সিসিলিয়া

বিশাল এই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন গাত্র, ভিন্ন বর্ণ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চলের মানুষের সংগে যোগাযোগ এবং অনেক দূরবর্তী ঐসব দেশগুলি সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য জানা এবং সেখানে ভ্রমণের ব্যাপারটা সবসময়ই আমার কাছে অনেক বড় একটা পাওয়া।
 
সত্যি বলতে কি আমি সবসময় এ বিষয়টাতে একটু মুখিয়ে-ই থাকি!
আর, জানি না ঠিক কি কারণে- আমার সংগেই বৈচিত্রপূর্ণ এসব অভিজ্ঞতা বেশী সংযুক্ত হয়।
 
গুয়ানা নামে একটি দেশ রয়েছে।
দেশটি দক্ষিন আমেরিকায় অবস্থিত। পশ্চিমে ভেনেজুয়েলা আর পূর্বে ফ্রান্স গুয়ানা এবং দক্ষিনে বিশাল ব্রাজিলের উত্তর প্রান্ত। (ফ্রান্স গুয়ানা মেইনল্যান্ড ফ্রান্স এর একটি অঞ্চল- যা দশ হাজার মাইল দূরে দক্ষিন আমেরিকায় অবস্থিত এবং এই অঞ্চলটি ‘সেনগেন’ ভুক্ত এবং এখানকার মুদ্রা ইওরো। পৃথিবীটা আসলে পাগলের ভুমি!)
 
এবং সবচে মজার বিষয়টা হলো, এই দেশটিতে (গুয়ানা) মোট জনসংখ্যার ৪৪% লোকই ভারতীয় বংশদভূত এবং এবং এর বড় একটা হিন্দু।
 
হিন্দু ধর্মটি মূলত ভারতীয়।
তারপরও সুদূর দক্ষিন আমেরিকার একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু এবং ভারতীয়- বিষয়টা আমাকে ভাবাতো- অনেক অনেক বছর আগে থেকেই!
 
নেপাল এই পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র, ভারত নিজেও রাজনৈতিকভাবে ‘কথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’। এর বাইরে অষ্ট্রেলিয়ার কাছে এশিয়া-ওসেনিয়া অঞ্চলের আরও একটা দেশ দেখা যায়- যেখানেও হিন্দু ও ভারতীয় প্রচুর (৪৬%) সংখ্যক লোকজন বসবাস করছে।
মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, ইন্দোনেশিয়াতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দুর বসবাস।
 
ভারতীয়রা প্রায় ১০০ বছর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বসতি স্থাপন করেছে।
 
সে যাই হোক।
আমি আমেরিকা আসার পর এই গুয়ানা দেশটি-ই আমার কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। আমি আগামী বছর কোন একসময় দেশটি ভ্রমণে যাবো।
 
আমার কৌতহলের কিছু কারণও রয়েছে।
নিউ ইয়র্কে আজ পর্যন্ত আমার সংগে প্রায় শতাধিক গুয়ানাবাসীর পরিচয় ঘটে। গুয়ানার রাষ্ট্রভাষা ইংলিশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন ‘হিন্দু ও ইন্ডিয়ান’ হওয়া সত্বেও তারা ইন্ডিয়াকে নিয়ে কোনই আগ্রহ বোধ করে না। তারা ভুলেও হিন্দি’র বিষয়ে জানতে চায়না; আগ্রহ নেই তাদের ঠাকুর দাদারা কেমন রয়েছে! তারা নিজেদের গুয়ানিয়ান পরিচয় দিয়ে বেশ গর্ব-বোধ করে।
 
অামি এদের মধ্যে প্রচন্ড বুদ্ধিমত্তা দেখেছি, যথেষ্ঠ মেধাবী অথচ গুয়ানায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে রয়েছে সংখ্যালঘিষ্ট ‘ব্লাক আফ্রিকানরা’। এরা আমেরিকার মূলধারায় বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। হিন্দি বা ভারত বিষয়ে প্রশ্ন করলে এরা একটা কমন উত্তর দেয়- ‘আমার ঠাকুর দাদাকে ছোট বেলায় দু-একটা গল্প বলতে শুনেছি- ইন্ডিয়া সম্পর্কে’।
 
গত পরশু ‘নলিনি সাহাই’ নামের ২৪/২৫ বছরের একটা মেয়ে আমার কাছে নিজের পরিচয় দিল ‘থেরাপিষ্ট’ হিসাবে। আমার কাছে এসেছে, আমাকে চেক করতে আমি শারিরীকভাবে ঠিক রয়েছি কিনা। আমি এই মেয়েটাকে ইন্ডিয়ান ভেবেছিলাম, কিন্তু ওর ‘ইংলিশ’ আমাকে বুঝিয়ে দিল সে গুয়ানার।
 
আমিও সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি গুয়ানা থেকে এসেছো?’।
মেয়েটা হেসে বলল ‘হ্যাঁ। তুমি কিভাবে বুঝলে?’
‘তোমার নাম নলিনি সাহাই। ‘নলিনি’ নামটা আমি ভারতে অনেক দেখেছি কিন্তু সাহাই-টা দেখিনি। তবে সেখানে প্রচুর ‘সাহা’ রয়েছে। আমি হিসাব মিলালাম, ‘নলিলি’ নামটা তোমার ঠাকুরদা রেখেছেন আর তিনি ‘সাহা’ ছিলেন কিন্তু সাহা’টা অনেক বছরে বিস্মৃত হয়ে ‘সাহাই’ করে ফেলেছেন!’
নলিনি খুব মজা পেল। বলল, ‘সত্যি! হতে পারে। আমিও সাহাই বিষয়টার মানে জানতে চাচ্ছিলাম মনে মনে।’
 
আমি হসপিটালে ভর্তি হবার পরবর্তী ২দিন বলতে গেলে তেমন একটা সচেতন ছিলাম না, প্রচন্ড ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছিলাম।
 
তৃতীয় দিন ভোর ঠিক সাতটায় একটা চমৎকার মিষ্টিভাষী মেয়ের কন্ঠে আমার ঘুম ভাংলো। আবিষ্কার করলাম আমার ব্যাথা একটু কম। মেয়েটা আমার সামনে রাখা বোর্ডে আজকের তারিখ ঠিক করে তার নিজের নাম লিখলো ‘সিসিলিয়া’। এবং আমার সামনে এসে বলল, ‘হাই, গুড মর্ণিং। আমার নাম সিসিলিয়া, ওয়েষ্ট আফ্রিকান ব্লাক গার্ল। আমি এখন থেকে তোমার নার্স। আজ তোমার দিনটা সুন্দর হোক। তোমার যে-কোন সমস্যায় আমাকে ডাকতে ভুলবে না। আমি মুহুর্তে হাজির হবো।’
 
আমি আমার বাম হাত নাড়িয়ে ওকে শুধু ‘হ্যালো’ বলতে পারলাম। সিসিলিয়া আমার সবকিছু চেক করে নতুন স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে তখনকার মতো চলে গেল। এবং একটু পরই ফিরে এসে বলল, ‘সরি তৌফিকুলি, আমি আজও তোমাকে কোন খাবার দিতে পারছি না, ইভেন পানিও না। আমি সত্যিই দুঃক্ষিত। আমি বুঝি তোমার কতটা কষ্ট হয়। কিন্তু তোমাকে- ‘তোমার জন্য’ আরেকটু কষ্ট যে করতেই হবে।’
 
আমি ওকে বললাম, ‘সেটা না দিলে, কিন্তু তুমি কি একটু কষ্ট করে আমার নাম টা একটু সঠিক ভাবে উচ্চারণ করবে? তোমার মুখে আমার নামের বিকৃত উচ্চারণটা বিশ্রী শোনাচ্ছে- এমনিতে তোমার গলা চমৎকার।’
‘কি উচ্চারণ হবে- আমাকে একটু বলে দাও।’
‘না, আমি বলবো না। তুমি নিজে নিজে চেষ্টা করো।’
 
সিসিলিয়া মিষ্টি করে হেসে দিয়ে চলে গেল এবং মিনিট দশের পরে ফিরে এসে বলল, ‘সরি তৌফিকুল, আমি সম্ভবত এবার ভুল করিনি।’
আমি হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালাম। ‘তুমি পশ্চিম আফ্রিকার ঠিক কোন দেশ থেকে এসেছো?’
‘আসলে আমি নিজেও জানি না- আমার অনেক পূর্বের কোন পুরুষ আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিল শুধু এটা জানি; পরবর্তীতে ইন্ডিয়ানরাও সেখানে আসে দলবেধে। আমার জন্ম গুয়ানাতেই। আমি মাত্র ১৮ বছর বয়সের সময় আমেরিকায় চলে আসি এবং পরবর্তীতে সিটিজেন হই। তবে গুয়ানা’র একটা চমৎকার সুন্দর শহরে আমার বাড়ী। আমার দেশটা গরীব কিন্তু আমি গুয়ানাকে ভালবাসি। আমি মাত্র ৬ মাসের জন্য আমেরিকায় আসি, এখানে জব করি এবং শীতের আগেই গুয়ানায় ফিরে যাই। সেখানে আমার চাচার একটা প্রাইভেট হসপিটাল রয়েছে- সেখানে আমি বিনা বেতনে কাজ করে এবং সবাই আমাকে সেখানে অনেক সম্মান করে। গুয়ানা আমাকে আর কত বেতন দেবে? আমি আমেরিকায় যা আয় করি, তাতে সারাবছর আমার চমৎকার ভাবে কেটে যায়। তাই আমি নিজ দেশে ‘সমাজ-সেবা’ করি। আমার দু’টা সন্তান, বড়টা ছেলে এবং ছোটটা মেয়ে; ইটস ইনাফ। আমার হাজবেন্ডটাও খুব ভাল মানুষ; আমি অনেক শান্তিতে রয়েছি। আমি একই সংগে আমেরিকা ও গুয়ানা’র সিটিজেন। আমারচে শান্তিতে এই পৃথিবীতে আর কে রয়েছে?’
 
সিসিলিয়া শুধু কথাই বেশী বলে না, কাজ তারচেও বেশী দ্রুত এবং অত্যন্ত দরদ দিয়ে করে। সিসিলিয়া’র প্রতি সত্যিই প্রচন্ড ভাল লাগায় মনটা ভরে গেল এই কয়দিনে। চমৎকার সুন্দর ব্যবহার ওর।
 
আজ সে আমাকে ওর গ্রামের বাড়ী বেড়াতে যাবার দাওয়াত দিল।
আমি আগামী বছর সিসিলিয়ার গ্রামের বাড়ী মানে ‘গুয়ানা’ বেড়াতে যাবো ইনশাল্লাহ। এবং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুড়িটা আরেকটু সমৃদ্ধ করার সুযোগ পাবো।
 
আজ হসপিটাল থেকে আমার সাময়িক বিদায়ের সময়, ওর মুখে- সেবা করতে পারার তৃপ্তির হাসি দেখলাম। তার সে হাসি বলে দিল- তুমি তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে উঠ; আমাদের আবার দেখা হবে।
   Send article as PDF