছিল সবকিছু।
কিনতু সুখ বেশীদিন কপালে সয় না।
আমাদের সুখের আঙ্গিনায় হঠাৎই হানা দিল পাকিস্তান।
১জন ডাক্তার, ১জন মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারসমেত ৫ সদস্যের পাকিস্তানি ডেলিগেট ২য় দিন উদয়পুরে এসে উপস্থিত।
কুটনীতি কি বিষয়; সেদিন আমি শিখলাম ভারতের কাছে।
আমাদের পাত্তা এবার কমে গেল। শ্রীলংকার তো খবরই নেই। আর ভুটান? ওদের কে গুনে?
সবকিছুতেই পাকিস্তান আগে। পাকিস্তানকে অখুশী করা চলবে না। পাকিস্তানের প্রতি ভারতের বাড়াবাড়ি রকমের প্রধান্য এবং দর্শনীয় আথিতেয়তা! সত্যি আমরা সকলে হতবাক।
মি. সিং যেন আমাদের চেনেনই না।
ভারতের কাছে বাংলাদেশের অবস্থানটি আমি সেদিন-ই বুঝতে পেরেছিলাম।
আরও বুঝেছিলাম প্রতিদ্বন্দিকে কিভাবে সম্মান জানাতে হয়।
এবং কুটনৈতিক শিষ্ঠতা কি জিনিস তা-ও সেদিনই কিছুটা বুঝেছিলাম।
এভাবেই চলল। কোচে উঠতে, খাবার খেতে, অনুষ্ঠানে, বসার সাড়িতে- সব জায়গায় আগে ডাক পরে পাকিস্তানীদের; তারপর বাংলাদেশ, এরপর শ্রীলংকা এবং অবশেষে ভুটানিজরা তো এমনি এমনিই এসে হাজির। ভুটানিজরা বুজে গেছে ওরা এমনই, দুধ-ভাত!
বিষয়টি নিয়ে শ্রীলংকানরাও ভীষন আহত; আমাদের সাথে ওরা বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলো।
আমি এক পর্যায়ে কথাচ্ছলে মি. সিংকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পাকিস্তানকে তো তোমরা শত্রু জ্ঞান করো; এখন যে এতো পাত্তা দিচ্ছ; ঘটনা কি?’
মি. সিং মৃদু হাসলেন; বললেন, ‘কোথায়? আরে না, আমরা তো শুধু উপরের নির্দেশ পালন করি।’
যা-ই হোক তিন দিনের অনুষ্ঠান শেষে আমাদের উড়িয়ে নেয়া হল দিল্লীতে। অনুরোধ করা হলো নিজ নিজ দেশে পৌছে যেন ওদের ই-মেইল দিয়ে জানাই।
আমরা ফিরে এলাম ঢাকা। ওহ, সেটা ছিল ২০১১ সালের জানুয়ারী মাসের ২য় সপ্তাহের ঘটনা। সংশ্লিষ্ঠ কিছু ছবি দিলাম।
যা-ই হোক, বিষয়টি নিয়ে লিখলাম একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় চাইলেই অনেক কিছু করা যায় না।
কোন বুদ্ধিমান লোক কখনোই কারো সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে না; যার যত বড় নেটওয়ার্ক সে ততবড় বুদ্ধিমান, সে ততবড় শক্তিমান, সে ততবড় মানুষ। আমার জীবনে আমি এই শিক্ষাটা অর্জন করেছি। আমি কারো সাথেই সম্পর্ক ছিন্ন করি না। জীবনে কবে কাকে কখন কিভাবে কাজে লেগে যাবে আপনি বলতে পারবেন না। সম্পর্ক নষ্ট করলে আপনার নিজেরই ক্ষতি সবচে বেশী। এই বিষয়টা আপনি যত আগে বুঝবেন, ততবেশী লাভবান হবেন।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাথে যা যা হচ্ছে- তার সম্পূর্ণ দায়ভার বাংলাদেশেরই।
কি দরকার ছিল একজন কুটনৈতিককে বহিষ্কার করার? বিনিময়ে ওরা যে আমাদের একজনকে বহিষ্কার করবে- সেটা নিতান্ত মূর্খ না হলেও বোঝা যায়।
কি প্রয়োজন ছিল ওদের আরেকজনকে আটক করে ৪/৫ ঘন্টার তামাশা করার। একজন কুটনৈতিককে কখনোই আটক করা যায় না। কুটনৈতিক সুরক্ষা বলে একটি আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে।
পাকিস্তান অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে ইনষ্টান্ট রিএকশনও দেখিয়েছে- না পাকিস্তান গাধার মতো বাংলাদেশী কুটনৈতিককে আটক করেনি; বুদ্ধি খাটিয়ে অপহরণ করিয়েছে!
শেখ হাসিনা টিম পাকিস্তান কে খুব ছোট আর কাঁচা ভেবেছে; যেমনটা ভাবে বিএনপিকে।
আর বাংলাদেশের ‘আবাল’ সাংবাদিক ও মিডিয়াগুলিও মনে করে বাংলাদেশ অনেক বিড়াট কিছু হয়ে গেছে। একটা বিষয় এসব ‘বোকাচোদা’দের বুঝতে হবে- পারমানবিক শক্তিধর পাকিস্তান আন্তর্জাতিক খেলা খেলে- ঝানু দেশ ভারতের বিপরীতে; ইরান, আফগানিস্থান, রাশিয়া এমন কি আমেরিকার সাথেও তারা সুযোগ বুঝে পাঞ্জা লড়ে। পাকিস্তান- ভারতের মতো আঞ্চলিক সুপার-পাওয়াকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অভ্যস্থ; ভারতকে তারা পড়োয়াও করে নাই কোনদিন- এখনও না।
আর অামাদের বাংলাদেশ? ভারতের কাছে শুধু নতজানু হতেই শিখেছে। খেলাটাও শিখেনি।
বাংলাদেশের প্রশ্নবিদ্ধ তথাকথিত আন্তজার্তিক আদালতের কিছু বাধিত বিচারপতির দেয়া রায়, যার সাথে পাকিস্তান সরাসরি জড়িত; সেখানে তারা তো কথা বলতেই পারে। আমরা কি বলছি না পাকিস্তানকে নিয়ে? এটা হবেই; পাকিস্তানের সাথে খেললে খেলতে হবে বুদ্ধি খাটিয়ে; বোকাচোদা সুবিধাবাদী আওয়ামী লীগের কি সেই বুদ্ধি রয়েছে?
বাংলাদেশের মানুষকে পুলিশ লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে গুলি করে, গুম করে সাময়িকভাবে দাবিয়ে রাখা গেলেও, পাকিস্তানকে ‘বোকা’ ভাববার কোন কারণই নেই- হাসিনার মোসাহেবদের অথবা পুলিশ লীগের।।
পাকিস্তানের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে ক্ষতি বাংলাদেশেরই বেশী; একথাটা মাথায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের দেশ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই, কোন কালে ছিলও না। বাংলাদেশের যা ডেভেলাপমেন্ট তার সবটারই কৃতিত্ব শুধুমাত্র দেশের ব্যবসায়ীদের। সরকার শুধু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ট্যাক্সই নেয়; কোন সুবিধা কোনদিন দেয়না। দেশের মানুষ বিশেষত যারা পাকিস্তান কেন্দ্রিক ব্যবসায় করে- তাদের কথাটাও সরকার কোনদিন ভাবে না।
 
আগে কুটনীতি শিখতে হবে; তারপর খেলা।
বাংলাদেশ তো এখনও কুটনীতি শিখলোই না।
   Send article as PDF