পুরান গল্প ০২

কেলি-সুংওয়ান জানে যে আমার দেশে আমার পরিবার রয়েছে।রয়েছেন আমার বাবা, মা, নীলিমা আর ছোট্ট দুই কন্যা মনোরী ও ঊণয়। ঊনয়ের বয়স তো আমি রেখে এসেছি মাত্র ২ বছরে। মনোরীর ৪। আমার ঠাকুরদাও যথেষ্ঠ বয়স হওয়া সত্বেও সুস্থসবল মানুষ।
সুওয়ানের আজ মন খারাপ। খুব আস্তে আস্তে বলল, ‘তুমি চলে যাবে কেন? এখানে কি তোমার কিছু অসুবিধে হচ্ছে। বিদেশী হয়েও কত সম্মান তোমার এখানে, আমরা রয়েছি। তারপরও কেন তোমাকে চলে যেতে হবে আমাদের ছেড়ে?’

আমি হেসে দিলাম। সুওয়ানের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলাম। বললাম, ‘দেখ সুওয়ান, আমি তে যাযাবর একজন মানুষ। এক জায়গাতে আমার বেশীদিন থাকতে ভালো লাগে না। আমার ইচ্ছে করে আমি ঘুড়ে দেখি এই মহাবিশ্বকে। আফ্রিকার কালো, ইওরোপের সাদা মানুষদের সংগেও মিশতে ইচ্ছে করে আমার। হোয়াং হো নদীর জল আমাকে যেমন টানে ঠিক তেমনি দেখতে ইচ্ছে করে নীল নদের জলও। একটি মাত্র জায়গায় আমাকে ঠিক মানায় না। চলে আমাকে যেতেই হবে যে!’

সুওয়ানের চোখের জল আমাকে কষ্ট দেয়। আমার বাম হাতটা সুওয়ান তার দু’হাত দিয়ে ধরে ফেলে আলতো করে, ‘তুমি আমাকেও সাথে করে নিয়ে যাও না; তোমার সংগে আমি গেলে তোমার কি এমন আর ক্ষতি হবে বলো?’

সুওয়ানের আবেগ আমি বুঝতে পারি। কিন্তু যে কিছুই করার নেই। কোথাও বন্দি হয়ে যে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না। মনোরী, ঊণয় আর নীলিমার কথা খুব মনে পরে। বৃদ্ধ ঠাকুরদার মুখটিও ভেসে উঠে চোখের সামনে বার বার। আমাকে যে ফিরে যেতেই হবে। আমার বাবা, আমার মা কতদিন পথ চেয়ে বসে আসেন আমার ফিরে যাওয়া দেখতে। কোন যোগাযোগ নেই আমার কারোর সংগে। কোন একটা উপায় যদি থাকতো তাদের সংগে নিয়মিত যোগাযোগ করার। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব। আজ রওয়ানা দিলেও চার থেকে ৫ মাস সময় লাগবে পৌছতে। ওহ, ভাবতে পারি না সে কথা। ওদিকে সম্রাট লি শিমিনের কাছে খবর এসেছে টাং সাম্রাজ্যের অধীন লিয়াংগুয়াং অঞ্চলে বিশ্বের বিভন্ন এলাকা থেকে শতশত আগুন্তক দিয়ে ভরে যাচ্ছে। দ্রুত বর্ধনশীল নগরে পরিণত হচ্ছে লিয়াংগুয়ান। সেখানে পাঠশালায় উপযুক্ত শিক্ষক সংকট দেখা দিয়েছে। মালয়, ভারতীয়, আরাবিয়রা জাহাজে করে পণ্য নিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত, সেই সংগে অনেকেই ওখানে বাড়ী ঘড় করে থেকেও যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সম্রাট লি শিমিনকে বেশ চিন্তিত দেখা যাচ্ছে।
সম্রাট সরেজমিনে লিয়াংগুয়ান ভ্রমনে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিশাল রাজকীয় সফর। আমাকে নির্দেশ দেয়া হলো এই দলের সংগে লিয়াংগুয়ান যেতে হবে। টাং সম্রাটের নির্দেশ, অমান্য করার কোন জো নেই আমার। টানা প্রায় ২ মাসের ভ্রমণ। শীত কাল আসার অগেই আমাদে পৌছে যেতে হবে লিয়াংগুয়ান। আমার দুর্ধর্ষ ঘোড়াটিতে করেই আমি রাজকীয় দলের সংগে রওয়ানা দিলাম। সকালে কিছুল ফলমুল এবং চা খেয়ে চলতে শুরু করতে হয়ে আমাদের। দুুুপুরে নুডুলস আর কিছু ফল-মুল সংগে চা তো রয়েছেই। চা পানীয়টি আমার বেশ লাগে, একটু মুখে পরলেই শরীরটা বেশ চাঙা হয়ে উঠে। অথচ আমাদের বঙ্গ দেশে এমন পানিয় খাওয়া তো দূরে থাক জানতামও না যে এমন কিছু রয়েছে। দেশে ফেরার পথে কিছু চা পাতা নিয়ে যাবো।


লিয়াংগুয়ান মুলত একটি সমুদ্র বন্দর। চ্যাংগঅন নগরটিকে এখন খুবই ছোট মনে হচ্ছে আমার কাছে। এতো বড় নগর রয়েছে এই টাং সাম্রাজ্যের অধিনে- যেটা আমার ধারণারও বাইরে ছিল। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। বিভিন্ন চেহারা, বিভিন্ন গড়নের মানুষ দেখা যাচ্ছে এখানে। স্থানীয়দের সংগে ভাষায় কিছুটা তারতম্যও রয়েছে, বিশুদ্ধ ম্যান্ডারিনের সংগে এদের আঞ্চলিকতায় ভাষা বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছে আমার।


রবার্ট লুইস নামের একজন ইওরোপিয়ান সওদাগরের সংগে পরিচিত হলাম। তিনি বিভিন্ন রকমের মেয়েদের পড়ার জন্য কাপড় নিয়ে আসেন নিজের দেশ থেকে আর এখানে তা বিক্রি করে চা-পাতা এবং আরও কিছু বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে দেশে ফিরেন। ফি বছরই তিনি নাকি একবার করে আসার চেষ্টা করেন। ম্যান্ডারিন বেশ শিখে নিয়েছেন।


নতুন কোন এলাকায় গেলেই আমি পুরো এলাকাটা একা একা ঘুড়ে ঘুড়ে দেখে এক দারুণ আনন্দ উপভোগ করি। এই নগরটিতে এসেও সেই আনন্দ যেন আরও বেড়ে গেল। এভাবে প্রতিদিনই নগরের ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় আমি ঘুড়ে বেড়াই। সম্রাট লি শিমিন রাজধানীতে রওয়ানা হয়ে গেছেন। আমার দায়িত্ব পরেছে স্থানীয় এক পাঠশালায় পাঠদানের। নতুন বাড়ীও জুটেছে। বেশ ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু আমার মন যে আর টানছে না এই বিদেশ বিভূয়ে। ফিরে যেতে হবে আমাকে আমার দেশে, বঙ্গ।


একদিন দুপুরে আমি হাঁটছি। হঠাৎ বিশাল একটা এলাকা জুড়ে নতুন একটি ভবনের নির্মাণ কাজ দেখতে পেলাম। সেখানটায় অনেক আরাবিয়দের দেখা যাচ্ছে। সকলেরই মাথায় ও সারা শরীরে সাদা কাপড় জড়ানো। এর আগেও আমি আরাবিয়দের দেখেছি কিন্তু কথা হয়নি কখনও। ভাবলাম একটু এগিয়ে দেখে আসি কি করছে এরা, এসব নতুন আগন্তকরা।


সোজা এগিয়ে গেলাম। এলাকটার নাম গুয়াংতা।অদ্ভুৎ রকমের কিছু মানুষ দেখতে পেলাম। এরমধ্যে একজন আমার দিকে এগিয়ে এলেন। খুব সুন্দর করে আমাকে অভিভাদন জানালেন তিনি। তার আচরণে কেমন যেন এক অদ্ভুৎ সম্মোহনী শক্তি লুকিয়ে ছিল। তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনার জীবনটা সুখ-শান্তিতে সমৃদ্ধ হোক’।
আমি কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এমন করে কখনও অপরিচিত কাউকে স্বাগত জানাতে দেখিনি কখনও। আমি হেসে তার প্রতিউত্তর দিলাম। বললাম, ‘আপনাদের দূর থেকে দেখে এগিয়ে আসলাম; আপনারা তো আরাবিয়। আমি এই টাং সাম্রাজ্যের একজন শিক্ষক যদিও আমি এদেশে এসেছি বঙ্গ থেকে।’


‘বঙ্গ, মানে আপনি ভারত থেকে এসেছেন? আমি তো অনেকবার গিয়েছি ভারতীয় বন্দরে। মালামাল নিয়ে গিয়েছি ব্যাণিজ্য করতে, গিয়েছি রেঙুন।’ বলতেই থাকলেন, ‘এবার যদিও এসেছি সিল্ক-সড়ক ধরে কিন্তু এর আগে প্রতিবারই আমরা জাহাজে করে আসতাম। ভারতেও যেতাম জাহাজে করেই।’


‘কিন্তু আপনার এখানে ঠিক কি করছেন, একটু জানতে পারি?”হ্যা নিশ্চয়ই জানতে পারেন।’ পেছন থেকে খুব সুদর্শন একজন যুবক এগিয়ে এলেন। তাকে দেখে অন্যরা বেশ সম্মান করে সামনে আসার সুযোগ করে দিলো। আমার মনে হলো এই ভদ্রলোকটিই তাহলে এদের নেতা। তিন আমার কাছে এসেই আমার সংগে হাত মেলালেন এবং বললেন, ‘আপনার জীবনটা সুখ-শান্তিতে সমৃদ্ধ হোক’।এবার আমি যেন একটু অবাকই হলাম। কি ব্যাপার এরা কথা শুরু করার আগেই আমার সুখ-শান্তি সমৃদ্ধ কামনা করছেন। কি চমৎকার একটি বিষয়? কারা এরা? বিষয়টা বোঝা দরকার আরও। যাই হোক, আমিও তার সংগে হাত মিলিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম।


সুদর্শন যুবকটি বলতে লাগলেন, ‘আমার নাম সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস’; আমরা এসছি আরবের নতুন রাষ্ট্র মদীনা থেকে। আমাদের রাস্ট্রের রাষ্ট্রপতির নাম মুহাম্মদ (সা); একই সংগে তিনি এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সমগ্র মানব জাতির জন্য শেষ পয়গম্বর এবং শেষ রাসুল। আমরা তার সাহাবী, আমি অবশ্য সম্পর্কে তার (সা) চাচা যদিও আমার বয়স অনেক কম। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান রাসুল মুহাম্মদ (সা) মদীনা নগরীতে বসবাস করেন এবং সেখান থেকেই তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমাদের রাষ্ট্রটি তার নেতৃত্ব খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু তারচেও বড় কথা একজন মানুষ ইসলামের নির্দেশনা মান্য করে নিজেকে মুসলিম হিসাবে ঘোষনা করে তার নিজের জীবনটাকেই আমুল বদলে দিচ্ছে। আপনি নিজেও যুবক। আপনাকে আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি মদীনা নগরী ভ্রমণে। সেখানে গেলে আপনি রাসুল (সা) এর সংগে সাক্ষাৎ করতে পারবেন। আপনাকে আমার আমন্ত্রণ। সেই সংগে ইসলাম ধর্ম গ্রহনেও আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমরা এখানে একটি ধর্মীয় উপসনালয় স্থাপন করছি। এই উপসনালয়টির নাম হবে ‘হুয়াইসেং মসজিদ’। এখানে পাঁচ বেলা প্রতিদিন আল্লাহর এবাদত করবে মুসলিমরা। আলোচনা হবে আমাদের মহান ধর্ম নিয়ে। ইসলাম একটি সম্পূর্ণ জীবন-ব্যবস্থা। আপনার যে-কোন প্রশ্নের উত্তর আপনি আমাদের থেকে পাবেন। আসবেন আপনি?’


সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস এর কথাগুলি আমার ভেতরে কেমন যেন দাগ কেটে গেল। আরব দেশটি সম্পর্কে আমার কোনই ধারণা নেই। আমাদের বঙ্গ থেকে পশ্চিম ও পশ্চিম দক্ষিন দিকে আরব ভুখন্ডটি। আমি কখনওই সেদিকে যাইনি বা যাবার কথা ভাবিনি। কিন্তু সেই হাজার হাজার মাইল দূরে একজন মানুষ মুহাম্মদ (সা) এর পক্ষ থেকে এরা এসেছেন; এই সূদূর চীনদেশে তাদের উপসনালয় নির্মাণ করছেন। বিষয়টা আমার কাছে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে।


একজন মানুষ কতটা প্রভাব সৃস্টি করতে পারলে এটা সম্ভব, সেটাই আমি ভাবতে পারছি না। একই সংগে তিনি একটি নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চলছেন। মদীনাকে করেছেন তার রাজধানী। না, আমাকে তো আরও জানতে হবে। আমি যাবো মদীনাতে। আমাকে দেখা করতে হবে মানুষটির সংগে। কাল আবার কথা বলবো আবি ওয়াক্কাস এর সংগে। আরও বিস্তারিত জানতে হবে আমাকে।

   Send article as PDF