সময় কৈ?

হিন্দী ভাষাটা অামি বুঝি, বলতেও পারি।

কিন্তু, কখনোই বলি না। 
এবং যে-কোন হিন্দীভাষীর সংগেই, এমনকি ভারত বর্ষে গিয়েও ‘শুধুমাত্র ইংলিশে’ কথা বলি।

কেউ হিন্দীতে কথা বললে বা বলতে চাইলে সরাসরি বলি ‘সরি, ইংলিশ প্লিজ’।

আমার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা. আনন্দ মিশ্রা ও ডা. এমএলবি ভাট কিভাবে যেন ধরে ফেলতেন যে আমি হিন্দী বুঝি। কিন্তু আমি যেহেতু হিন্দীতে মোটেও আগ্রহী নই, সেহেতু ওনারাও কখনওই আমার সংগে হিন্দী বলতেন না।

আসলে, নিজেদের এই ভাষার প্রতি ‘ভালবাসা’র বিষয়টি আমি রপ্ত করেছি চায়না থেকে।

অল-চায়না ইয়্যূথ ফেডারেশন এর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রিয় সফরে যাই চায়নাতে সেই ২০০৫ সালে। চায়নাতে একটাই মাত্র রাজনৈতিক দল, সিপিসি বা কমিউনিষ্ট পার্টি অব চায়না। আর ‘অল-চায়না ইয়্যূথ ফেডারেশন’ হলো চায়নার ‘যুব মন্ত্রণালয়’।

তো, সেই সফরে সিপিসি’র অনেক বড় বড় আঞ্চলিক ও ক্যাপিটাল বেইজিং এ বেশ কয়েকজন ক্ষমতাধর কেন্দ্রিয় নেতাদের সংগে আমাদের আলোচনা, মিটিং, সিম্পজিয়াম হয়েছে।

সেই সব মিটিংগুলির পর ও আগে পার্সোনলী আমাদের সংগে পরিচিত হতেন চাইনিজ সেসব নেতারা। তারা খুব চমৎকার ইংলিশ বলতেন আমাদের সংগে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়।

কিন্তু সেই একই মঞ্চে ওনারা যখন আমাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতেন- তখন সরাসরি চাইনিজ ভাষাতে কথা বলতেন এবং একজন ইন্টারপ্রেটর তা ইংলিশে অনুবাদ করে দিতেন।

বিষয়টা কুনমিং এ যেভাবে লক্ষ্য করেছি, ঠিক একই রকম লেগেছে সিচুয়ানের চেংগুতে এবং বেইজিংএও।

আমাদের কো-র্ডিনেটর টাং হাও’কে জানতে চাইলাম কেন তারা এমনটা করে?

টাং হাও হাসতে হাসতে বলতেন, ‘এটাই আমাদের ষ্টাইল’।

ঐ স্টাইলটা আমার সত্যিই বেশ মনে ধরেছিল।

বহুবার ভারতবর্ষ ভ্রমণের গেটওয়ে হিসাবে কোলকাতা ভ্রমন করতে হতো প্রচুর। কোলকাতা শহরটা আমার কাছে ঢাকার মতোই অতি পরিচিত, ওর প্রায় প্রতিটি অলিগলিই আমি চিনি। কোলকাতা আমার অতি প্রিয় শহরও।

ঐ কোলকাতায় আঞ্চলিক বাংলা ভাষাটা খুবই ষ্ট্রেট-কাট এবং অনেকটা রুক্ষ। প্রচুর পরিমানে হিন্দী শব্দ ও টাং ওখানকার বাংলায় ঢুকে পরেছে। মজার বিষয়টা হলো ওই ভাষাটা আমি বেশ চমৎকারভাবেই বলতে পারি।

কোলকাতায় কেউ আমার সংগে কথা বললে বুঝতেই পারে না যে আমি কোলকাতার বাইরের কেউ কি-না?

ব্যাপারটা আমিও বেশ এনজয় করতাম।

তবে, ওদের সংগে মিশে একটা বিষয় বেশ ভালই বুঝতে পারতাম যে, কোলকাতা নিরেট বাঙালীবাবুদের শহর নয়। অসংখ্য বিহারীসহ অন্যান্য প্রদেশের লোকজন ঐ শহরে বসবাস করে এবং একটা মিশ্র কালচারের কারণেই ওখানকার ভাষাটার এমন দুর্দশা।

ওখানকার ‘প্রকৃত বাঙালী’ বাবুদের ভাষা কিন্তু অতটা রুক্ষ না। আঞ্চলিক নিজস্বতা থাকলেও এবং অল্প কিছু স্বাতন্ত্র নিয়েও বাংলাটা বেশ ভালই টিকে রয়েছে পশ্চিম বংগে। এবং এটা বেশ বোঝা যায়, কোলকাতার বাইরের শহরগুলিতে গেলে। বিশেষত শিলিগুড়ি বা উত্তর বা দক্ষিন ২৪ পর্গনা এমনকি মেদেনীপুর গেলেও। অবশ্য আসানসল বা বর্ধমানের বাংলাটা আবার যথেষ্ঠ আঞ্চলিক ও বিহারী ঘেঁষা।

তবে, কোলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশীদের বাংলায় কথা না বলাটাই বেশী বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

ওরা খুব সহজেই মুখের ভাষার ব্যবহারে বাংলাদেশীদের বুঝে ফেলে এবং অত্যন্ত নীচু দৃষ্টিতে দেখে আমাদের দেশের মানুষদের। যা-তা আচরণও করে সুযোগ পেলে।

ভুল-ভাল হিন্দী বলা তো আরও হাস্যকর!

সবচে ভালো ভুল হয়- ইংলিশে মনের কথাটা বোঝাতে চেষ্টা করবেন; এটাকে ওরা সম্মান করে।

কেউ ইংলিশে কথা বললে ওরা তাকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে।

এবং একটি বিষয় লক্ষ্য রাখা খুবই উচিত যে, কোলকাতার মানুষদের কর্মকান্ড ও আচার-ব্যবহার দেখে বিশাল ভারতবর্ষকে কখনোই মেপে ফেলতে যাবেন না। ভারতবর্ষ সত্যিই অনেক বিশাল।

প্রতিবেশীর সংগে তাদের রাজনৈতিক আচরণ খুবই বাজে, বিরক্তিকর ও দাদাগীরিযুক্ত কিন্তু ওভারঅল দেশ হিসাবে ভারতবর্ষ সত্যিই অসাধারণ।

বাংলাদেশ থেকে যারা চিকিৎসার জন্য কোলকাতাকে বেছে নেয়- তাদের বলবো, ঢাকাতেই চিকিৎসা নিন। কোলকাতা এখনও আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি, ততটা সভ্য তো নয়ই।

আর যদি সত্যিই বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা পেতে চান তাহলে সাউথ ইন্ডিয়া, মুম্বই বা দিল্লী যান। কোলকাতা না।

চায়নাতে ভ্রমনে মাত্র দু’টি প্রব্লেম।
এক ভাষা এবং দুই খাবার।

চায়নিজরা ইংলিশ জানে না। জানে না মানে জানেই না। জানার কোন প্রয়োজনও নেই ওদের।

বেইজিং এ একবার আমি একটা ঠিকানা খুঁজছি, ট্যাক্সি ড্রাইভারও ঠিকানাটা বের করতে পারছে না। অবশেষে রাস্তার পাশে গাড়ী পার্ক করলো। একজন কমপ্লিট স্যুট পরা ভদ্রলোক। আমি গাড়ী থেকে নেমে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি ইংরেজী জানো?’

ভদ্রলোক উত্তর দিল, ‘ইয়েজ, আই ইংলিশ!’
এই হলো চায়নার ইংলিশের অবস্থা।

স্যাংহাইতে ম্যাকডোনাল্ডস খাবার পর একদিন আমার ভ্রমনসংগী কায়কোবাদ ভাইয়ের শুরু হলো ডায়রিয়া। সে এক ভয়াবহ ডায়রিয়া। তাকে সংগে করেই নিয়ে গেলাম একটা ফার্মেসীতে। ডাক্তার রয়েছেন বেশ কয়েজন কিন্তু ইংরেজী বুঝে না। স্ট্যাফদের মধ্যেও কেউ ইংরেজী জানে না।

সে এক মর্মান্তিক অবস্থা। রোগী আছে, ওষুধ আছে, ডাক্তারও আছে, নার্সও আছে কিন্তু শুধুমাত্র ভাষার জন্য চিকিৎসা হচ্ছে না।

আমি ইশারা ভাষায়ও অনেকভাবে চেষ্টা করে কিছুই বোঝাতে পারলাম না।
চায়নিজরা আমাদের ইশারা ভাষাও বুঝে না- সেটা আমি অনেকবার লক্ষ্য করেছি।

যাই হোক, অবশেষে কোন এক স্ট্যাফ ফোন করে একটা মেয়েকে ডেকে আনলো মিনিট দশেক পর।

সেই চাইনিজ মেয়েটা টুকটাক ইংলিশ বলতে পারে।
আমি তাকে ডায়রিয়ার কথাটা বললাম। সে ডাক্তারের সংগে আলাপ করে ওষুধ দিল।

বিল মিটিয়ে আসার সময় সেই মেয়েটাকে বললাম, ‘আচ্ছা, তোমাদের দেশে এত এত বিদেশীরা আসে- তাদের জন্য হলেও তো তোমরা ইংলিশটা শিখতে পারো- না কি?’

মেয়েটি বিন্দুমাত্র ইতস্তত না হয়েই আমাকে উত্তর দিল, ‘তারচে বরং এটাই ভালো না যে তোমরা চায়নিজ শিখেই চায়নাতে আসো! আমাদের ইংলিশের কোন দরকার নেই। কোন বিদেশী ভাষারই কোন দরকার আমাদের নেই। তাছাড়া ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস দেখভােলের জন্য ইংরেজী জানা স্টাফ আমাদের দেশে অনেক রয়েছে- ওতেই আমাদের চলে যায়।’

আমি কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না।

হংকংবাসীরাও ইংলিশ জানেনা বললেই চলে।
দীর্ঘ শত বৎসর এরা বৃটিশ কলোনী হিসাবে থাকলেও ইংলিশটা গ্রহণ করেনি।

ওয়েন চাই সাবওয়ে ষ্টেশন থেকে বের হয়ে যে অফিসে যাবো সেই ঠিকানা খুঁজছি। কিন্তু গোলমাল বাঁধিয়ে ফেললাম। রাস্তাঘাটে কেউ-ই ইংলিশ জানে না।

অনেককে প্রশ্ন করার পর একজনকে পাওয়া গেল, ভদ্রলোক খুবই ব্যস্ত ভংগিতে হাঁটছিলেন। আমি তাকে ঠিকানা বের করে দেখাতে উনি একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন আর আমার মুখের দিকে একবার।

আমার মুখেরই জয় হলো।
ওনি আমাকে প্রায় মিনিট ১০ হেঁটে কোন সব অলি-গলি দিয়ে সেই অফিসের লিফটের সামনে পৌছে দিয়ে তারপর নিজেই উল্টো ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলেন।

মালয়েশিয়া সিংগাপুর থাইল্যান্ড বা ইন্দোনেশিয়া ফিলিপিন্সে সকলেই বলতে গেলে ইংলিশ জানে, বুঝে বলতে পারে। কোন সমস্যা হয় না। লাউস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামেও কোন সমস্যা হয় না।

যত সমস্যা সব হয় আমাদের বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের মানুষ ইংরেজী জানে না। রাষ্ট্র এবং শিক্ষা ব্যবস্থাও চায় না যে দেশের মানুষ ইংরেজী শিখুক।

জীবনে শত শত বার বিদেশ ভ্রমণের সময় প্রতিবারই ডিপার্চার ও এরাইভাল এর সময় কম করে হলেও ১০/১২ বিদেশ যাত্রী শ্রমিককে আমি তাদের ডিপার্চার কার্ড পূরণ করে দিতাম। অতি সামান্য একটা বিষয়- কিন্তু এরা জানে না।

অথচ এই অসহায় দরিদ্র মানুষগুলি-ই দেশের ফরেন রিজার্ভ দিনকে দিন ভারী করে দিচ্ছে; সবচে বড় অবদান রাখছে দেশের অর্থনীতিতে।

শুনেছি এদের অনেককেই ট্রেনিং দেয়া হয়- অথচ এই অতি সামান্য ডিপার্চার বা এরাইভাল ফর্মটি পুরণ করা শিখানো হয় না।

সিংগাপুর, মালয়েশিয়া যতবার ল্যান্ড করেছি- ইমিগ্রেশন এর সামনে অসহায় অনেক বাংলাদেশীকেও তাদের ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করে দিতাম। এমনকি ওদের মধ্যে চালু কাউকে পেলে তাকে শিখিয়ে দিতাম অন্যদেরটাও পুরণ করে দিতে হয় কিভাবে।

ভারতবর্ষের যে-কোন রিক্সা বা অটো-চালকও চালিয়ে নেবার মতো ইংরেজী বলতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই শিক্ষাটুকুরও পরিবেশ নেই।

বাংলাদেশী বিদেশ গমনেচ্ছুক শ্রমিকদের জন্য যথাযথ ট্রেনিং ও প্রয়োজনীয় ইংলিশ শিক্ষাটা বাধ্যতামূলক করে অনায়াসেই অনেক ভালো বেতনের চাকুরীতে বিদেশে পাঠানো যায়।

কিন্তু এদেশের কোন সরকার তো- কোনদিনও এসব নিয়ে ভাববে না।

তাছাড়া কি-ই বা লাভ এসব ফালতু বিষয় নিয়ে ভাববার?
এত ভাবা-ভাবী করলে চুরির ভাগে কম পরে যাবে না?

সময় কৈ?

   Send article as PDF