প্যাচাল

দুইটা বিষয় প্যারালালী মাথার মধ্যে ঘুর-পাক খাচ্ছে।
কোনটা লিখবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
 
রাত জাগা মানুষ আমি। সকালে ঘুমানোর অভ্যাস করে ফেলেছিলাম সেই ১৫ বছর হলো। কিন্তু আর না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর রাত জাগবো না, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবো।
 
এতে দিনটা অনেক লম্বা পাওয়া যায়। কাজ করেও সুবিধে।
যাকগে সেসব কথা, লেখাটা শুরু করলাম; দেখি কোন দিকে যায়।
 
একজন মানুষ চাইলে যে-কোন কিছুই করে ফেলতে পারে।
কিন্তু, মজার বিষয় হলো অনেকেই বলে থাকে- মানুষের চাওয়ার কোন শেষ নেই। কথাটা কি আদৌ সত্যি?
 
আমার বিশ্বাস হয় না। আসলে মানুষের চাওয়ার শেষ রয়েছে। অন্তত পক্ষে সফল মানুষদের চাহিদা সীমিত। তারা যে-কোন কিছুই একটা নির্দিষ্ট টার্গেট করে পেতে চান।
 
অর মজার বিষয়টা হলো, কেউ যদি কোন কিছু সুনির্দিষ্ট টার্গেট করে পেতে চায়- তাহলে সে সেটা পাবেই।
 
আর ওখানেই তো সফলতা।
 
বিক্ষিপ্ত চাওয়াতে কোন সফলতা আসে না।
 
এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই বড় হতে চায়। বড় হবার স্বপ্ন দেখে।
যারা সাহস হারিয়ে ফেলে তারা ব্যর্থ হয়। যারা সাহস ধরে রাখতে পারে তারাই সফল।
 
আরও একটা সমস্যা রয়েছে- আপনি কোন বড় কাজে হাত দিলে আপনার সমালোচকের কোন অভাব দেখা দিবে না। নিজের ঘরে থেকে শুরু করে পরিচিতদের মধ্যেই সমালোচকের সংখ্যা বেশী দেখা যাবে।
 
আপনার দায়িত্ব হবে, অন্ধ হয়ে যাওয়া। কে কি বলল তাে কি এসে যায় আপনার?
 
আপনি যেটা না- সেটা করার চেষ্টা করলে সফলতা পাওয়া সম্ভব হবে না।
আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে আপনি ঠিক কোন কাজটা ভাল করতে পারেন।
 
আপনি ভালো ফুটবল খেলতে পারেন, বেশ তো আপনি ফুটবল নিয়েই লেগে থাকুন। ক্রিকেটে কেন?
আপনার গানের গলা ভালো। নাচের প্রাকটিসের কি আদৌ কোন দরকার রয়েছে আপনার?
আপনি ভালো অভিনয় করতে পারেন। বেশ, করুন। লেখক হবার দরকারটা কি?
 
আগে নিজেকে জানুন।
বুঝুন আপনি ঠিক কোন কাজটাতে আনন্দ পান।
এবং এবার থেকে মন দিয়ে সেই কাজটাই করুন।
 
দেখবেন নিজেও শান্তি পাচ্ছেন, প্রশংসাও কুড়াচ্ছেন।
সেটাই তো ভালো, তাই না?
 
আপনার ভেতরে সর্বপ্রথম আপনার নিজেকে খুঁজুন।
 
এবার নিজের প্রতিভাকে প্রস্ফুটিত করার উদ্যোগ নিন। ভালো লাগবে আপনার। সফলতা আসবেই যদি লেগে থাকতে পারেন।
 
দু’টো গল্প বলি।
 
তখন ঢাকার নববাগঞ্জে সবে কমপিউটার স্কুল শুরু করেছি। স্টুডেন্টরা আসে, ট্রেনিং দিই আমি নিজেই। শুরুটা খারাপ যাচ্ছিল না।
 
কোন এক দুপুরে এক ভদ্রলোক অফিসে আসলেন। লুংগি পরা।
আমি কিঞ্চিত বিরক্ত হলাম। লুংগি পরে কেন অফিসে আসবে?
 
ওনি বসলেন। নিজের নাম বললেন, আলমগীর।
 
কমপিউটার শিখতে চান। কোর্সসমূহ এবং ট্রেনিং সম্পর্কে বিস্তারিত জানালাম। ওনি তখনই পকেট থেকে ২০০ টাকা বের করে দিয়ে সাইন-আপ করতে চাইলেন (তখন পর্যন্ত ৫০০ টাকার কম দিয়ে কেউ সাইন-আপ করেনি)। আগামী কাল থেকে ট্রেনিং নিতে আসবেন। ওনার স্কাজুয়াল ঠিক করে দিলাম।
 
প্রতিদিনই ওনি লুংগি পরে আসতে থাকলেন। আমি বিরক্ত হওয়া সত্বেও চক্ষু লজ্জার ভয়ে কিছু বলতে পারছিলাম না (এখন হলে চট করে প্রথমদিনই বলে ফেলতাম)।
 
ভদ্রলোকের মাথা বেশ পরিস্কার। খুব দ্রুতই শিখতে লাগলেন।
 
অতপর একদিন দেখলাম প্যান্ট পরে এসেছেন।
আমার চেম্বারে ঢুকলেন নিজে থেকেই। সালাম দিলেন। বসলেন।
 
বললেন, ‘ভাই আজ থেকে প্যান্ট পরেই আসবো; আপনি লুংগিতে বিরক্ত হন সেটা আমি বুঝি’।
 
আমি মৃদু হাসলাম, কিছু বললাম না।
ভদ্রলোক বলতেই থাকলেন, ‘ভাই শোনেন। আসলে আমরা হলাম গিয়ে -জুলা। জুলা বুঝেন তো? আসলে জুলা’রা একটু আনকালচারাল্ড-ই হয়। এই আমাকে দেখেন, আমাকে দেখলে কি কেউ বুঝতে পারবে যে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশ লিটারেচরে অনার্সসহ মাষ্টার্স করেছি!’
 
আমি এবার ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম।
কিছুটা বিস্ময় তখন আমার চোখে।
 
ভদ্রলোক এবার প্রসংগ পরিবর্তন করলেন, ‘আপনাকে একটা পরামর্শ দিবো আজ। আমার পরামর্শটা মেনে চলবেন।’
 
জানতে চাইলাম, ‘কি পরামর্শ?’
 
বললেন, ‘কোনদিন কাউকে টাকা পয়সা ধার দিবেন না।’
‘কেন?’ প্রশ্ন করলাম। ‘মানুষকে লোন দিলে সমস্যাটা কোথায়? যে-কারোই তো সমস্যা হতে পারে ইভেন আমার নিজেরও!’
 
আলমগীর ভাই সেদিন যে উত্তরটা দিয়েছিলেন- তা আজও আমার মনে আছে যদিও ওনাকে ভুলে গেছি।
 
‘কাউকে লোন দেয়া মানে তার সংগে সম্পর্ক নষ্ট করা। আপনার থেকে কেউ লোন নিল তারপর সে তার কমিটমেন্ট মতো ফেরত দিতে পারলো না- তখন আপনি সমস্যায় পরবেন। বিরক্ত হবেন। এবং একটা পর্যায়ে সম্পর্ক নষ্ট হবে। তারচে বরং আপনি আপনার সাধ্য মতো তাকে সহযোগীতা করেন। টাকা দিন- তবে সেটা লোন হিসাবে না। মনে মনে ফিসাবিলিল্লাহ দিয়ে দিন। যদি সে ফেরত দিতে পারে- সেটা বোনাস। আর যদি ফেরত না দিতে পারে- কোন সমস্যা নেই; সম্পর্কটা তো থাকলো। আপনিও কষ্ট পেলেন না- আপনি তো ফিসাবিলিল্লাহ-ই দিয়েছেন’।
 
আলমগীর ভাইয়ের প্রতি জমে থাকা বিরক্তিটুকু শ্রদ্ধায় কনভার্ট হয়ে গেল।
 
আরেকটা গল্প বলি। সমসাময়িক সময়েরই কথা।
 
তখন স্থানীয় কলেজের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলো তারেক।
 
কোন এক বিকেলে তারেক হঠাৎ-ই আমার অফিসে এসে উপস্থিত। অত্যন্ত নজরকাড়া ভদ্র ছেলে তারেক কোন ভূমিকা ছাড়াই বলল, ‘ভাই, কাল তো আমাদের কলেজে বিটিভি’র জন্য বিতর্ক প্রতিযোগীতা হবে। আমি নাম দিয়েছি, আপনাকে বিতর্কটা লিখে দিতে হবে। বিষয়টা রাখেন (একটা কাগজ ধরিয়ে দিল), প্লিজ আজই সন্ধ্যায় যদি একটু লিখে দিতেন তাহলে রাতে রিভাইজ দিতে পারতাম।’
 
আমার যেহেতু লেখা-লেখিতে কোন আলস্য নেই সেহেতু বিষয়টা বুঝে নিলাম (বিষয়টা এখন মনে করতে পারছি না- ‘অবকাঠামো’ বিষয়ক কিছু একটা ছিল) এবং তারেককে ঘন্টা তিনেক পর এসে নিয়ে যেতে বললাম।
 
বিকেলে ফ্রি সময়ে ‘কিছু একটা’ দাড় করিয়ে ফেললাম। তারেক এসে নিয়ে গেল। খুশী হলো একবার পড়ে।
 
আমি তখন খুব সকালে অফিসে পৌছতাম, সকাল ৮টার মধ্যেই।
 
সাড়ে আটটার দিকে ঐ একই কলেজের ছাত্র সংসদের দপ্তর সম্পাদক তপু এসে উপস্থিত, ‘ভাই, আপনি তারেক কে বিতর্কের পক্ষে লিখে দিয়েছেন আমি পড়েছি; আমাকে এখনই বিপক্ষে একটা লিখে দিতে হবে- আমিও প্রতিযোগীতায় অংশ নিবো।’
 
তপুকে কি উত্তর দিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। বিষয়ের পক্ষে চিন্তা ভাবনা করেছিলাম, লিখেওছি; কিন্তু এখনই আবার বিপক্ষে কি লিখি! তপুকে বললাম, ‘কিভাবে লিখবো বলো তো? আমি তো তারেককে পক্ষে লিখে দিয়েছি; সব যুক্তি তো ওখানেই শেষ। এখন আবার নিজেই নিজের যুক্তির বিপক্ষে কি লিখি?’
 
‘না ভাই, আপনাকে লিখতেই হবে। আমি গেলাম; ঠিক ১০টায় আসবো আবার, ১১টায় বিতর্ক। ১ ঘন্টা রিভাইজ দিয়ে অংশ নিবো। দিতেই হবে।’ আবদার বা দাবী দু’টোই জানিয়ে তপু চলে গেল।
 
আমি পরে গেলাম বিপদে! কি লিখি কি লিখি বুঝতে পারছি না।
 
থার্টি মিনিটস চিন্তা করলাম। কাগজ-কলম নিলাম। কিছু একটা লিখলাম।
 
ঠিক দশটায় তপু এসে খুশী মনে ওটাই নিয়ে গেল।
 
যাবার সময় তার নিজের এবং তারেকের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করতেও ভুলল না।
 
বারটার দিকে মনে হলো- যাই একটু কলেজে, দেখিই না কি হয়। গেলাম।
 
এবং জানলাম, তারেক প্রথম, মিলি দ্বিতীয় এবং তপু তৃতীয় হয়েছে বিতর্ক প্রতিযোগীতায়।
 
তারেক এখন লন্ডনে।
তপু ইওরোপে।
কানিজ ফাতেমা মিলি ঢাকাতে।
 
তারেকের সংগে ফেসবুকে যোগাযোগ হয়, ওদের সংগে যোগাযোগ নেই।
 
অনেক অনেক বছর পর আজ আবার সকালে উঠলাম। এখন থেকে প্রতিদিনই উঠবো। সকালে উঠে নিয়মিত ঘন্টা তিনেক লেখা-লেখির পেছনে সময় দিবো। দেখা যাক কি হয়।
 
ওহ, আমার এই সকালে উঠার পেছনে একজনের অবদান রয়েছে। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না, আজকের লেখাটা তাকেই উৎসর্গ করলাম।
 
আরেকটা বিষয় লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সকলেই আমরা জীবনে বড় হতে চাই। প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। সকলে আমাকে চিনবে- এমনটা চাই। পত্রিকায় নিউজে ছাপার অক্ষরে অামার নামও থাকবে সেটাও চাই।
 
আসলে বাস্তবতা হলো, ‘বড় হবার শর্টকার্ট কোন রাস্তা-ই নেই’।
 
শাহবাগে সরকারী আনুকুল্যে ফাসি ফাসি চাই বলে গলা ফাটিয়েও বড় হওয়া যায় না। প্রচার পাওয়া যায়।
 
আসলে প্রচার পাওয়া আর বড় হওয়া এক বিষয় না।
 
আপনি বড় হোন, প্রচার এমনিতেই পাবেন।
 
দুভ্যার্গজনক হলো, আমরা প্রচার চাই- বড় হতে চাই না।
 
আমার অনুরোধ আগে বড় হোন আপনার কাজ দিয়ে। নিজের প্রতিভার ব্যবহার করে। আপনার যোগ্যতাকে তুলে ধরুন, বাস্তব রূপ দান করুন নিজের যোগ্যতার।
 
একমাত্র কাজ করেই বড় হওয়া যায়। আপনি কাজ করুন। চলুন আমরা কাজ করি। প্রচারের পেছনে না ছুটি।
 
বড় হতে পারলে প্রচারই আপনার পেছন পেছন ছুটবে।
এবং ওটাই আনন্দের।
 
যে দু’টি বিষয় মাথায় নিয়ে লিখতে বসেছিলাম, তার একটাও লেখা হলো না, তাতে কি?
 
অন্যদিন লিখবো।
 
   Send article as PDF