নেতা ও নেতৃত্ব

মাইকেল হার্ট তার ‘দ্য হান্ড্রেটস’ বইয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী মানুষ হিসাবে ১০০ জনের যে তালিকা করেছিলেন তাতে নাম্বার ওয়ানে রয়েছেন আমাদের প্রফেট মুহাম্মদ (সা)।
 
এরপর ২য় অবস্থানে স্যার আইজ্যাক নিউটন।
তৃতীয় স্থানটি পেয়েছেন যীশু খ্রীষ্ট, ৪র্থ বুদ্ধ, ৫ম কুনফুসিয়াস।
নবম স্থানটি ক্রিষ্টোফার কলম্বাসের এবং দশম স্থানটির মালিকানা আলবার্ট আইন্সটাইনের।
 
মাইকেল হার্ট ক্রমান্বয়ের ইনডেক্সটি করেছিলেন মুলতঃ ‘যোগ্যতম ও প্রভাবশালী’ বিবেচনায়। কাদের দ্বারা এই বিশ্বের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এবং কারা সবচে বেশী আলোচনায় ছিলেন ও বিশ্বের গণমানুষের উপর ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করেছিলেন- সেই বিবেচনাবোধ থেকে।
 
এই বিবেচনায় মহাবিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন এবং আমেরিকার আবিস্কারক ক্রিষ্টোফার কলম্বাসকে যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং নবম স্থান দেয়াটাকে আমি সবসময়ই সমর্থন করি।
 
কিন্তু তারপরও অনেক মানুষই চান যে আলবার্ট আইন্সটাইন এর অবস্থান আইজ্যাক নিউটনেরও উপরে হওয়া। সে যাই হোক, সেটা আমার বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
 
মুলতঃ জার্মান নাগরিক আলবার্ট আইন্সটাইন চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের ইহুদী নিধনের হাত থেকে নিজের জীবন বাঁচাতে জার্মানী থেকে পালিয়ে লন্ডন হয়ে শেষটায় নিউ জার্সীর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে বসবাসের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে আমেরিকার রিফুজি স্ট্যাটাস থেকে গ্রীনকার্ড নিয়ে ১৯৪০ সালে আমেরিকান সিটিজেনশীপ গ্রহণ করেন।
 
আলবার্ট আইন্সটাইনের জ্ঞান ও যোগ্যতা নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে সত্যিই আমার হাত কাঁপছে- ওনার বিষয়ে আমার মতো অধমের কিছু না বলাই বরং শ্রেয়।
 
যাই হোক, ১৯৫২ সালের নভেম্বরে নবগঠিত ইহুদী রাষ্ট্র ইসরেল এর প্রথম প্রেসিডেন্ট মারা গেলে, তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ও সেদেশের কর্তাব্যক্তিরা ইহুদী রাষ্ট্রটির ‘প্রেসিডেন্ট’ পদের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে তৎকালিন সবচে সফল, যোগ্যতম ও জগৎবিখ্যাত বুদ্ধিমান ব্যক্তি হিসাবে আলবার্ট আইন্সটাইন এর নামটি সামনে নিয়ে আসলেন।
 
সেই মতে ওয়াশিংটনস্থ ইসরেলী এম্বাসী থেকে নিউ জার্সীতে বসবাসরত ১৯২১ সালে ফিজিক্সে নোবেল বিজয়ী আলবার্ট আইন্সটাইনকে একটা চিঠি দেয়া হলো দেশটির নাগরিকত্ব ও প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহনের অনুরোধ করে।
 
কিন্তু আলবার্ট আইন্সটাইন তাৎক্ষনাত সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানালেন যে, ‘আমি একজন সাধারণ গবেষক, এডমিনিষ্ট্রেশন চালানোর মতো যোগ্যতা আমার নেই, তাছাড়া আমার বয়সও অনেক- এতটা গুরুদায়িত্ব পালনের যোগ্য আমি নই, ইত্যাদি’।
 
এবার চলুন পৃথিবীর আরেক প্রান্তের অন্য একজন বিখ্যাত ও সফল ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করি। এই ভদ্রলোকটির নাম ড. মুহাম্মদ ইউনুছ, তিনিও নোবেল পেয়েছেন শান্তিতে।
 
তার হাত ধরে গড়া প্রতিষ্ঠান ‘গ্রামীন ব্যাংক’ ১৯৭৬ সালে পল্লী দুস্থ মহিলাদের মধ্যে ঋণ কার্যক্রম শুরু করে এবং ব্যাংকটিকে আরও বড় পরিসরে দাঁড় করাতে তার চেষ্টায় ‘সরকারীকরণ’ করা হয়। একটা প্রতিষ্ঠানকে যখন সরকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হবে তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা হবে সরকারী আইন-অনুযায়ী। কিন্তু নির্ধারিত বয়সসীমা শেষ হয়ে যাবার পরও তিনি তার পদ ছাড়তে নারাজ। শেষটায় কি হলো সেটা আমরা সবাই জানি।
 
যেটুকু আমরা জানি না সেটা বলছি।
গ্রামীন ফোনের ৩৪% অংশীদার গ্রামীন টেলিকম প্রতিষ্ঠানটি। অার গ্রামীন টেলিকম এর শতভাগ মালিকানাই বলতে গেলে ড. মুহাম্মদ ইউনুছের।
 
আপনাদের কি ‘পল্লী ফোন’ এর কথা মনে আছে?
গ্রাম বাংলায় ফোনের দোকানগুলিতে এই পল্লী ফোন দিয়ে ‘ফোনের ব্যবসা’ করা হতো। সেই পল্লী ফোন এ বিশেষ কল রেট সুবিধা দেয়া হতো। কমবেশী ১ টাকা মিনিটের সেই কল রেটের উপর সরকারী ভ্যাট বসতো ১৫ পার্সেন্ট- এটা কিন্তু আমরা সবাই জানি। কিন্তু যেটা জানি না, সেটা হলো আরও ১৫% সার্ভিস চার্জ বসানো হতো- যেই টাকাটা নিয়ে নিতেন এই ড. মুহাম্মদ ইউনুছ সাহেব তার গ্রামীন টেলিকম এর একাউন্টে।
 
যে যাকগে। যেটা বলতে চাচ্ছিলাম সেটা হলো- ২০০৭ এর সেই ওয়ান-এলেভেন এর পর সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা মিলে দেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে সর্বপ্রথম পছন্দ করলেন এই ড. মুহাম্মদ ইউনুছ সাহেব কে। তাকে অনুরোধ করা হলো তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহনের।
 
কিন্তু তিনি জানালেন, ‘১-দুই বছরের জন্য আমি দায়িত্ব নিবো না, আমাকে আরও বেশী সময় ধরুন ৫-দশ বছরের জন্য দায়িত্ব দিলে নিতে পারি!’
 
কিন্তু সেনা প্রধান তাতে সায় না দিয়ে পরে ফখরুদ্দিন আহমেদ কে প্রধান উপদেষ্টা বানালেন।
 
এরপরপরই ড. মুহাম্মদ ইউনুছ সাহেব দুই মহিলাকে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলায় আউট করে শূ্ণ্য মাঠে গোল দিতে নিজেই রাজনীেতে নাম লেখালেন এবং ব্যর্থ হয়ে আবার ১৮০ ইউটার্ণ করে ফিরেও গেলেন।
 
প্রশ্ন হলো আলবার্ট অাইন্সটাইনের মতো ১টি বারও কি ড. মুহাম্মদ ইউনুছ ভেবেছিলেন যে কি তার ভিশন? কি তার দূরদর্শিতা একটা দেশকে নেতৃত্ব দেবার!
 
না। ভাবেননি।
কারণ বাংলাদেশে যেনতেন ভাবে নেতা হওয়াটাই মুখ্য। একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।
 
না, না; এই কথাটা কিন্তু আমার না।
এটা শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের কথা। তাকে একবার আটকাবস্থায় কোন এক পুলিশ অফিসার প্রশ্ন করেছিলেন আপনি রাজনীতি করে ঠিক কি করতে চান? তিনি তার উত্তরে বলেছিলেন ‘ক্ষমতায় যেতে চাই’।
 
শেখ মুজিবেরও কোন ‘ভিশন’ ছিল না।
শেখ মুজিব শুধুই ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিলেন, গিয়েও ছিলেন।
 
কিন্তু তাতে কি হয়েছে?
তিনি দেশবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন রক্ষী বাহিনী, ৭৪’র দুর্ভিক্ষ, বাকশাল, হত্যা, গুম এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন একটা ‘ছ্যাড়াব্যারা প্রশাসনের’।
 
৭ কোটি মানুষের দেশে বিদেশী দান হিসাবে পাওয়া গুনে গুনে ৭ কোটি কম্বল তিনি ২০% মানুষের কাছেও পৌছে দিতে পারেননি।
 
কেউ একটা মার্ডার করে বা ধর্ষন কিংম্বা ডাকাতি করে বিশাল হৃদয়ের শেখ মুজিবের সামনে পৌছতেন বাজার থেকে কেনা তাজা এক বালতি মাছ নিয়ে- যেটাকে আবার বলা হতো নিজেদের পুকুর থেকে ধরে আনা মাছ; তারপর ‘জয়বাংলা’ বলে সামনে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলতেন ‘বঙ্গবন্ধু আমি তো একটা খুন করে ফেলেছি বা ভুলে ধর্ষন করে ফেলেছি- সেনাবাহিনী আমাকে খুঁজছে; আমাকে আপনি না বাঁচালে কেউ বাঁচাতে পারবে না’।
 
ব্যাস, বিশাল হৃদয়ের শেখ মুজিব সেই খুনী, ধর্ষক বা ডাকাতকে নিজের বুকে টেনে নিতেন আর বলতেন, ‘কে তোর বুকে হাত দিবে- আমি বাঁচা থাকতে? কোন চিন্তা করিস না- আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।’
 
এই হলো বিশালতা এবং এটাই ছিল তার প্রশাসনিক যোগ্যতা।
 
সেই দেশের সব মানুষই আজ শুধুই নেতা হতে চায়, মন্ত্রী হতে চায়, সংসদ সদস্য হতে চায়। সাকিব আল হাসান, মাশরাফিরাও চায় সংসদে যেতে। আসাদুজ্জামান নুর, তারানা হালিমরাও কিন্তু ইতিমধ্যেই তাদের অসাধারণ সব ‘জোকার-নেতৃত্বগুণ’ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেনও!
 
একজন ভালো ক্রিকেটার বলেই কি সে এমপি হবার যোগ্য?
একজন ভালো গায়ক বা নায়ক হলেই কি সে এমপি হবার যোগ্য?
যেনতেন ভাবে কিছু অবৈধ কালো টাকার মালিকানা রয়েছে বলেই সে এমপি হবে?
 
একজন এমপি’র কাজ কি সেটা কি এরা জানে?
আমি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি একজন এমপি’র প্রকৃত কাজ কি- সেটাও এরা জানে না; তারা শুধুই জানে এমপি হওয়া মানেই ক্ষমতা হাতে পাওয়া, মন্ত্রী হবার খুব কাছাকাছি যাওয়া।
 
আর এই অযোগ্য নেতাদের কারণেই আজ বাংলাদেশ হয়েছে ‘জিপিএ পাইপ’!
 
আর এই অযোগ্য নেতাদের কারণেই বেগম খালেদা জিয়া এখনও সামান্য একটা ভুল মামলার রায়ে জেল খাটছেন। বেগম জিয়ার আইনজীবিরা বিগত ৪-চারটি মাসেও তার পুর্বের জামিন না নেয়া মামলাগুলিতে জামিন আবেদন করতে পারেনি, এখন করার কথা তাদের মনে হয়েছে!
 
অনেকেই আমাকে বলে থাকে আমি কখনওই জামায়াতের বিরুদ্ধে কিছু লিখি না কেন?
আজ জামায়াতের একটা দুর্বল পয়েন্টে হাত দিই- চলুন।
 
‘সৎ লোকের শাসন চাই’ শ্লোগানে জামায়াত রাজনীতি করে।
মানছি জামায়াতের নেতারা সৎ; কিন্তু একজন মানুষ সৎ হলেই কি ‘যোগ্য’ হয়ে যায়?
 
জামায়াতের ‘সৎ’ লোক রয়েছে কিন্তু ‘যোগ্য’ লোকের বড়ই অভাব। আর যোগ্য ও দূরদর্শিতার অভাবেই আজ জামায়াতে ইসলামির মৃত্যুপ্রায় দশা।
 
শেষটায় একটা কথা বলি।
যেভাবে দেশ চলছে- একজন যোগ্য লোকের হাতে নেতৃত্ব অর্পন না করলে বিএনপির রাজনীতি মানুষের ভালবাসায় হয়তো থাকবে কিন্তু দলটি হয়তো বা বিলীন হয়ে যাবে শিগগিরই।
 
সারাজীবন বাম রাজনীতি করা মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীররা বিএনপি-কে কিছুই দিতে পারবে না; সেই যোগ্যতা তার ভেতরে খুঁজেও পাওয়া যায় না। যোগ্যতম ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়াটাই এই মুহুর্তে বিএনপির প্রধান কর্ম হওয়া উচিত।
 
আমরা সবসময়ই যোগ্য লোকটি ভয় করি- নিজের অযোগ্যতা ধরে পরে যাবে ভয়ে।
 
 
   Send article as PDF