ডিপ্লোমেসী ডিপ্লোমেসী

শাশুড়ী ও বউ এর ‘যুদ্ধ’- বাংলাদেশের চিরায়িত বিষয়।
 
দু’জনের ঝগড়া চলছে।
শাশুড়ী চিৎকার চেচামেচী করে ছেলের বউকে বকা দিচ্ছে, ধমক-ধামক দিচ্ছে।
 
কিন্তু বউমা অতি বুদ্ধিমতী।
সে খুব ঠান্ডা মাথার। কোন শব্দই উচ্চারণ করছে না।
 
কিন্তু একটু পরপর হাতের ঝাড়ু অথবা পায়ের সেন্ডেলটি শাশুড়ীর দিকে তুলে দেখাচ্ছে!
 
আশে-পাশের নেবার’রা ভাবছে আহ বুড়ো শাশুড়ীটা সত্যিই অমানুষ। সারাক্ষন এতো লক্ষী বউ’টাকে শুধু-ই গালাগালি করে; অথচ বউটাকে কখনওই একটা খারাপ শব্দও উচ্চারণ করতে দেখা যায় না।
 
‘ইহাকেই ডিপ্লোমেসী বলা হইয়া থাকে’।
 
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি কোন এক সময়, নিউ ইয়র্ক।
জুলফিকার আলী ভুট্টো কয়েক মাস নিউ ইয়র্কে থাকবেন, উদ্দেশ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা এবং একই সংগে নিজেকে পাকিস্তানের সরকার প্রধান হিসাবে সকলের সমর্থন আদায়ে নিজ দেশের সরকারকে চাপে রাখা।
 
মেয়ে বেনজীর ভু্ট্টোও তার সংগে রয়েছেন। তিনি তার মেয়ে বেনজীর ভুট্টোকে নির্দেশনা দিলেন কোন বিখ্যাত ব্যক্তি- উনি যে-দেশেরই হোন না কেন তার (জুলফিকার আলী ভুট্টো) সংগে দেখা করতে আসলে- বেনজীর যেন ভদ্রলোককে ড্রয়িং রুমের সোফায় অপেক্ষা করতে বসিয়ে রেখে বাবাকে খবর দেবার কথা বলে একটু উপরে ঘুরে এসে আবার নীচে গিয়ে ভদ্রলোককে বলে যে, ‘বাবা তো প্রেসিডন্ট রিচার্ড নিক্সন এর সংগে ফোনে জরুরী কথা বলছেন, একটু সময় লাগবে’।
 
বেনজীর বাবার কথা মতোই কাজ করলেন বেশ কয়েকদিন।
বুদ্ধিমতী বেনজীরও ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না যে কেন বাবা তাকে দিয়ে এমন একটি মিথ্যা কথা বলাচ্ছেন?
 
একদিন বাবা’র কাছে জানতে চাইলেন বেনজীর ভুট্টো।
বাবা যে রাজনৈতিক শিক্ষাটা মেয়েকে দিলেন সেটা ছিল, ‘এতে আগুন্তক অতিথী বাবার ক্ষমতা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষন করবে এবং সেইভাবেই তাকে গুরুত্ব দিবে তথা ভাবতে বাধ্য হবে’।
 
বেনজীর ভুট্টোও বুঝলেন, ‘ইহাকেই ডিপ্লোমেসী বলা হইয়া থাকে’।
 
তবে আমার জানা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ডিপ্লোমেসীর গল্পটা আরও ভয়ংকর।
আমি দুঃখিত ঘটনাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং আমি পড়েছিলাম আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে- হয়তো আমার স্মৃতিশক্তি প্রতারণাজনিত কারণে কোথাও ভুল হতে পারে- কেউ সঠিক তথ্য জানলে আমাকে সংশোধন করে দেবেন বলে সবিনয় অনুরোধ করছি।
 
তৃতীয় খলিফা ওসমান (রা) নিহত হবার পর আলী (রা) এবং মুয়াবিয়া (রা) এর মধ্যে দ্বন্দ শুরু হয় কে চতুর্থ খলিফার দায়িত্ব নিবেন। দু’জনই নিজেদের খলিফা দাবী করেন। সম্ভবত একটা যুদ্ধও হয় এই দাবী নিয়ে। অবশেষে তাঁরা দু’জনে মিলে একটা সিদ্ধান্ত নেন যে- দুজনই যেহেতু নিজেদের ‘খলিফা’ দাবী করেছেন সেহেতু তারা দু’জনই সর্বপ্রথম খলিফা পদ থেকে পদত্যাগ করবেন। এবং এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে একজন খলিফা মনোনীত বা নির্বাচিত হবেন।
 
সুন্দর প্রস্তাব। আলী (রা) সৎ মানুষ, তিনি চটজলদি খলিফা পদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেন। কিন্তু অতি চতুর মুয়াবিয়া তাৎক্ষনাত ঘোষনা দিলেন- তুমি পদত্যাগ করেছো সকলে দেখেছে কিন্তু আমি এখন পদত্যাগ করলাম না। সুতরাং আমিই এখন একমাত্র খলিফা!
 
‘ইহাকেও ‘ডিপ্লোমেসী’ বলা হইয়া থাকে- স্যার!’
 
সে যাই হোক, মুয়াবিয়ার কথা ধোপে টিকেনি পরবর্তীতে সম্ভবত দু’জন দু’অঞ্চলের খলিফা হয়েছিলেন বা কিছু অমিমাংসিত সমস্যা জিইয়ে ছিল- আমি ইতিহাসের ছাত্র নই; ইতিহাস বোদ্ধারা ভালো বলতে পারবেন।
 
চলুন আবার ফিরে আসি দেশীয় ডিপ্লোমেসীতে।
‘রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ’ অন্য সব বিষয়ের মতোই ডিপ্লোমেসীতে অথর্ব।
 
প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমান যথেষ্ঠ ডিপ্লোমেসী প্রয়োগ করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাধ্য করেছিলেন বাংলাদেশে থাকা ইন্ডিয়ান আর্মীদের ফিরিয়ে নিতে- এছাড়া শেখ মুজিবের ক্ষমতাকালীন সময়ে আর কোন সাফল্য নেই।
 
প্রেসিডেন্ট এরশাদ খুব ভালো ডিপ্লোমেসী বুঝতেন, এতে কোন সন্দেহ-ই নেই। ৮৮’র বন্যায় তার দুর্দান্ত পার্ফমেন্সে প্রচুর পরিমান বিদেশী সাহায্য তিনি এনেছিলেন। ৯০ এ ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখলকালে আটকেপড়া বাংলাদেশী শ্রমিকদের স্বল্পতম সময়ে নিরাপদে এবং বিদেশী সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে আনতে পারার মতো সাফল্য এরশাদীয় ডিপ্লোমেসীতেই সম্ভব ছিল।
 
স্ত্রী রওশন এরশাদের মা মারা যাবার কারণে মাত্র কয়েকঘন্টার জন্য মুক্ত হয়ে পতিত প্রেসিডেন্ট এরশাদ ফোন করে বসেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচডব্লিও বুশকে, কথা বলেন প্রায় ১০ মিনিট। দুর্দান্ত ডিপ্লোমেসী।
 
হাসিনা-খালেদা’রা অন্য সবকিছুর পাশাপাশি ডিপ্লোমেসীও বুঝেন না। যেটা বুঝেন সেটা হলো গ্রাম্য ঝগড়া-ঝাটি।
 
আর তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রশাসনও এখন ভারতনির্ভর ডিপ্লোমেসীতে আক্রান্ত। ভারত যেদিকে যায় এরাও সেদিকে যায়। আমাদের বিচার বিভাগও ভারতনির্ভর একটা প্রতিষ্ঠান। যে-কোন কিছুতে নিজেদের বুদ্ধিতে না কুলোলে ভারত আর পাকিস্তান খুঁজে- এরচে বেশী দূর অবধি তাদের দৃষ্টিও যায় না।
 
লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে! শর্টকার্টে যাচ্ছি। মুল বিষয় নিয়ে বলি।
 
আমার লেখায় অনেক সময়ই দেখি অতি অল্প কয়েক ব্যক্তি বেশ ‘ডিপ্লোমেটিক’ কমেন্ট করে আমাকে বধ করার চেষ্টা করেন। আমি বুঝি এবং হাসি। অবশ্য আমি ডিপ্লোমিসী করি না, ইচেছ করেই করি না। আমি জানি- আমি যদি চাই এদের উল্টো কুপোকাত করে একটা দুইটা লাইন লিখতে আমার মাথাও ঘামাতে হবে না; কিন্তু তাদের পেছনে সময় দিই না- সময় মুল্যবান।
 
কারণটা বলে দিই- আমি তো ‘তাদের’ জন্য লিখি না। আমি লিখি দেশের সাধারণ মানুষদের জন্য যারা ডিপ্লোমেসী নিয়ে চিন্তিত নয় বা বুঝে না। এরা কিছুটা কুটিল কিন্তু ‘অতি চতুর না’। এদেরকে খুব সহজেই ‘সভ্যতা’ শেখানো সম্ভব। কিন্তু আমি যদি ডিপ্লোমেটিক ওয়েতে লিখি- কোন রেজাল্ট আসবে না।
 
আমি একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করি আমার ফলোয়ার সংখ্যায়।
সংখ্যাটা প্রতিনিয়ত সেই তৈলাক্ত বাঁশে বানরের উঠা-নামার মতো করেই বাড়ে আর কমে।
 
হয়তো কেউ একজন আমার একটা লেখা পড়ে আমার ফলোয়ার হলেন- কিন্তু একটু নীচে গিয়ে কয়েকটা লেখা পড়েই আনফলো করে দিলেন।
 
দু’টি কারণ:
এক। প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান- পাছে ৫৭ আক্রমণ করে না বসে। ভয় আর ভয়। কেউ কেউ তো এতো বেশী ভয় পায় যে আমাকে ব্লকও করে দেন। আমি সেটাও টের পাই। এবং হাসি।
 
আর ভাবি বাংলাদেশের মাত্র ২ কোটি মানুষ যদি ৫৭ ধারা একযোগে অমান্য করতে শুরু করে- তিন-চার লক্ষ পুলিশের পক্ষে সম্ভব না এতো এতো মানুষকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। কিন্তু আমরা ভীতু জাতি। পারবো না ঝুঁকি নিতে।
 
দুই। আমি সত্য কথা উচ্চারণ করি। আবেগ বা শোনা কথায় কান দিই না। যেটাকে সত্য বলে প্রমাণ পাই সেটা সাহসের সংগে উচ্চারণ করি। যুক্তি দিয়ে আবেগের ভ্রান্তনীতিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই। আমার শব্দের গাম্ভীর্যে উড়ে যায় শেখ মুজিবের নোংড়ামীর ইতিহাস। মুখোস উম্মোচন হয়ে পরে মুহুর্তে। এটা কেউ কেউ সহ্য করতে পারে না। তৈলাক্ত বাঁশ থেকে বানরের মতো ঝড়ে পরে কিছু ফলোয়ার।
 
এখন আমি যদি একটু ‘ডিপ্লোমেসী’ করি- শেখ মুজিবকে নিয়ে না লিখি বা তার নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘জাতির বাবা’ ইত্যাদি বলে সত্য গোপন করি- তাহলে আমার ফলোয়ার সংখ্যা এক লাফে কয়েকগুন বেড়ে যাবে কোন সন্দেহ নেই। আমি যদি শুধুমাত্র ভ্রমণ নিয়ে লিখি রাজনীতি বাদ দিই- আমার ফলোয়ার দৈনিক হাজারে হাজারে বৃদ্ধি পাবে।
 
কিন্তু আমি ‘ডিপ্লোমেসী’ করি না।
দেশের সাধারণ মানুষগুলির সংগে অতি সাধারণ থাকতে চাই। কেউ আমাকে বাজে কমেন্ট করলে মাঝে মাঝে হালকা উত্তরও দিই। অবশ্য গালি এড়িয়ে চলি- শিখিনি ওটা।
 
এবং লাইক চাই না, ফলোয়ার সংখ্যা নিয়ে চিন্তিতও নই। আমি চাই মানুষ সত্য শিখুক এবং সত্য সাহসের সংগে উচ্চারণ করুক। সচেতন হোক, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হোক। দেশের প্রতিটি মানুষ দু’বেলা শুধুমাত্র ডাল-ভাতে নয়- পর্যাপ্ত পরিমাণ আয় করবে, ভালো থাকবে এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করবে। শক্তিশালী একটা অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়াবে আমাদের বাংলাদেশ। এবং এটা খুবই সম্ভব। কেউ গরীব থাকবে না। কোটি কোটি মানুষের অতি ক্ষুদ্র দেশে কৃষি নয় শিল্প বিপ্লব ঘটাতে হবে। মানুষকে কর্মক্ষম করতে হবে।
 
এরচে বেশী আমার কোন চাওয়া নেই।
 
আমি কিছু নিয়মিত কাজ করি। প্রতি মাসেই নিয়ম করে একবার হলেও কয়েকজন ‘চালাক’ ব্যক্তির ফেসবুক প্রফাইল ভিজিট করি। এরমধ্যে ইমরান এইচ সরকারসহ আরও কয়েকজন।
 
একবার ইমরান এইচ সরকারের একটা কমেন্ট রিপ্লে পড়েছিলাম, ‘ফলোয়ার বা সমর্থক বাড়ানোর জন্য আমাকে তো কিছু পলিসি গ্রহন করতেই হয়ে- কে না চায় জনপ্রিয় হতে?’
 
ওখানে আমি একজন ‘নষ্ট মানুষ’ হওয়ার মুলমন্ত্র খুঁজে পেয়েছিলাম।
 
কিন্তু তারচেও বেশী হতবাক হই যখন দেখি হাজার হাজার নয়, লাখো লাখো সাধারণ মানুষও- যে ইমরান সরকার ও তাদের নেতিবাচক কাজকর্মকে ঘৃণা করে, ইমরানকে নিয়ে ট্রল করে- তারাও তার প্রফাইলে লাইক দিয়ে ‘ফলোয়ার সংখ্যা’ বাড়িয়ে তাকে কথিত সেলিব্রেটি বানিয়ে রেখেছে! তার লেখায় তাকে গালি দিয়ে তার ইমপর্টেন্সী বাড়াচ্ছে।
 
কি দরকার?
 
যাকে আপনি পছন্দই করেন না- তাকে কেন ফলো করবেন? তার ডিপ্লোমেসীর শিকার কেন আপনি হবেন?
 
অসংখ্য ভালো মানের মানুষ এবং লেখক রয়েছেন সোসাল মিডিয়াগুলোতে। তাদের ফলো করুন। তাদের উৎসাহ দিন। নিজে চর্চা করুন ভালো লেখক হবার বা ভালো ভালো শিক্ষনীয় পোষ্ট দিতে। ডিপ্লোমেসীর দরকার নেই; সরলভাবে।
 
ইমরানদের মতো নষ্ট মানুষদের আবির্ভাবের সময় বা তারপর আমি কোনদিনও শাহবাগে পা রাখিনি, ওখানে যে নষ্টামী হচ্ছে সেটা আমি ডে-ওয়ানেই পরিস্কার ছিলাম। যাদের নিয়ে দেশের নষ্ট মিডিয়াগুলি ব্যস্ত তারা যে নষ্ট এটা হিসাব করার জন্য ডিপ্লোমেটিক হবার দরকার নেই- সামান্য যোগ বিয়োগ করলেই বোঝা যায় বেশ।
 
বাংলাদেশের সহজ সরল সাধারণ মানুষদের জন্য সুন্দর একটা জীবন চাই। আর এজন্য আমাদের মতো সকল সাধারণ মানুষদেরই কাজ করতে হবে।
 
দেশের সাধারণ মানুষদের সংগে সকল প্রকার ডিপ্লোমেসী বন্ধ হোক।
   Send article as PDF