‘একদিন’ ছুটি

অনেক দিন যাবৎই ভাবছিলাম ‘একদিন’ ছুটি করবো।
ভাবনাটাও মনে হচ্ছে ৬ মাসেরই পুরাতন ভাবনা।

অবশেষে গতরাতে ফাইনাল সিদ্ধান্ত।
আজ আমার ছুটি।

আজ ঘুম থেকে উঠলাম বেলা ৩টায়।

এমনিতে আমি অবশ্য সবসময় ছুটির অামেজেই থাকি- প্রতিদিন।
নিজের অফিস, কোন জবাবদিহিতা নেই।

ঘুম থেকে উঠি ১১টা থেকে ১২টায়।
তারপর হেলে-দুলে ফ্রেস হই, ফেসবুকিং ও নাস্তা করি, গোসল করে পাক্কা ১৫ থেকে ২০ মিনিট ফ্যান ছেড়ে গাঁ শুকাই; ছোট বেলার অভ্যাস।
(ছোট বেলায় নদীতে গোসল করে ফিরে- চুলে হালকা ব্রাইল ক্রিম দিয়ে তারপর ১৫-২০ মিনিট খালি গায়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খোলা বাসাতে শরীর শুকাতাম। সে এক অদ্ভুৎ আনন্দ।)

তারপর সাবওয়ে ট্রেন ধরে বিকেল ৩টা থেকে ৪টা নাগাদ অফিসে গিয়ে পৌছি।

উইন্টারে নিউ ইয়র্কে বেলা ৪টার সময়ই সূর্য্য ডুবে যায়। ফেডারেল সরকার ঘড়ির কাটা ১ ঘন্টা পিছিয়ে দিয়ে টেনে টেনে দিন বড় করেও সুবিধা করতে পারে বলে মনে হয় না। চারটা মানেই সন্ধ্যা।

আমি যখন সাবওয়ে থেকে বের হয়ে নেক্সট ডোর আমার অফিসে ঢুকে- ৩০ সেকেন্ড এর জন্য টাইম স্কোয়াররস্থ আলো-বাতাস দেখতে পাই- যেটা কৃত্রিম।

আমার অফিসের কমন রিসিপ্টসনিষ্ট মেয়েটাকে কোনদিন বলিও নি- কিন্তু ৩টার আগে আমার কাছে কেউ আসলে তাকে সে নিজে থেকেই সোফায় বসিয়ে রাখে, পানি দেয়। বলে, ‘মি. পিয়াস তো ৩টার আগে কোনদিনই আসেই না, তুমি ফোন করোনি? বসে থাকো, এমনিতে সে প্রতিদিনই আসে- চলে আসবে’।

তারপর আমি যখন লিফট থেকে নেমে রিসিপ্টশন রুমে ঢুকি তখন সেই মেয়েটি অন্য দশজনের মতো করেই আমাকেও বলে উঠি, ‘হাই, হাও আর ইউ ডুয়িং স্যার’।
এবং চোখের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকে।

খুব আস্তে আস্তে আমাকে বলে, ‘তোমার কাছে ভিজিটর আসছে, সোফায় বসে রয়েছে- তুমি কি সংগে করে তোমার সুইট এ নিয়ে যাবে, না একটু পর আমি নিয়ে আসবো’।

কালো ও স্প্যানিস বাবা-মা’র ‘মাল্টিকালচার মেয়ে’টার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ।
কিন্তু মেয়েটা কি জানে যে আমি ওকে অনেক পছন্দ করি!
মনে হয় না, হয়তো জানতেও পারবে না সে কোনদিন।

দু’একজন নতুন বা পুরাতন ক্লাইন্ট এর সংগে হয়তো কথা বলতে হয়, তাদের কাজগুলি করি, দু’চারটা ফোন করি। একটু ক্ষধা লাগলেই বুঝি ৬টা বেজে গেছে। নীচে যেয়ে আমেরিকান সালাড বা টুনা স্যান্ডউইচ খেয়ে নিই।

আমার অফিসের ‘পেইনট্রি’টা ছোট কিন্তু সমৃদ্ধ। স্টারবার্ক এর কফি ভেন্ডর মেসিন রয়েছে, সংগে স্নাকস ডেন্ডর ও সোডা ভেন্ডর মেশিনও।

রাত নয়টা থেকে ১০টার মধ্যেই আবার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১১টা।

তারপর ডিনারটা শেষ করেই ফেসবুক নিয়ে বসি।
এটা ইদানিংকার অভ্যাস।

অনলাইনে স্ট্যাডি করি ঘন্টা খানেক। বিশ্ব সভ্যতার ‘নতুন কিছু’ খুঁজি।

ইদানিং আর কোন কিছুতেই বিস্মিত হই না।

অনলাইনে ডলার ইনকামের কিছু সুযোগ রয়েছে- সেগুলিও করি। মধ্য এশিয়ান একটা দেশের শিপিং এর কিছু কাজ করি, যাষ্ট কয়েকটা শিপিং লেভেল তৈরী করে- রিসিভ করা প্যাকেজের উপর পেষ্ট করে ইউএসপিএস এর অনলাইনে গিয়ে ‘পিক-আপ’ অর্ডার করি।

সপ্তাহে আমাকে এজন্য ২০ মিনিট করে মাত্র ৩ দিন কাজ করতে হয় ঘরে বসেই। সর্বসাকুলে সারা মাসে ৪ ঘন্টা কাজ করে ওখান থেকেও মাসে আয় আসে প্রায় ৯০০ ডলার।

অনলাইন থেকে এরকম আরো অনেক কাজই পাওয়া যায়- কিন্তু এই কাজটা আমার ভালো লেগেছে- দায়িত্বপূর্ণ কিন্তু পরিশ্রম ও সময়ের কোন অপচয়ই হয় না বলতে গেলে।

রাত ২টা বা ৩টার দিকে কোন কোনদিন হঠাৎ হঠাৎ মাথায় কোন লেখা এসে পোকার মতো করে কামড়াতে থাকে।

সাধারণত একটা আর্টিকেল লিখতে আমার ঘন্টা খানেক সময় লাগে।
কি লিখি জানি না। কেউ এসে লিখিয়ে দিয়ে যায়- এটা ভালোই বুঝি।

অতপরঃ ঘুম আসতে চায় না। আরও ঘন্টা খানেক ধরে পাঠক প্রতিক্রয়া দেখি- তখন বুঝতে পারি কোন এডিট করার প্রয়োজন রয়েছে কি না। আমার প্রচুর বানান ভুল হয়ে।

আসলে খুব তাড়াতাড়ি লিখি আমি। আমার টাইপিং স্পীড প্রায় ৮০ ওয়ার্ড পার মিনিট- মানে ১ মিনিটে আমি ৮০ বার ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা লিখতে পারি।
বানান তো ভুল হবেই!

অনেক বন্ধু আমাকে ইনবক্সে শুদ্ধ বানানটি পাঠিয়ে দিয়ে আমার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা অর্জন করে নেয়।

বানানগুলি এবং কিছু ভাষাও ঐ এক ঘন্টার মধ্যেই সংশোধন করি।

অতপর ঘুম।
এটাই আমার ব্যক্তিগত জীবন।
এভাবেই চলে যায় দিন। রাত। সময়।

আমি যখন প্রথম ব্যবসা শুরু করি- ঢাকার নবাবগঞ্জে, একটা কমপিউটার নিয়ে ‘কমপিউটার ট্রেনিং স্কুল’ দিয়ে; তখন প্রথম বছরটা আমার খুবই খারাপ কেটেছে।

ভয়াবহ খারাপ অবস্থা।
অন্য যে-কেউ হলে হাল ছেড়ে দিত।

অফিস ভাড়া ছিল ১৫০০ টাকা। অফিস ভাড়ার টাকাই আসতো না। আমার লক্ষ্যই থাকতো মাসের ভাড়াটা যেন অন্তত বাড়ীওয়ালাকে দিতে পারি। সব মাসে পারতামও না। দুপুরে মাত্র ২ টাকা দিয়ে একটা ‘পুরি’ কিনে খেতাম। পেট ভরতো না। বেশী করে পানি খেতাম।

নিজের অফিস, বাথরুম নিজে পরিস্কার করতাম। দোতালায় পানির লাইন ছিল না। নীচে অনেকটা দুরে মসজিদের কলে থেকে বালতি ভরে পানি নিয়ে আসতে হতো।

সকাল সাড়ে আটটা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত একা একা অফিসে বসে থাকতাম, কাষ্টমারের আসায়- কেউ আসতো না। মাসে হয়তো ২ জন বা ৩ জন।

কিন্তু নিজের যোগ্যতার উপর বিশ্বাস হারায়নি একটি মুহর্তের জন্যও।
আমি জানি, শুধুমাত্র প্রচন্ড ‘আত্মবিশ্বাস’-ই আমাকে আজ টাইমস স্কোয়ার পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।

নবাবগঞ্জে বছরখানেক পর আস্তে আস্তে আমার ব্যবসায় মোড় ঘুরতে শুরু করলো। একটা কমপিউটার থেকে ১৪টা কমপিউটার হলো। নবাবগঞ্জের মতো একটা মফস্বল এলাকায় এই আমি মাসে লাখ টাকার উপর আয় করেছি সেই ১৯৯৭-৯৮-৯৯ সালে।

আমি সকাল ৭টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত কাজ করেও শেষ করে উঠতে পারতাম না। দুইজন ইন্সট্রাকটর ও ২জন অফিস সহকারী নিয়োগ দিয়েও পেরে উঠতে কষ্টকর হতো।

এবং ২০০০ সালে সিদ্ধান্ত নিলাম- সেই অত্যন্ত লাভজনক এবং চালু ব্যবসা বিক্রি করে দিয়ে ঢাকা শহরে চলে যাবো। পরিচিত আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব-শুভাকংখী সকলে আমাকে ‘প্রচন্ড বোকা’ হিসাবে ধরে নিল।

আমি যখন নবাবগঞ্জের মতো মফস্বলে একটা কমপিউটার দিয়ে ব্যবসা শুরু করি- তখনও সকলেই আমাকে ‘প্রচন্ড বোকা’ই ভাবতো।

আমি চলে আসলাম ঢাকা শহরে। মালিবাগ হয়ে পান্থপথে।

চাকুরী করার কোন অভিজ্ঞতাই আমার নেই।
বাংলাদেশে একটানা বছর বিশেক ব্যবসা করেছি। ২০১৩র প্রথম দিকে আমেরিকার ভিসা পাবার পরও এদেশে চলে আসার কোন আগ্রহ আমার ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনার রাজ্যে যখন দেখলাম আর খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা সম্ভব হচ্ছে না তখনই, ২০১৪র শেষে গিয়ে দেশ ত্যাগের চিন্তা মাথায় চলে আসে।

কিন্তু একটা সমস্যা আমাকে মারাত্মকভাবে চিন্তায় ফেলে দিত।
আমি যখন দেশ ছাড়ি তখন আমার কাছে টাকা ছিল না। প্রচুর টাকা লস করেছি ২০১০ এর পর থেকে। আসলে ওটা লস ছিল না- স্থান নির্বাচন ভুল ছিল। আমি একটা অনলাইন পোর্টল এর পেছনে অনেক বড় একটা এমাউন্ট নষ্ট করেছি। আমার মাথায়ই ছিল না যে বাংলাদেশে ভালো কোন সফটওয়্যার ডেভলপার বা প্রোগামারই নেই।

ওদের অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আমার চিন্তার গতির সংগে পেরে উঠতো না। যে টাকা আমি দেশে নষ্ট করেছি- ওই টাকা দিয়ে ‘সানফ্রান্সসিকো’র মতো শহরে গিয়ে আমি অনায়াসেই প্রোজেক্টটি সাকসেসফুল করতে ফেলতে পারতাম।

যাই হোক, ১৩০০ ডলার হাতে নিয়ে আমি জেএফকে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করি।
তবে, আমার চোখে এবং মনে তখন ছিল ‘এক বুক আশা ও এদেশটির প্রতি ভরশা’।

আমি আমেরিকায় আসার মাস খানেক পর একদিন সাবওয়ে ট্রেন এ একটা নিউ ইয়র্ক ষ্টেটের একটা সাইন দেখলাম, যেখানে লেখা ‘আমি ১৯৫৯ সালে জেএফকে তে নামি- তখন আমার সংগে মাত্র ৬৩ ডলার এবং এক বুক আশা’- এক চাইনিজ মহিলা স্যাংহাই থেকে এসে।

ওদিনই বুঝতে পারলাম- এ দেশটা স্বপ্ন পূরণের এবং সুযোগের। আমার আত্মবিশ্বাস ওদিন আর ১ মিলিয়নগুন বেড়ে যায়।

দেশ ছাড়া আগে আমি একটু টেনশনে পরে যাই- কি করবো আমেরিকায় গিয়ে?

আমি তো আর সৌভাগ্যবান নই যে ‘ইমিগ্রান্ট’ হয়ে যাচিছ!
আমি তো যাচ্ছি টুরিষ্ট হিসাবে এবং আমাকে প্রতি মুহূর্তে ওখানে লড়াই করে থাকতে হবে।

আমি ভালো লড়তে পারি এবং অসম্ভব ধৈর্য রয়েছে আমার- সুতরাং সেটা সমস্যা না।
সমস্যা টা হলো- আমি কি করবো?

জব আমি করতে পারবো না- সেটা জানি।
টাকাও নেই হাতে। তাছাড়া টাকা থাকলেও নতুন একটা পরিবেশে গিয়ে হঠাৎই কোন ব্যবসা শুরু করে দেয়াটাও বোকামী হবে।

তখনই হঠাৎ একদিন আমার মাথায় একটা হিসাবে চলে আসলো।
এবং হিসাবটাই আমাকে চাঙা করে দিল, সাহস ও শক্তি জোগালো।

আমি বাংলাদেশে বড় হয়েছি। পড়াশোনা, ব্যবসা সবই বাংলাদেশে। খালি হাতে ব্যবসা শুরু করি। বাংলাদেশ যখন একজন মানুষের গড় আয় বৎসরে মাত্র ৮০০ ডলার (মাসে ৫০০০ টাকা) তখন আমার ব্যক্তিগত মাসিক ব্যয় ছিল ৬ লাখ টাকার উপরে। অর্থাৎ সাধারণ একজন বাংলাদেশীর চেয়ে আমার আয় প্রায় ১২০ গুন বেশী।

সেখানে আমি যে দেশে যাচ্ছি সেদেশের মানুষের মাসিক গড় আয় ৫ হাজার ডলার। সুতরাং ১২০ গুন দরকার নেই- ওদের সমান কি আমি হতে পারবো না? অতপর বছর পাচেকের মধ্যে অন্তত যদি ১০গুনও আয় করতে পারি- তাতেই আমি খুশী।

আমি তো অতটা অযোগ্য নই বা ছিলাম না কোনকালেও!
আমি প্রচন্ড রকমের আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ। সাহসী, পরিশ্রমী। শুয়ে বসে থাকতে পারি না। তাহলে আমি কেন ভয় পাবো?

আমেরিকায় আসার ১৫ মাসের মধ্যেই আমি এখানে, মানে ম্যানহ্যাটনের টাইম স্কোয়ারে অফিস নিই।

আমেরিকায় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের মুল ব্যবসাস্থান জ্যাকসন হাইটস বা জামাইকার হিলসাইড এভিনিও।

আমি যখন টাইমস স্কোয়ারের মতো দামী জায়গায় অফিস খুঁজছি- তখনও আমি ‘প্রচন্ড বোকা’।

মাঝে মধ্যে নিজেকে বড় বোকা ভাবতে আমারও ভালো লাগে।

আজ কোন কাজ নেই আমার।

অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম, একদিন কোন কাজ করবো না।
আজ কোন কাজ করছি না।

এমনিতেও আজ বরিবার। উইকেন্ড। ছুটি।
যদিও আমি রবিবারেও অফিস করি।

কিন্তু হাফিয়ে উঠেছি।
বাসায় বসে থাকতেও ভাল লাগছে না।

কাজ ছাড়া মানুষ থাকে কিভাবে?

এখন সন্ধ্যা ছয়টা বাজে।
যাই, ঘুমটা শেষ করি।

আগামীকাল থেকে কাজ শুরু করবো।
ওহ, একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। উত্তর মেরুতে যাবো আগামী মে মাসে।

যা সিদ্ধান্ত তাই কাজ।
It is easy to do but difficult to say.

   Send article as PDF