হে দারিদ্র্য!

যখন বাংলাদেশে থাকতাম সেই তখন থেকেই আমেরিকানদের জীবন-জীবিকা নিয়ে ভাবনাগুলি আমাকে তাড়িত করতো।
 
তার মধ্যে একটা বিষয় আমি বুঝতামই না।
আমেরিকান ওয়েব সাইটগুলিতে যখন কোন কিছু খুঁজতে বা কোন একাউন্ট সাইনআপ করতে যেতাম তখনই দেখতাম ‘ড্রাইভার লাইসন্স’ ষ্টেট ও নাম্বারটা চাওয়া হতো।
 
আমি অবাক হতাম এজন্য যে, ওদেশের তাহলে কি সকলেরই ড্রাইভার লাইসেন্স রয়েছে? কি এমন একটা দেশ যে সেখানে সকলেরই ড্রাইভার লাইসেন্স থাকে বা সকলেই কার ড্রাইভ করতে জানে!
 
সেই ভাবনাটাকে কাধে ভর করেই একদিন জেএফকে’তে ল্যান্ড করি।
নিউ ইয়র্কের পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন সিষ্টেম অত্যন্ত উন্নতমানের। ১৩২ ডলারের একটা মান্থলি মেট্রোকার্ডে পুরো নিউ ইয়র্ক সিটির যেখানে খুশী আপনি যেতে পারবেন, যতবার খুশি ‘রাইড’ নিতে পারবেন সেটা হোক ট্রেন বা বাস বা উভয়টাতেই।
 
সুতরাং এখানে ড্রাইভার লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তা ততটা বুঝিনি।
কিন্তু আমেরিকাকে দেখার আশা নিয়ে আমি মাস তিনেক টেক্সাসের ডালাসে বসবাস করেছি। এবং ঠিক তখনই বুঝেছি- এদেশে যে ড্রাইভিং জানে না সে আসলে ‘অচল মানুষ’। সুতরাং আমেরিকাতে সকলেই ড্রাইভার- উত্তরটা পেয়ে গেলাম।
 
আরও সহজ করে বোঝাবো?
যেমন ধরুন বাংলাদেশের যে-কোন শহর বা গ্রামে আপনি বাড়ী থেকে বের হলেই হাতের কাছেই পেয়ে যাচ্ছে ছোট বা বড় বাজার; আর যদি ধারে কাছে কোন বাজারই না থাকে- তাতেও সমস্যা নেই; প্রতিটি গ্রামেই পাবেন বেশ কয়েকটা মুদি দোকান। এবং সেটা ৫-দশ মিনিটের হাঁটা পথেই।
 
অর্থাৎ আমাদের দেশটার ডিজাইনই এমন যে ৫-দশ মিনিটের হাঁটা পথেই দোকান-ঘাট পাওয়া সম্ভব।
 
কিন্তু আমেরিকায়?
আমার তো তখন ড্রাইভার লাইসেন্স বা গাড়ী ছিল না। বাজারের জন্য আমাকে যেতে হতো ওয়ালমার্ট বা কুগারে। আমার বাসা থেকে সবচে কাছের কুগার’টির দূরত্ব ছিল দুই মাইল আর কাছের ওয়ালমার্ট টি ছিল আড়াই মাইল দূরে। অর্থাৎ প্রতিবার আমাকে ৪ থেকে ৫ মাইল রাস্তা হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হতো বাজার-সদাই এর জন্য।
 
কারণ, আমেরিকা তার দেশটি ‘আমার মতো একজন হাদারাম’ এর জন্য ডিজাইন করেনি। তারা মাথায় এমন চিন্তা নিয়েই আজকের আমেরিকা তৈরী করেছে- যেখানে সকলেরই গাড়ী থাকবে, সকলেই ড্রাইভিং জানবে।
 
বাংলাদেশে থাকতে ড্রাইভিংটা কেন শিখলাম না- সেজন্য অনেকদিন নিজের চুল টেনে ছিড়েছি- জাতি হিসাবে এতোটা বোকা কেন আমরা?
 
একজন মানুষের জীবনটাকে সহজ করার জন্য আমি দু’টি পরামর্শ দিবো।
 
১) বারো বছরের একটা হাই স্কুল সার্টিফিকেট এবং ইংলিশের উপর যথেষ্ঠ দখল থাকতে হবে।
 
আর ২) আপনাকে ড্রাইভিং জানতে হবে; এটা বাধ্যতামূলক। সংগে যদি ‘ওয়েল্ডার’ বা ‘কুক’ এর কাজ জানা থাকে- তাহলে আপনি হতে পারবেন এই পৃথিবীর রাজা।
 
রাজা মানে সম্রাট।
পুরো পৃথিবীতেই আজ ওয়েল্ডার এবং কুকদের দাপট। এরাই সৎভাবে সবেচ বেশী টাকা আয় করতে পারে। ওয়েল্ডিং, কুক এর বাইরেও আরোও অনেক কাজ রয়েছে- আপনি প্লাম্বিং শিখতে পারেন, ইলেকট্রিক টেকনেশিয়ান ইত্যাদি যা কিছু ইচ্ছে তাও হতে পারেন। বিষয়টা একই, একটা হাতের কাজ খুব ভালোভাবে শিখে নেয়া।
 
বলুন তো, হাই স্কুল সার্টিফিকেট, ড্রাইভিং আর কুক বা ওয়েল্ডিং জানাটা কি খুবই কষ্টের কিছু?
 
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে এই মাত্র এক লাইনের পরামর্শটি কে দিবে?
 
এই দেশের প্রতিটি বাবা-মা’ই চান তাদের সন্তানটি হবে ডাক্তার বা বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার; না হতে পারলে ন্যূনতম পক্ষে টেবিল-চেয়ারে বসা একজন অফিসার হবে।
 
বাবা-মা’দের নিজেদের সন্তাদের নিয়ে এই সস্তা বায়নাটাই একটা দেশকে আজ ধ্বংশ করে দিয়েছে। যে ছেলেটির ভেতরে প্রতিভা রয়েছে সে হবে একজন শিল্পী, তাকে দেয়া হচ্ছে রসায়ন বা অংকের মতো জটিল বিষয়। যে হতে পারবে একজন দক্ষ প্রোগ্রামার তাকে বলা হচ্ছে একাউন্টিং পড়!
 
আপনার সন্তানটি ঠিক ‘যা’- তাকে ‘তা’ হতে দেয়া হচ্ছে না।
এটা যে একটা জুলুম, একটা অন্যায়, একটা প্রতিভাকে হত্যা করার মতো অপরাধ- সেটাও আপনি জানেন না।
 
মানুষ গরীব হয় একটি কারণে।
আর সেটা হলো, ‘আলস্য এবং মেধার অভাব বা সুযোগহীনতা।’
 
আমরা অলস জাতি। আলস্যের মূল কারণ আমাদের ভৌগলিক অবস্থান। এখানে নাতিশিতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজমান। খুব বেশী গরমও না খুব ভয়ানক শীতও না। ইওরোপ, উত্তর আমেরিকা, চায়না, রাশিয়া বা জাপানের শীতের সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের ধারণা নেই বললেই চলে।
 
ছবিতে তুষারপাত দেখার সৌন্দর্য উপভোগ আর সেই তুষার পাতের মধ্যে বসবাস করে জীবন পাড় করা এক বিষয় নয়।
 
এক মিনিট শরীরের কোন একটা অংশ খোলা থাকলে প্রচন্ড শীতে সেই অংশটি জমে বরফ হয়ে যায় ঐ শীতের প্রকপে। ওরম শীত যদি বাংলাদেশে মাত্র ২ ঘন্টার জন্য একবার অনুভূত হয় তাহলে ঐ ২ ঘন্টায় ১৭ কোটির মধ্যে ১৫ কোটি মানুষই মারা যাবে- কোন সন্দেহ নেই।
 
আর এরা এই ভয়াবহতম শীতকেও আজ জয় করেছে।
প্রকৃতিকে বশ করতে আলস্য ভাংতে হয়। বাংলাদেশে যেহেতু প্রকৃতি বিরূপ-ই নয়, সেহেতু তাদের আলস্য ভাংগারও কেউ নেই।
 
একটা লুংগি আর একটা শার্ট হলেই এদের পোষাক হয়ে যায়, শুধুমাত্র বাকী থাকে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের। সামান্য ভাতের জন্য আর কতটুকুই বা পরিশ্রমের দরকার?
 
এমনি এমনিতেই যদি চলে- তাহলে আর পরিশ্রম করার কোন দরকার রয়েছে?
 
বাংলাদেশের মানুষ কি অত বোকা নাকি যে পরিশ্রম করবে- সবকিছু তো চলছেই।
 
এতো গেল মানুষের কথা।
বাংলাদেশের সরকারগুলির চিন্তা থাকে দেশের মানুষকে ‘বোকা’ বানিয়ে রাখতে হবে- তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে দেয়া যাবে না। এরা বুদ্ধিমান হয়ে উঠলে হাসিনা-খালেদা’রা এদের শাসন করার সুযোগ হারাবে।
 
সুতরাং, যত রকমের বুদ্ধি রয়েছে সরকার বাহাদুর তার প্রয়োগ চালায় দেশবাসীকে ‘বাদুর’ বানিয়ে রাখতে, রাখেও।
 
একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে শেষ করবো।
বাংলাদেশের মোটামুটি ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করছে।
 
কিন্তু আপনি পুরো দেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটা ‘গরীব খৃষ্টান পরিবার’ পাবেন না।
 
কেন?
কারণ, তাদের মধ্যে রয়েছে ‘সুদৃঢ় একতাবদ্ধ অংগীকারনামা’।
এরা একজন অপরজনের উন্নতি দেখতে ভালোবাসে। সকলে মিলে ভালো থাকতে চায়। একটি পরিবার দরিদ্র হয়ে পরলে বাকীরা মিলে সম্মিলিতভাবে সাহায্য করে তাদের টেনে তুলে উপরে উঠায়।
 
এই ‘পারস্পারিক সহযোগীতা’টুকু আপনি বাংলাদেশের মুসলিম বা হিন্দুদের মধ্যে দেখবেন না; তাদের এই বোধটুকু নেই।
 
তবে, এই পারস্পারিক সহযোগীতার বোধটুকু শতভাগ কাজ করে ইহুদী কমিউনিটিতে। তারা যে কোন বিষয়ে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে। আর তাদের এই একতাবদ্ধতার কারণেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাত্র দেড় কোটি ইহুদী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো বিশ্বকে।
 
বাংলাদেশে আপনি লক্ষ্য করবেন- আপনি যদি দরিদ্র হন, আপনার ‘বড়লোক’ আত্মিয়ের কাছে গেলে সে আপনার ৫০০ বা হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। ওটা আসলে কোন সাহায্য না, আপনাকে আরও নীচে নামানোর একটা পায়তারা। সে আপনাকে বড় হবার কোন রাস্তা বাতলে দিবে না কোন কালেও (ভয়, আপনি তাকে ছাড়িয়ে উপরে উঠে যান!)।
 
আর ইহুদী পরিবারগুলি দরিদ্রদের প্রয়োজনীয় ট্রেনিং, ঘুড়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় আর্তিক ও সার্বিক সহযোগীতা দিয়ে থাকে; খৃষ্টানরাও এই বিষয়টাকে ফলো করে থাকে।
 
কিন্তু আপনি মুসলিম বা হিন্দুদের মধ্যে তা পাবেন না।
এদের কে আপনি পাবেন শুধুই বিভক্তি উসকে দিতে। মিলাদ দাঁড়িয়ে পড়বে না বসে পড়বে সেটা নিয়ে প্রয়োজনে শহীদ হয়ে যাবে ৫-দশজন। বড়জনকে ছোট জন সালাম কেন আগে দিল না সেটা নিয়ে শুরু হবে তুমুল বিতর্ক। তারাবীহ ৮ রাকাত পড়বেন না ২০ রাকাত পড়বেন; হযরত উমর (রা) তারাবীহের নামাজ ঠিক করে দেবার কে- এসব নিয়ে অন্তহীন তর্কা-তর্কিতে এগিয়ে থাকবে মুসলিমরা।
 
আর বাংলাদেশের সরকারও ঠিক তাই-ই চায়।
এভাবেই চলুক। ধ্বংশ হোক দেশ- নইলে তারা রাজা থাকবে কিভাবে?
 
আপনার ঘাড়ে বসে খাবার রাস্তা বন্ধ করা মানে তো নিজের ক্ষতি করা।
 
নিজের ক্ষতি কে করতে চায়, শুনি?
   Send article as PDF