হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের কথা

তখন রাত প্রায় দেড়টা।
গ্রান্ড এভিনিউ থেকে ই ট্রেনে উঠলাম।
এক্সপ্রেস ই ট্রেন এতো রাতে লোকল লাইনে চলছে।
 
কামড়াগুলি খালিই অনেকটা।
 
আমি একটা সিটে বসলাম। প্রায়ই ফাঁকা। আমার পাশে একজন স্পানিশ।
অপর পারে একজন মহিলা এবং সংগে একটা ১৪-১৫ বছরের মেয়ে বসা।
 
মেয়েটা খুব ফর্সা। চিপস্ খাচ্ছে এবং তার মাকেও নিজে থেকে তুলে দিচ্ছে। খুব বেশী কথা বলছে এবং খুবই অস্থির আচরণ করে যাচ্ছে।
 
এ বয়সী কিশোরী মেয়েদের অস্থিরতায়ই বেশী মানায়।
 
আমি আইপ্যাডে ফেসবুক ওপেন করলাম। এমনিতে সাবওয়ে ট্রেনে শুধুমাত্র স্টেশনগুলিতে ফ্রি ইন্টারনেট পাওয়া যায়। কিন্তু চলতি পথে কানেকশন থাকে না। তবে, আমার টি-মোবাইল এর সীমকার্ড অনেক সময়ই সাবওয়েতেও ভালো ডাটা কানেকটিভি দেখায়।
 
আজও দেখাচ্ছে।
আমি স্মোথলি নেট পাচ্ছি।
 
হঠাৎ খেয়াল করলাম সেই ছোট মেয়েটি বারবার আমার দিকে কি যেন লক্ষ্য করছে- আমার চোখ ওর দিকে গেল।
 
সে আমাকে হাসি মুখে ‘হাই’ বললো।
আমিও মুখে হাসি যোগ করে মাথা ঝাকালাম।
 
আবারও ফেসবুকে মন দিয়েছি।
মেয়েটা এবার আমাকে ভাংগা ইংলিশে বলল, ‘তুমি চিপস নাও’।
 
আমি একটু মজাই পেলাম।
এমনিতে অপরিচতরা আমেরিকায় কেউ কাউকে কোন খাবার অফার করে না।
 
এটা আমেরিকায় অনেকটা অলিখিত নিয়ম।
এমনকি বাড়ীতে গেষ্ট আসলেও রেষ্টুরেন্ট থেকে খাবার অর্ডার করে এনে খাওয়ানোর নিয়ম এখানে প্রচলিত।
 
কিন্তু মেয়েটা আমকে খাবাার অফার করাতে আমি একটু থমকে গেলাম। হোক সেটা প্যাকেটজাত খাবার, আমি তো অপরিচিত।
 
মেয়েটার দিকে ভালো করে দৃষ্টি দিলাম।
মুখের ইশারায় ধন্যবাদ দিয়ে না-সূচক হাসি দিলাম।
 
মেয়েটাকে এবার লক্ষ্য করলাম ভালোমতো। ওর মা’কেও।
চেহারা এবং পোষাকে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট।
 
আমেরিকায় দরিদ্র লোকজন নেই বললেই চলে।
মেয়েটা ইংরেজী জানে না। অবশ্য আমেরিকায় অনেক স্পানিশ-ই ইংরেজী শিখে না।
 
আমার পর্যবেক্ষন বলে দিচ্ছে মেয়েটার ফ্যামেলী ‘নিউ ইমিগ্রান্ট’। সম্ভবতঃ সম্প্রতি ল্যাটিন আমেরিকা থেকে ইউনাইটেড স্টেটস এ ঢুকেছে। এখনও নিজেদের ঠিক-ঠাক মাথা গোজার স্থান করে নিতে পারেনি।
 
আর তাই তাদের এই মধ্য রাতেও জীর্ণ পোষাকে ট্রেনে বসে চিপস খেতে হচ্ছে।
 
মেয়েটা আবারও আমার দিকে ঘনঘন দৃষ্টি দিচ্ছে।
কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। হয়তো ভাষার সীমাবদ্ধতার জন্য বলতে পারছে না।
 
ল্যাক্সিনটন সিক্সটিথার্ড ষ্টেশনে ট্রেন চলে আসলো। আমি ট্রান্সফার নিবো সিক্স ট্রেন এ।
 
মেয়েটার দিকে নিজেই তাকালাম, দেখলাম ও তাকিয়েই রয়েছে আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে। কি যেন সে আমাকে বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। আমার খুব মায়া হলো মেয়েটার জন্য।
 
‘গুড নাইট’ বলে হাসি দিলাম।
ওও ‘গুড নাইট’ বলল।
 
আমি যখন গেট থেকে বের হয়েছি লক্ষ্য করলাম ও এবার গেটের সামনে চলে এসে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করলো।
 
ট্রেনের গেট বন্ধ হবার মুর্হূতে খুব মিষ্টি উচ্চারেণ মেয়েটি বলে উঠলো, ‘আসসালামুআলাইকুম’।
আমি সালামের উত্তর দিতে দিতে ট্রেনটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
 
আমি চমকে উঠলাম!
এতো মানুষের ভীড়ে আমাকে সে মুসলিম বলে আইডেন্টিফাই করলো কিভাবে?
 
দুই।
 
আমি তখন অনেক ছোট।
ক্লাস নাইন-টেন এর ষ্টুডেন্ট হবো। হয়তো এই মেয়েটার বয়সীই তখন।
 
ভুগোল বইয়ে তখন আমি এই বিশাল পৃথিবী সম্পর্কে জানতে পারছি। গ্লোবে বিশ্বের দেশগুলি দেখি, শহরগুলির নাম জানার চেষ্টা করি।
 
বাংলাদেশের ঠিক অপজিটের দেশটি হলো পেরু।
পেরুর রাজধানী লিমা।
 
পেরুর ঠিক পুবেরই দেশ বলিভিয়া। দেশটার প্রতি আমার একটা তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি হলো।
 
কল্পনায় প্রায়ই আমি বলিভিয়া ভিজিট করতাম।
জানি না কি এক অজানা মোহ আমাকে পেয়ে বসেছিল তখন।
 
ভাবতাম, আমি লা-পাজ এর কোন এক গ্রামে বেড়াতে গিয়েছি।
 
কাঁচা মাটির রাস্তা সেখানেও। রাস্তাটা অনেক দূর চলে গিয়েছে। কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানিতে কাদা জমে রয়েছে। দু’পাশে বড় বড় গাছ। একটু পর পর বাড়ী-ঘর।
 
একটা ছোট মুদি দোকান।
স্থানীয় ছেলে-মেয়েরা রাস্তায় আড্ডা দিচ্ছে।
 
কেউ কেউ খেলছে।
দারিয়াবাধা বা গোল্লাছুটের মতোই কোন স্থানীয় গ্রাম্য খেলা।
কিংবা ডাংগুটি।
 
আমি দাড়ালাম।
অন্যরা আমাকে দেখছে উৎসুক দৃষ্টিতে।
 
আমি তো দেখতে ওদের মতো নই।
আমি ওদের ভাষা জানি না।
 
আমার পোষাক ভিন্ন।
আমরা ভাষার বিনিময় করতে পারি না।
 
আমি ওদের দেখি, ওরাও আমাকে দেখে।
আমাদের কথা হয় চোখে চোখে।
 
দোকান থেকে আমি কোন স্থানীয় খাবার কিনে খাচ্ছি, নাম জানি না, খাবার আগে টেষ্ট কেমন হবে তাও জানি না। তবও খাচ্ছি খুব আনন্দ নিয়ে।
 
এরই মধ্যে দুটো ছেলে তাদের ছোট পিচ্চি বোনটাকে নারকেল পাতায় তৈরী খেলনা গাড়ীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দৌড়ে।
 
আমি এই পৃথিবীর দু’প্রান্তের মিলগুলি খুঁজে ফিরছি।
 
সামনে একটা ছোট নদী।
একদল ছেলে-মেয়ে নদীতে গোসল করছে, কি যেন খেলছে দু’গ্রুপে ভাগ হয়ে।
 
৩-৪টি ছেলে আমার সামনে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাপ দিল সেই নদীতে।
 
আমিও ছুটলাম ওদের পেছন পেছন দৌড়ে।
 
নদীতে ঝাঁপ দিলাম।
 
আমার এই স্বপ্নটি অপূর্ণই থেকে গেল।
 
সামনে হয়তো যাবো কোনদিন সেই বলিভিয়ার লা-পাজে।
বেড়াবোও ঠিক ওইভাবেই।
 
কিন্তু আমার সেই ছোটবেলার সেই আবেগ আর খুঁজে পাবো না।
 
ওই মেয়েটা হয়তো বলিভিয়ার কোন এক গ্রাম থেকে তার মা’র হাত ধরে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য ইউনাইটেড ষ্টেটস এর পাড়ি দিয়েছে।
 
এসেছে নিউ ইয়র্ক অবধি।
 
অাচ্ছা, ঐ মেয়েটি কি জানে আমার সেই কৈশরের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের কথা?
 
হয়তো বা হ্যা।
হয়তো বা না।
 
আমার আর জানার সুযোগ হবে না।
   Send article as PDF