অহংকার

আমার নিজের সম্পর্কে সকলের (বেশীর ভাগে মানুষের) একটা কমন কথা হলো- ‘আপনি অহংকারী’। এই কথাটা আমাকে এই জীবনে বহুবহুবার হজম করতে, এবং বেশ কয়েকবার বদহজমও হয়েছে।
 
না, আমি এটার উত্তর দিবো না।
সবাই তো অার অহংকারী নন, আমি একা অহংকারী হলে এমন কি ক্ষতি?
 
কিছু বিষয় মাথায় চলে আসলো- বলা দরকার।
ব্যস্ততার বাস্তবতায় লেখার সময় পাচ্ছিলাম না বেশ কয়েকদিন।
 
এই পৃথিবীতে একজন মানুষ মাত্র একবারের জন্যই আসে। আপনিও আমিও।
 
এই একটাই মাত্র জীবনে কি আর করা সম্ভব বলুন?
সত্তর ৮০ বৎসর আর এমন কি সময়?
অথচ সেই তুলনায় এই পৃথিবীটা বড্ড বেশী বড়।
 
এই পৃথিবীতে ‘দেড় লক্ষ মানুষের বসতিপূর্ণ’ শহরের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। আপনি যদি মাত্র এই ৩ হাজার শহরও জীবনে একদিন করে ঘুরে দেখতে চান; এবং প্রতি সপ্তাহে একটি করে শহর বেড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন- আপনার সময় লাগবে ৬০ বছর (বিষয়টা বাস্তবতা বর্হিভূত এবং অসম্ভব)।
 
বাদবাকী পৃথিবীর কথা আর না-ই বা তুললাম।
তাহলে একজন মানুষের পক্ষে কতটুকুই বা জ্ঞানার্জন করা সম্ভব, বলুন তো?
 
১৯৯৭ সালে আমি একটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম যে ২০৩০র মধ্যে আমি কম করে হলেও এই পৃথিবীর ১০০০ বড় শহর ঘুরে বেড়ানো শেষ করবো। কতগুলি সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ করবো- সেটাও চিন্তা করতাম। কতগুলি পাহাড়? নর্থ পোল, সাউথ পোল? আইল্যান্ডস?
 
সংখ্যাটা যে অনেক বেশী বড়- সেটা আমি তখনও বুঝতাম। গত ২০ বছরে এই সংখ্যাটা হয়তো ১০০ ছাড়িয়েছে- কিন্তু ১০০০ কি আদৌ সম্ভবপর? আমার মনে হয় না। খুব বেশী চেষ্টা করলে হয়তো ২০৪০’র মধ্যে ৫০০ পুরণ করতে পারবো।
 
শুধু ঘুরে বেড়াতে হলে ভিন্ন কথা ছিল- কিন্তু ‘রসদ’ যোগাবে কে?
 
আচ্ছা একজন মানুষ তার সারাটাদিন নিজে মনে মনে কি ভাবে?
কি ভাবনায় ডুবে থাকে? কি চিন্তা করে?
 
ভেবে দেখেছেন?
বিষয়টা কিন্তু বেশ মজার।
 
এই বিষয়ে আমি কোন পরিসংখ্যান বা গবেষনা দেখিনি।
তবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকের কাছেই কথার ছলে জানতে চেয়েছি। বোঝার চেষ্টা করেছি।
 
যে-বিষয়টা উঠে এসেছে তা হলো, নিজের ভবিষ্যত, বিয়ে, সংস্যার, পরবর্তী প্রজন্ম, শক্তিশালী অর্থনৈতিক সামর্থ অজর্নের লক্ষ্যমাত্রা- সম্ভব না হলে ভালো মতো পরিবার নিয়ে দিন চলে যাবে- এরকম হলেও চলবে। এই তো?
 
রাজনীতিবিদদের দেখেছি- ‘ক্ষমতা’র চেয়ার কেন্দ্রিক চিন্তা।
সংগে ক্ষমতায় যেতে পারলে কি কি অর্জন করতে পারবে সেটাও অবচেতন মনে সাজিয়ে নেয়া।
 
ভালো ষ্টুডেন্টরা চিন্তায় মশগুল থাকে বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবার। কেউ বা উকিল বা অন্য কোন পেশা নিয়ে।
 
আর বেশীরভাগদেরই দেখেছি- জীবনের শুরুতেই নিজেকে ব্যর্থ ভেবে বসে রয়েছে! দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত দিয়ে বাদবাকী জীবনটা সুন্দরভাবে পার করে দেবার চিন্তাই শেষ।
 
আবার কিছু মানুষকে এও দেখেছি- কিছুই করবে না; সারাক্ষন শুধুই চিন্তা কিভাবে প্রচারণায় থাকবে। কোন উদ্দেশ্য নেই, কাজ নেই, প্রয়োজন নেই কিন্তু প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিষ্টারের সংগে একটু দেখা করবো- দু’টো ছবি তুলবো; ব্যস বড় হয়ে গেলাম! কি অদ্ভুৎ চিন্তা!
 
প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে একটা ব্যানার নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা- যদিই কারো ক্যামেরায় ধরা পরা হয়!
 
এই ক্লাসটার দৈনতায় আমি খুবই করুণা বোধ করি। কিন্তু এদের সংখ্যাটা নেহায়েত খুব কমও না।
 
আপনি কি চিন্তা করেন? কমেন্টে একটু শেয়ার করেন- জানতে ভালো লাগবে, একটা গবেষনার মতোও হয়ে যাবে। সেখান থেকে শিখার মতো অনেক কিছুই হয়তো আমরা পেয়ে যাবো।
 
এবার আমার নিজের কথা বলি।
আমার জানার ক্ষুধা অসীম। প্রতিদিন নতুন নতুন কিছু না জানতে পারলে দিনটাই ব্যর্থ বলে মনে হয়। প্রতি মুহুর্তে জানতে চাই নতুন কিছু। যখন ইন্টারনেট ছিল না, ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত তখন বিভিন্ন বই-পত্রই ছিল আমার একমাত্র ভরষা।
 
পুরানা পল্টন মোড় আর নিলক্ষেতে গিয়ে পুরাতন বই কেনা ছিল আমার নেশা। কত কত রকমের পুরাতন বই যে কিনতাম তার কোন ইয়েত্তা নেই। ৫টাকায় অনেক ভালো ভালো বইও পাওয়া যেত।
 
আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যারের বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে মাঝে মধ্যে টুঁ মারতাম।
 
আর যখন ইন্টারনেট চলে আসলো, ইয়াহু দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম জ্ঞানের রাজ্যে পরে থাকার। এরপর গুগলের আগমন আমাকে আরও সহায়তা দিল। উইকিপিডিয়াও আসলো।
 
আর এখন তো সবই হাতের নাগালে। আর গত আড়াই বছর যাবৎ এমন এক ভুখন্ডে বসবাস করছি- যেখানে যা ইচ্ছে সবই পাওয়া যায়। এদেশে সবকিছুই যেন হাত বাড়িয়ে বসে রয়েছে আমারই অপেক্ষায়। বিশাল বিশাল লাইব্রেরী! ওহ কি যে অসাধারণ সব বই। অত পড়ার সময়ও তো পাই না। দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
 
যাই হোক, যা বলছিলাম।
আমার ভালো লাগার রাজ্য জুড়ে ছিল বিজ্ঞান, সাহিত্য, কবিতা, ধর্ম এবং দর্শন। সংগে ভুগোল। মহাবিশ্ব। বিশ্ব ব্যবস্থাপনা। রাজনীতি।
 
একটা পর্যায়ে মনে হলো- শুধুমাত্র বই পড়ে যা শিখা হয় সেটা স্রেফ শিখাই হয়। শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হলে বাস্তবতায় নিজেকে নিয়ে যেতে হবে। শুধু শিক্ষা নিয়ে বসে থাকলে প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া সম্ভব না।
 
আশির দশকে আমরা কাজী অানোয়ার হোসেনের সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত (অনুবাদ) ওয়েষ্টার্ণ বইগুলি পড়তাম। সে এক অদ্ভুৎ আনন্দ, উত্তেজনা, শিহরণ। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন কালচারকে জানার আগ্রহ বাড়তি উত্তেজনা দিত রক্তে।
 
ঐ সময়টাতেই বিটিভিতে দেশী অনুষ্ঠান বলতে ছিল কয়েকটা গানের অনুষ্ঠান আর সাপ্তাহিক নাটক। বলতে গেলে পুরোটা সময় জুড়্ই দেখানো হতে ওয়েষ্টার্ণ মুভিগুলি। ইংরেজীতেই।
 
টারজান, রোবোকপ, ম্যাকগাইভার এসব আমাদের কিশোর মনের উত্তেজনায় সদা জাগ্রত হয়ে থাকতো।
 
কিন্তু এসবের পাশাপাশি কিছু কিছু ওয়েষ্টার্ণ মুভিতে টেক্সাস বা আরিজোনার প্রত্যন্ত মরুভূমি, সিকাগো, ডালাসের মতো শহুরে জীবনের মুহুর্তগুলিও বাড়তি শিহরণ জোগাতো। গাড়ী নিয়ে পুলিশকে দেখতাম আসামীকে ধরতে ছুটে চলছে রাস্তার সিগন্যাল অমান্য করে।
 
তখন সে কি উত্তেজনা। কি চরম শিহরণ রক্তের লৌহিত কনিকায়। আর আজ এখন এই নিউ ইয়র্কে যখন মাঝে মধ্যেই সেই ‘একই দৃশ্যটি’ বাস্তবে দেখি; আমার সামনে দিয়ে এনওয়াইপিডি’র সাদা ছোট প্রাইভেট কারটি ঝড়ের বেগে ট্রাফিক অমান্য করে ডান-বাম অলি গলি দিয়ে শো-শো সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলছে কোন সন্ত্রাসী বা আসামী কে ধরতে, এই নিজের চোখেই; ওহ, সে এক ভয়ংকর উত্তেজনা।
 
সেই কৈশর আজ আমার বাস্তবতায় হাজির।
সত্যিই, আমার এ আনন্দ আমি একাই অনুভব করি।
 
কৈশরের দেখা আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া সেই বিমানগুলি যা আজও উড়ে যায় নিয়মিতই। কৈশরের পড়া নীল আর্মষ্ট্রং এর চাদের মাটিতে পা রাখার ‘গল্প’; আবার একই সংগে কিছু সাইন্স ফিকশন- সব মিলিয়ে অন্য আনন্দ।
 
আবার এখন যখন আমি ওয়াশিংটন ডিসির ‘ন্যাশনাল এয়ার এন্ড স্পেস মিউজিয়াম’ এ গিয়ে প্রথম আবিস্কৃত হওয়া রাইট ব্রাদার্সের সেই হালকা বিমানটি-ই দেখতে পাই, চাদে যাওয়া সেই রকেট (এপোলো) এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশগুলি চোখের সামনে বাস্তবে দেখি- তখন সত্যিই মনে হয় এটাই তো আমার অদেখা পৃথিবীর বাস্তব রূপ।
 
আমার আনন্দগুলি সত্যিই কেউ দেখতে পায় না।
শুধু আমি নিজে দেখি। অভিভূত হই।
 
আমাদের দেশের মানুষরা আগে ঘুড়তে যাওয়া বলতে বুঝতো ইন্ডিয়া যাওয়া, আর ইদানিং যুক্ত হয়েছে থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া। অথচ প্রকৃত টুরিষ্ট চোখের তৃষ্ণা মিটাতে দেখার মতো দেশ পরে রয়েছে বিশাল চায়না- সেটা অনেকেই জানেই না। চায়নাতে রয়েছে ‘ভাষা ও খাবার’ এর সমস্যা। ঐ ভয়ে কেউ ওদিকে পা মারায় না। সাহস পায় না।
 
ঢাকা থেকে মাত্র দুই ঘন্টার উড়ানে ইউনান প্রভিন্সের কুনমিং একটা অসাধারণ শহর। চির বসন্তের ঐ শহরে রয়েছে এই বিশ্বের একমাত্র ‘ষ্টোন ফরেষ্ট’টি। পাথরেরও যে বন-জংগল হতে পারে এবং সেই জংগল কতটা চোখ জুড়াতে পারে- সেটা যদি আপনি নিজের চোখে একবার না-ই দেখলেন তাহলে আপনার এই জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার কোনই মানে হয় না।
 
তিন হাজার বছর আগে বেইজিং কে মঙ্গোলিয়ান দুস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তৈরী হয়েছিল ‘গ্রট ওয়াল’। সেটাও দেখবেন না? আজকের আমেরিকায় এসে নাসা আবিস্কার দেখার চেয়ে বেশী জরুরী আপনাকে চিনের প্রাচীর দেখা।
 
নইলে মানুষ যে কতটা শক্তিশালী হতে পারে- সেটা তো জানতেই পারবেন না।
 
আর আপনি যতক্ষন না জানবেন যে একজন মানুষ সংবদ্ধভাবে মহাশক্তিশালী ততক্ষন পর্যন্ত তো আপনি আপনার নিজেকেই আবিস্কার করতে পারবেন না।
 
কিছু মানুষের সস্তা মাথায় চিন্তা ভর করে, ‘মানুষ কি সত্যিই চাঁদে গিয়েছিল?’ বিতর্ক জাগিয়ে দিয়ে ভুতুরে আনন্দ খুঁজে, নিজেকে চিন্তার বাহাদুর দেখায়!
 
সেই মানুষকে আমি একবার গ্রেট ওয়াল ভ্রমণ করে দেখে আসতে বলবো। তারপর তাকে প্রশ্ন করবো- মানুষ কি সত্যিই গ্রেট ওয়াল তৈরী করেছিল কোন কালে?
 
৩ হাজার বছর আগে যদি গ্রেট ওয়াল করা সম্ভব হয়, তাহলে মাত্র ৫০ বছর আগে মানুষ চাদে যাবে- এটাই তো হবার কথা।
 
এই বিশাল সৃষ্টিজগতে আপনি একজন মানুষ।
এটাই আপনার প্রথম এবং সবচে বড় যোগ্যতা।
আপনি আপনার এই যোগ্যতার সমান শক্তিশালী।
 
সেই ৩ হাজার বছর আগে গ্রেট ওয়াল বানানো সম্ভব হয়েছিল বলেই আজ ইন্টারনেট বানানো সম্ভব হয়েছে।
 
ইন্টারনেটটা গ্রেটওয়ালে চেয়েও লাখোগুন জটিল। বিষয়গুলি সম্পর্কে কিছু জ্ঞান থাকা সকলের জন্যই জরুরী। আপনার যদি দু’টি কমপিউটার থাকে এবং সেই দুই বা তারচে বেশী থাকা কমপিউটাকে যদি আপনি একই সংগে ব্যবহার করতে চান বা করেন- তাহলে সেটা হবে ‘নেটওয়ার্ক’। ধরুন আপনার একটা নিজস্ব নেটওয়ার্ক রয়েছে এবং আমারও অনুরুপ একটা নেটওয়ার্ক রয়েছে; এবার আমরা দুই জনের এই ভিন্ন ভিন্ন নেটওয়ার্ককে সংযুক্ত করে এক করে ফেললাম- এটাই তখন হয়ে গেল ইন্টারনেট।
 
আর এখন আজ এই মুহুর্তে আপনার কমপিউটার বা হাতের স্মার্ট ফোনটিও ইন্টারনেটের অংশ; আর তাইতো আপনি ফেসবুকে আপনার সেলফোন থেকে একটা স্ট্যাটাস বা ছবি আপলোড করলে আমিও সেটা দেখতে পাই।
 
এসবই এখন বাস্তবতা।
চিন্তাটা খুবই সাধারণ কিন্তু বাস্তবায়নটা ছিল অসাধারণ।
 
এখানে আরও অনেক কথাই বলা যায়, কিন্তু আমি আসলে খুব সুক্ষভাবে আমার দৈনিন্দন সময়ে করা ‘চিন্তাগুলি’ আপনাদের সংগে শেয়ার করলাম।
 
সারাক্ষন আমি কি ভাবি- তাই বললাম।
 
আমার সংগে আপনার মিলবে না।
আমরা সেভেন বিলিয়ন মানুষ এবং সেভেন বিলিয়ন ভিন্নভিন্ন চিন্তা ভাবনা।
 
একজনের সংগে অন্যজনেরটা মিলবে কেন?
 
আমার লেখালেখিতে আমার চিন্তার ছাপ পরে। পরবেই তো।
আমার কথাবার্তায়ও আমার চিন্তার ছাপ পরে। অবশ্যই পরবে।
 
এরপর আপনি যদি আমাকে অভিযোগ দেন ‘আপনি অহংকারী’- আমি মাথা পেতে তা মেনে নিই।
 
কি আর করার রয়েছে বলুন।
আমার তো মনে হয়ে অহংকার-ই ভালো।
 
আপনিও অহংকারী হোন, ভালো থাকার মতো কিছু একটা তো খুঁজে পাবেন।
 
   Send article as PDF