গুলতেকিন

হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের বা বাঙালীর ইতিহাসের সবচে জনপ্রিয় মানুষটির নাম। আমাদের কৈশরে দেখা প্রথম মজার নাটকটি ছিল ‘এই সব দিনরাত্রি’ যেটার লেখক ছিলেন এই মহান মানুষটি।

তারপর থেকেই মুখে মুখে হুমায়ূন আহমেদ নামটি উচ্চারিত হতো। বিটিভিতে হুমায়ুন আহমেদ এর নাটক মানেই দেশব্যাপী বিরাট এক উৎসব যেন।

আরও ১-দুই বছর পর তার লেখা বইয়ের খোঁজ পেলাম, মহাউৎসাহে একটার পর একটা বই পড়তে শুরু করলাম। হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা একটা বইও আমি মিস করিনি। অনেকগুলোই পড়েছি একাধিকবার, এখনও পড়ি। ঢাকায় আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে ওনার অনেকগুলো বই সংগ্রহে ছিল। নিউ ইয়র্কে, এখানেও তার লেখা বেশকিছু বই সংগ্রহ করতে পেরেছি বা সুযোগ পেলেই সংগ্রহ করি।

হুমায়ূন আহমেদ এর কিছু অবজারভেশনে অনেক ভুল ছিল। যেমন, হুমায়ুন আহমেদ এর কাছে সেই ছোট বেলায় জেনেছিলাম যে আমেরিকানরা সকলকে ‘লাষ্ট নেইম’ ধরে ডাকে- এটা অনেক বড় একটা তথ্যগত ভুল। আমেরিকানরা অফিসিয়াল ডকিউমেন্টে ‘লাষ্ট নেইম’টাকে আগে লিখে; কিন্তু কথা বলার সময় অফিসিয়াল, ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক সম্পর্কেও ‘ফাষ্ট নেইম’ ধরেই ডাকে। তারা কথা বলার সময় প্রথমেই জিজ্ঞেস করে ‘তোমার ফাষ্ট নেইম কি?’ এবং সেই নাম ধরেই সম্মোধন করে।

হুমায়ূন আহমেদ এর দ্বিতীয় ভুলটি ছিল, তিনি বলেছিলেন আমেরিকানরা ইচ্ছে করেই অন্য দেশীয়দের ভুল-ভাল উচ্চারণে (প্রনাংসিনেশন) ডাকে; যিমন হুমায়ুন আহমেদ কে নাি ডাকতেন ‘হামায়ন’ বা ইত্যাদি নামে। এটাও তার বড় রকমের ভুল ছিল। আমেরিকানদের বিগত ৫ বছরে একটি বিষয় আমি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে খেয়াল করে দেখেছি যে এরা কখনওই ভুল নামে বা ভুল উচ্চারণে ডাকতে আগ্রহী নন বা ডেকে স্বাচ্ছন্ন বোধ করেন না। তারা ‘ফাষ্ট নেইম’ জিজ্ঞেস করার পরপরই নামের উচ্চারণ বা প্রনাংসিনেশন জানতে চান। একাধিকবার উচ্চারণ ঠিক করে তারপর তারা আনুষ্ঠানিক কথা বলা শুরু করেন।

ড. হুমায়ুন আহমেদ কেন এরম ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছেন- সেটা আমার চিন্তায় আসে না। তিনি দাঁড়ি-টুপিওয়ালা হুজুরদের সকলকেই ‘মাওলানা’ বলে তার প্রতিটি বইয়ে উল্লেখ করতেন; অথচ ড. হুমায়ুন আহমেদ ‘মাওলানা’ কাদের বলা হয়- সেটা জানতেন না, এটা আমি মানতে রাজী নই। সকলেই যেমন নামের আগে ‘ডক্টর’ ব্যবহার করতে পারেন না, তেমনি সকলেই ইচ্ছে করলেই তাদের নামের আগে ‘মাওলানা’ও ব্যবহার করতে পারেন না।

হতে পারে অতি ব্যস্ত মানুষ, অনেক কিছুই তার অভজারভেশনে ঠিক মতো আসে নি। বাংলাদেশের উচ্চারণ যেমন বিদেশীরা ‘ব্যাংলাদেশ’ বলে থাকে- তার কারণ ‘BANGLADESH’ বানানের মধ্যেই; তাদের উচ্চারণের সমস্যা নয়। বাংলাদেশটা ইংলিশে ‘BAANGLADESH’ লিখলেই কিন্তু সবসমস্যার সমাধান মিটে যেতো- কিন্তু সেটা করা হয়নি, যদিও ঢাকার (DACCA) বানার সংশোধন করা (DHAKA) হয়েছিল ঠিকই।

যাই হোক, এবার আরও একটি বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করি। ভদ্রলোক গুলতেকিনকে ডিভোর্স দিয়ে শাওনকে বিয়ে করেছিলেন। বিষয়টি তার পাঠকদের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। আমার নিজেরও প্রথমদিকে বিষয়টা নিন্দনীয়ই মনে হয়েছিল; কিন্তু আমি হুমায়ূন আহমেদ এর মতো একজন মানুষ- যে কিনা মিসির আলীর মতো একটা চরিত্রের সৃষ্টিকর্তা- তার দ্বারা কোন অযৌক্তিক কাজ হতে পারে তা ডে-ওয়ান থেকেই বিশ্বাস করিনি।

এবং, ঠিক ঐ সময়েই হুমায়ূন আহমেদ- তার ব্যক্তিগত জীবনের ‘এই বিষয়টি’ নিয়ে একটি খুব ছোট লেখা প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘নিজের ষ্টেটমেন্ট’ হিসাবেই অনেকটা লিখেছিলেন। সেখানে তিনি ‘অত্যন্ত সুন্দরভাবে’ গুলতেকিনকে কোন দোষ বা গুণ না দিয়েই চমৎকার সমাধান দিয়েছিলেন যদিও তা ছিল অনেকটাই অস্পষ্ট। তিনি অনুরোধের স্বরে একটা লাইনও সেখানে লিখেছিলেন (কথাটা ছিল অনেকটা এই রকম), কেউ যেন গুলতেকিন’কে এ বিষয়টা নিয়ে বিব্রতকর কোন আলোচনায় না টানেন; তবে তাকে (হুয়ায়ূন আহমেদ) নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করলে তিনি মাইন্ড করবেন না- কারণ তিনি ‘হুমায়ূন আহমেদ’।

ওনি মানুষ হিসাবে কতটা উচ্চতায় ছিলেন- আমি সেদিন তার ওই লেখাতেই বুঝে নিয়েছিলাম।

আমি এবং আমার সংগে তার আরও অগণিত অথবা কোটি কোটি পাঠকও জানতেন যে, হুমায়ূন আহমেদ এর জীবনে শাওন ‘ইন’ হয়েই গুলতেকিন কে ‘আউট’ করেছিলেন। আর এজন্যই ‘আমরা’ হুমায়ূন আহমেদকে দোষী সাজিয়ে মজা লুটতে চেতাম বা চেয়েছি।

হুমায়ূন আহমেদ মারা গেলেন।

তারও বছর দু’য়েক পরে শাওন এর একটি টিভি সাক্ষাৎকার (চ্যানেল আই এর তৃতীয় মাত্রা) দেখলাম এবং সেখানে জানলাম যে হুমায়ূন আহমেদ গুলতেকিনকে ডিভোর্স দেবারও প্রায় ৪/৫ বছর আগে থেকেই আলাদাভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে (সেপারেটেড জীবন-যাপন) বসবাস করে আসছিলেন। কার্যত তাদের মধ্যে কাগজের রিলেশন ছাড়া অন্য কোন কিছু্ ছিল না দীর্ঘ কয়েক বছর।

এবং এরই এক পর্যায়ে হুমায়ূন আহমেদ গুলতেকিনকে ডিভোর্স দেন।
এবং ডিভোর্সের সেই সময়ের কিছু আগেই শাওন ‘সিংগেল হুমায়ূন আহমেদ’ এর জীবনে প্রবেশ করেন তার যোগ্যতা দিয়েই।

অর্থাৎ গুলতেকিন এর আউট এর পেছনে শাওন ইন এর কোন যুক্তি নেই।

আমি শাওনের কথাগুলি শতভাগ বিশ্বাস করিনি সেদিন।
কিন্তু যেদিন ঠিক এই একই রকমের একটা লেখা হুমায়ূন-গুলতেকিন তনয় ‘নুহাশ আহমেদ’ এর লেখা থেকে জানতে পারলাম- সেদিনই নিশ্চিত হয়েছিলাম শাওন কোন মিথ্যা কথা বলেননি।

অপরদিকে আমি এটা কৌতুহল নিয়েই খুঁজতেছিলাম সত্যিকারার্থে গুলতেকিন এর সংগে হুমায়ূন আহমদে এর রিলেশন ব্যর্থ হবার কারণটা। এবং এর উত্তরটা গুলতেকিন সেদিন তার সাক্ষাৎকার এ নিজে থেকেই দিয়ে দিয়েছেন। তিনি যখন খুব উৎসাহ নিয়ে বলে দিলেন যে, তিনি ‘ওমুকের’ নাতনী- ঠিক তখনই আমি ধরে ফেলেছিলাম এই ভদ্র মহিলা ‘কি টাইপ’ মহিলা ছিলেন! তিনি যতটা না হুমায়ূন আহমেদ এর স্ত্রী ছিলেন তরচে অনেক বেশী ছিলেন ড. ইব্রাহীম না কার যেন নাতনী! অর্থাৎ তার নিজ স্বামীর অবস্থান তার কাছে কোনদিনই উচ্চু ছিল না।

‘আত্ম-অহংকারী’ কোন মহিলাই কোন পরিবারের জন্যই স্ত্রী বা বউ হিসাব সৎ বা সুন্দর হয় না। এবং ঐ পরিবারের ধ্বংশ অনিবার্য।

আর আমাদের বাংলাদেশে এরূপ ‘আত্ম-অহংকারী’ মহিলাদের সংখ্যা যথেষ্ঠ কম নয়। হয় এরা তার নিজের রূপ নিয়ে আত্ম-অহংকারে কাটায় অথবা তার বাবার বা নানার পরিবারকে নিয়ে আত্ম-অহংকার এর নিন্মজ্জিত থাকে। এবং একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে এরা বাস্তবে অতটা সুন্দরীও হয় না। কিন্তু এদের অহংকারের সীমা থাকে না। এবং এই মহিলাগুলি-ই তাদের স্বামী এবং স্বামীর পরিবারকে সব-সময় অযথা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল্য করে এক ধরণের ‘বিকৃত আনন্দ’ উপভোগ করে থাকে।

পরিণামে হুমায়ূন আহমেদ এর মতো উন্নত মানুষগুলির জীবনও দুর্বিসহ করে তোলে। আর, হুমায়ূন আহমেদ এর মতো মানুষরা কোনদিন কারো কাছে ‘এসব অতি ব্যক্তিগত’ বিষয়গুলি শেয়ার করতেও পারে না; চিৎকার করে কাঁদতেও পারে না। আর তখনই তারা হয়তো বাধ্য হয় আলাদা বসবাস করতে অথবা বিকল্পর খোঁজে।

আর যেহেতু বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষ শুধু খায় আর ঘুমায়, কোন কাজ করে না; তাদের অফুরন্ত সময় থাকে অন্যের সমালোচনা করে আনন্দ নেবার। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে ঠিক এরকম সমস্যার সৃস্টি না হলে এই মানুষগুলিও কোনদিন বুঝেও না হুমায়ূন আহমেদ এর কষ্টগুলি কোথায়।

   Send article as PDF