ব্যবসার যাত্রা কাল

ব্যবসায়িক বাস্তবতার বিচারে তখনও আমি পোলাপান।
ঢাকার পান্থপথে আমার অফিস। বিদেশের সংগে টুকটাক ব্যবসা শুরু করেছি।
 
সিটিসেলের সংগে ৫০০ সিডিএমএ টেলুলার সেটের একটা অর্ডার নিয়ে কথা চলছে।
দক্ষিন কোরিয়ার দু’টো কোম্পানীর সংগে আমার যোগাযোগ হলো- ওরা সিডিএমএ টার্মিনাল তৈরী করে। দাম-দরও টিক হলো। স্যাম্পল আনলাম দুই কোম্পানী থেকেই।
 
৫০০ সেটের জন্য বড় বিনিয়োগ করতে হবে।
আব্দুর রাজ্জাক মামা, পলাশ ভাই আর আমি আলোচনা করছি কিভাবে টাকাটা বিনিয়োগ করা যায়। রাজ্জাক মামাই বললেন ডা. শামীম মামার কথা। ডা. শামীম মামা এখন সিকদার মেডিকেল এর প্রিন্সিপাল; তখন তিনি এক যুগ সৌদী আরবে সরকারী চাকুরী শেষ করে দেশে ফিরেছেন- হাতে অনেক নগদ টাকা। ডা. শামীম আবার অধ্যাপক আবু সাঈদের আপন ভাই। যাই হোক ডা. শামীম মামা পুরো টাকাটাই বিনিয়োগ করবেন।
 
তিনিই বললেন, ‘মামা চলেন আমরা কোরিয়া গিয়ে কোম্পানীটা ভিজিট করে আসি আগে’।
 
খুবই ভালো প্রস্তাব। যুক্তিযুক্তও।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম কোরিয়া যাবো।
 
কিন্তু কোরিয়ার ভিসাতো আর চাইলেই পাওয়া যায় না, তাছাড়া আগেই তো বললাম যে তখনও আমি পুলাপান-ই বলতে গেলে।
 
কোরিয়ান দুই ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানীকেই ইমেইল দিলাম, ‘তোমাদের দেশে তোমাদের ফ্যাক্টরী দেখতে আসছি- ইনভাইটেশন লেটার পাঠাও’।
দুই কোম্পানীই খুব খুশী। বড় ব্যবসায়ী আসছে, চট জলদি আমাদের নামে ইনভাইটেশন লেটার রেডি করে আমার ফেডারেল এক্সপ্রেস এর একাউন্টে ডিপোজিট করে দিল, ২ দিনের মধ্যেই পেয়ে গেলাম হাতে।
 
পরদিন সকালে আমার ম্যানেজার-কে পাঠালাম সকল প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র রেডী করে গুলশানে দক্ষিন কোরিয়ান এম্বাসীতে ভিসার জন্য জমা দিতে।
 
ম্যানেজার দুপুরে সকল কাগজ পত্র নিয়ে ফিরে আসলো। বলল, ‘স্যার, আপনার পাসপোর্টে মেয়াদ আছে আর মাত্র ৭ মাস। এই পাসপোর্টে তো ওরা ভিসা দিতে পারবে না। তাছাড়া আপনি টিন সার্টিফিকেট দিয়েছেন কিন্তু ওদেরকে লাষ্ট ইয়ারের ট্যাক্স রিটার্ণ সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। আমি বলে এসেছি পরশু দিনই সবকিছু জমা দিয়ে দিবো।’
আমি বললাম, ‘বেশ ভালো করেছেন- তো পরশুদিন আমি এতো কিছু কোথায় পাবো।’
 
আমার ম্যানেজার মিষ্টি করে হাসলো।
আমার কোম্পানীতে চাকুরী করা সকল স্ট্যাফদের মধ্যে কামরুজ্জামান ছেলেটাকেই আমি সবচে বেশী পছন্দ করতাম। অত্যন্ত অবিডিয়ান্ট একটা ছেলে। তাকে কোন অর্ডার করতে হতো না। সবকিছুই নিজে থেকে বুঝে ফেলতো। আমাকে বা আমার ডিসিসান ছাড়াও সে আমার কোম্পানীর জন্য অনেক অনেক লাভজনক কাজ সে করে ফেলতো।
 
ছেলেটার দ্বারা আমার কোম্পানীতে কোনদিনও একটি টাকাও লস গুনতে হয়নি। খুব মিস করি কামরুজ্জামান কে। ভদ্র, সৎ এবং বুদ্ধিমান।
 
কোরিয়ান এম্বাসী বড় কথা না। বড় কথা হলো আব্দুর রাজ্জাকের মতো একজন মানুষ ডা. শামীমের কাছে আমাকে ‘বড় কথা’ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তার কাছে তো ছোট হওয়া চলবে না।
 
মাথা খাটালাম খুব দ্রুত।
পরদিন সকালে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে পুরাতন পাসপোর্টটি সাথে করে চলে গেলাম। আমি জানি কোন অফিসার দিয়ে কোন কাজ হয় না। ভালো ও যুতসই দালাল খুঁজে পতে হবে। এবং পেয়েও গেলাম- জাকির ভাইকে। রোকেয়া স্মরনীতে তার একটা ফার্নিচারের দোকান, পাসপোর্ট অফিসে পার্টটাইম দালালি করে।
 
আমি খুব দ্রুত মানুষকে পড়তে পারি। দু’তিনটা কথা বলেই বুঝে ফেলি সে কেমন, কি করার ক্ষমতা রাখে। জাকিরকে আমার খুব পছন্দ হলো। সে আমাকে আজ সন্ধ্যার মধ্যেই নতুন পাসপোর্ট রেডী করে আমার অফিসে পৌছে দেবে।
 
কথা চুড়ান্ত হলো।
কাগজ পত্র, টাকা পয়সা বুঝিয়ে সোজা চলে গেলাম সেগুন বাগিচায় আমার একজন পরিচিত ট্যাক্স অফিসের কর্মচারী (সম্পর্কের দুলাভাই) শরীফ সাহেবের কাছে। সবটা শুনলেন। আমাকে হালকা বকাও দিলেন বোকামীর জন্য। ট্যাক্স অফিসে নাকি অনেক সুবিধা! তার সংগে আগে যোগাযোগ করলে- আমাকে ‘অনেক কিছু’ করে দিতে পারতেন।
 
যাই হোক, আমার তো ‘অনেক কিছু’র দরকার ছিল না- আপাতঃ প্রয়োজনটুকুই বড়।
 
ওনি বললেন, ‘কবে লাগবে তোমার রিটার্ণ সার্টিফিকেট?’
আমি বললাম, ‘আজই’ এবং ‘ব্যাক ডেটেড’।
 
ভদ্রলোক মাথা চুলকালেন। বললেন, ‘টাকা নিয়ে আসছো? ক্যাশ তো?’।
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
বললেন, ‘ওকে, দাও টাকা দাও। ছবি দাও’। কয়েকটা কাগজ দিলেন- ‘সিগ্নেচার দাও’।
 
চা আনালেন। খেলাম।
ঘন্টা দেড়েক সময় নিলেন।
 
যাই হোক, এই দেড়-দু’ঘন্টা সময়ের মধ্যেই উনি সোনালী ব্যাংকে ব্যাক ডেটে টাকা জমা করালেন, কাগজপত্র রেডী করলেন, স্বাক্ষার করালেন এবং আমার হাতে ৫ মাস আগের ডেটের অরিজিনাল ‘ট্যাক্স রিটার্ণ সার্টিফিকেট’ ধরিয়ে দিলেন।
 
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দুপুরের লান্স করলাম!
তারপর আবার অফিসে গেলাম। জাকির সাহেব কামরুজ্জামানের সংগে গল্প করছে আর চা-কুকিজ খাচ্ছে। আমাকে সালাম দিল।
 
আমার চেম্বারে আসতে বললাম। নতুন পাসপোর্ট হাতে নিয়ে সে ঢুকলো।
 
১ দিনের মধ্যেই সব পেপারস রেডী- কোরিয়ান এম্বাসীর ডিমান্ড মতো।
 
পরদিন সকালে ম্যানেজার কামরুজ্জামান আবারও চলে গেল কোরিয়ান এম্বাসীতে এবং কথামতো সেই অফিসারের হাতে সকল পেপারস জমা দিল। রিসিপ্ট নিয়ে অফিসে ফিরে এলো।
 
কোরিয়ান এম্বাসী সাধারণতঃ ৪-৫দিন সময় নেয় ভিসা দিতে। সত্যি বলতে কি আমি একটু চিন্তায়ই ছিলাম- আদৌ ভিসা দেবে তো! আমার ঝুড়িতে তখন মাত্র কয়েকবার ইন্ডিয়া, নেপাল আর হংকং এর ট্রাভেল করা।
 
ভাবছি দেখা যাক কি হয়!
 
২ দিন পর বুধবার বিকেলে একটা ফোন আসলো গুলশানের কোরিয়ান এম্বাসী থেকে আমার অফিসের ল্যান্ড নাম্বারে। রিসিপ্টশন থেকে আমাকে ট্রান্সফার করে দিল।
ওপ্রান্ত থেকে ইংলিশে বললেন, ‘তুমি আগামীকাল সকাল ১১টায় এম্বাসীতে আসবে, তোমার ইন্টারভিও নিবো’।
আমি বললাম, ‘পারবো না।’
 
ওপান্তের কোরিয়ান অফিসার ভদ্রোলোক সম্ভবত হতভম্ব হয়ে গেল আমার কথায়! ‘মানে, তুমি কোরিয়া যাবে না?’
আমি বললাম, ‘অবশ্যই যাবো। যাবো বলেই তো ভিসার এপ্লিকেশন জমা দিয়েছি’।
‘তাহলে, ইন্টারভিও দিবে না কেন?’
‘আমি ইন্টারভিও দেবো না- সেটা তো বলিনি। এখন বিকেল চারটে বাজে। তুমি আমাকে ফোন দিয়ে বললে- কাল সকালেই তোমার ইন্টারভিও! বলি- আমি তো কাজ করে খাই, বেকার তো না। প্রচুর ব্যস্ততা আমার। আমি তোমাকে কাল সময়ই দিতে পারবো না। সরি।’
ভদ্রলোক ঠান্ডা হলেন বুঝতে পারলাম। খুব ভদ্রভাবে বললেন, ‘অাচ্ছা, আমি সরি। তো, তুমি কবে আসতে পারবে আমাকে বলো।’
আমি এবার হেসে দিয়ে বললাম, ‘থ্যাংক য়্যূ। আমি তোমাকে রবিবার, ফাষ্ট ওয়ার্কিং ডে- ওদিনও পারবো না। মানডে-তে আমি সকালে আসতে পারবো।’
 
ভদ্রলোক ‘গুগ-বাই’ বলে ফোন রেখে দিলেন।
 
সোমবার সকালে কোরিয়ান এম্বাসীতে গেলাম। ভিসা অফিসার আমাকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমাকে তেমন কোন প্রশ্নই করলেন না, শুধু বললেন, ‘আসলে- তোমাদের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে, তোমরা ভালো ব্যবসায়ী। কিন্তু আমি কিভাবে বুঝবো আমার দেশের যারা তোমাকে ইনভাইটেশন লেটার দিয়েছে- ওরা জেনুইন কোম্পানী?’
 
দুর্দান্ত পয়েন্ট!
 
আমি হেসে দিলাম। বললাম, ‘তোমাকে কিভাবে প্রমাণ দিতে পারলে তুমি সন্তুষ্ট হবে- যে, ওরা জেনু্ইন কোম্পানী?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমার কাছে কি ওদের কোন প্রডাক্ট এর ব্রশিউর আছে, দেখাতে পারবে?’
‘শুধু ব্রশিউর না, ওদের তৈরী করা সিডিএমএ এফডব্লিওটি, ক্যাটাগল ইত্যাদি সবই আমি স্যাম্পল হিসাবে কুরিয়ারে আনিয়েছি। তুমি চাইলে তোমাকে সবকিছুই দেখাতে পারবো। কিন্তু ওসব তো আমার সংগে নেই- আমার অফিসে।’
‘ওহ রিয়েলী? ভেরী গুড। আমি তোমাকে আর কষ্ট দেবো না। তুমি যাষ্ট তোমার যে-কোন স্ট্যাফকে দিয়ে ক্যাটালগটা যদি একটু পাঠিয়ে দিতে- তাহলেই আমার সুবিধে হতো; আসলে আমাকেও তো জবাবদিহি করতে হয়।’
‘ঠিক আছে, আমি আমার ম্যানেজ্যারকে দিয়ে ১ ঘন্টার মধ্যেই পাঠিয়ে দিচ্ছি; বাট আমি কিন্তু আর আসতে পারবো না- তুমি ওর কাছেই আমাদের পাসপোর্টগুলি দিয়ে দিবে’।
‘অবশ্যই স্যার। আজই তোমাকে ভিসাসহ পাসপোর্ট দিয়ে দেবো।’
 
আমি বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।
 
মজার বিষয় হলো, সেই সেদিনের পর থেকে এখনও প্রতি বছর কোরিয়ান নতুন কোন আইটি প্রোডাক্ট রিলিজ হলেই কোরিয়ান এম্বাসী থেকে ইমেইল পাই।
কোরিয়ান কোন বিজনেস প্রতিনিধি ঢাকায় আসলে- সোনারগাঁও বা শেরাটনে আমাকে ইনভাইট করে ‘বিজনেস মিটিং’ করার জন্য।
 
ঢাকার ব্যবসায়িক দিনগুলি ভীশন মিস করি।
   Send article as PDF