আবুলের গল্প

চলুন আমরা আজ দু’বন্ধুর গল্প শুনি।
একজনের নাম ‘আবুল’ আরেকজনের নাম ‘জন’।

দু’জন পাশাপাশি গ্রামে থাকে। দু’জনই ব্যবসায়ী। দু’জনের মধ্যে সম্পর্কও খারাপ না মোটেও।

আবুল খুবই চালাক। খুবই মানে প্রচন্ড চালাক। সবকিছুতেই তার চালাকি। প্রতিটি কাজ কর্ম সে হিসাব নিকাশ করে চলে। এতো এতো হিসাব তাকে করতে হয় যে ২ আর ২ কে যোগ করলে যে ৪ হয়- এটা করতেও তার সময় চলে যায় প্রায় সপ্তাহ খানেক। কারণ সে ভাবতেই থাকে, আর ভাবতেই থাকে। সে শুধু ভাবেই- কোথাও ভুল হচ্ছে কি না! ২ এর সঙগে ২ কে আবার ফাঁকি দিয়ে কেউ ১ সরিয়ে ফেলবে কি না। নাকি ভুলে আবার ২ থেকে ২-ই চলে যাবে কি না। কাউকেই সে বিশ্বাস করে না।

টাকা পয়সা সে খুবই যত্ন-আত্মি করে রাখে। কাউকে দেয় না। তবে তাকে যদি কেউ টাকা দেয়- খুবই খুশী মনে সে সেই টাকা নিয়ে নেয়।

টাকা নেবার জন্য সে মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলে, চা খাওয়ায়। মাঝে মধ্যে বাজার থেকে পান এনে পানও বানিয়ে খাওয়ায়। আর যদি বুঝতে পারে বেশী টাকা পাওয়া যাবার সম্ভবনা রয়েছে তাহলে সে তার জন্য বিশাল আয়োজন করে, দেশী মুরগী জবাই করে এমনকি বাজার থেকে তাজা দেখে রুই আর ইলিশ মাছও আনায়।

কিন্তু একবার টাকাটা পেয়ে গেলে সে আর ঐ টাকা তাকে কোনদিনই নিয়ে যেতে দেয় না। খুব চাপাচাপি করলেও ম্যাক্সিমাম ১০ হাজার টাকা দেয়- এর বেশী সে দিবেই না। তাও সেই বছর আর একটি পয়সাও সে তাকে ফেরত দেয় না। পরের বছর আবার ম্যাক্সিমাম ১০ হাজার টাকা দেয়।

অপরদিকে ঐ যে জনের কথা বললাম।
জন আবার ঠিক তার উল্টো। সে খুব সহজ-সরল। কোন চালাকি বা প্যাচ সে জানে না।

আপনি তাকে অনায়াসে বিশ্বাস করতে পারেন। ধরুন আপনার কাছে ৫০ হাজার টাকা আছে- টাকাটা নিরাপদে গচ্ছিত রাখা দরকার। আপনি যদি ঐ সম্পূর্ণ ৫০ হাজার টাকা জনের কাছে রেখে আসেন- এবং কোন একদিন হঠাৎ কোন মধ্য রাতে তার কাছে গিয়ে বলে বসেন আমার ৬০ হাজার টাকা দরকার- আপনার কাছে তো আমার মাত্র ৫০ হাজার টাকা রয়েছে- আর দশ হাজার টাকা এই রাতে কৈ পাবো?

জন মোটেও দেরী করবে না; কিচ্ছুটি ভাববেও না। সে ঘরে গিয়ে ৬০ হাজার টাকা এনে আপনাকে দিয়ে দেবে।

অথচ জন আপনাকে ঠিক-ঠাক চিনেও না।

জন সবার সংগেই এমনটা করে থাকে।
এতে হয় কি- দুনিয়ার সবাই গিয়ে ঐ জনের কাছেই তাদের সব টাকা রেখে অাসে। মানুষ এমনও হয়েছে তার নিজের চেয়েও জনকেই বেশী বিশ্বাস করে।

আর তার পরিণামে যেটা হয়েছে দুনিয়া শুদ্ধ মানুষ এখন শুধু জনের কাছেই তাদের সব টাকা গচ্ছিত রাখে।

জন আবার সেই টাকা ব্যবসায়ও খাটায়। ঠান্ডা মাথায় সে পরিশ্রম করে- প্রচুর আয় করে এবং সেই আয় থেকে কেউ বিপদে পড়লে নিজে থেকেই হাত বাড়িয়ে দেয়।

এবং শেষটায় জন হয়ে উঠেছে এলাকার বড় ভাই, মুরুব্বী।

অপরদিকে ঐ যে আপনাদেরকে আবুটার সংগে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম সে একঘরে হয়ে বসে রয়েছে- কেউ তাকে আর বিশ্বাসই করে না। কারণ সে আসল টাকাটাও ফেরত দেয় না। সুতরাং কেউ তার কাছে টাকা রাখেও না।

এমনও হয়- একবার কোনমতে কেউ তার টাকা আবুলের কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারলে সোজ আবুল কে একদলা থুথু দিয়ে দৌড়ে চলে আসে জনের কাছে।

আপনাদের এতক্ষন আবুল আর জনের গল্প বললাম।

আমার এ গল্পটা কিন্তু সত্যি।
কি- বিশ্বাস হলো না? প্রমাণ দেবো? দিচ্ছি।

জনের ভাল নাম ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’ আর আবুলের অফিসিয়াল নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।

আমেরিকায় সারা পৃথিবী থেকে যে-কেউ এসে কোন বৈধ পেপারস ছাড়াই সেখানে একটা ব্যাংক একাউন্ট ওপেন করতে পারে এবং সেই একাউন্ট থেকে যে এটিএম কার্ডটি দেয়া হয় তা দিয়ে এই পৃথিবীর যে-কোন প্রান্ত থেকে যে-কোন সময় তার আসল টাকা তো তুলে নিতেই পারেই; এমনকি ৫-৭শত ডলার বেশী তুলে নিলেও আমেরিকা কিছুই মাইন্ড করে না।

এমনকি আপনি চাইলে অনলাইনে বসেও যে-কোন সময় যে-কোন স্থান থেকে ঐ একাউন্টের টাকা দিয়ে যা মন চায় তাই করতে পারবেন। কেন করছেন কি করছেন কেউ আপনাকে ফোন করেও জানতে চাবে না।

অপরদিকে কোন বিদেশী বাংলাদেশে গিয়ে দুনিয়ার বৈধ কাগজপত্র থাকলেও (রেসিডেন্ট ভিসা না থাকলে) কোন একাউন্ট খুলতে পারবে না। একাউন্ট খুললেও সেই নিজের একাউন্টের নিজের টাকা তুলতেও তাকে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

আবার সেই বাংলাদেশের নিজ নাগরিকরাও তাদের নিজেদের কর্ষ্টের উপার্জিত টাকা বিদেশে নিয়ে যেতে পারবে না। বছরে মাত্র ১০ হাজার ডলার- তাও যদি নিজে বিদেশে যায় তাহলে সঙগে করে নিয়ে যেতে পারবে।

সুতরাং পরিণামে যেটা হয়- এই বাংলাদেশেরও মানুষও বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে না। তারা টাকা-পয়সা সুযোগ পেলে হুন্ডি করে হলেও ঐ আমেরিকা বা কানাডায় নিয়ে যায়। কেউ কেউ একাউন্ট খুলে সুইচ ব্যাংকে। কানাডায় তৈরী হয়ে বাংলাদেশীদের টাকায় ‘বেগম পাড়া’। আর মালয়েশিয়াতে হয় ‘সেকেন্ড হোম’।

কারণ সারা পৃথিবীর মানুষ আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ডকে বিশ্বাস করে; সকলে জানে এরা তার টাকা ফেরত দেবে যখন দরকার তখনই।

কিন্তু বাংলাদেশ টাকা ফেরত দিবে না।

আর আবুল সারাক্ষন শুধু তার ‘টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে চিন্তায় মগ্ন থাকে’। তার রিজার্ভ লুট হয়ে। তার রিজার্ভ হ্যাকিং হয়। তার সেন্ট্রাল ব্যাংকের ১২ হাজার কোটি টাকা লাপাত্তা হয়ে যায়।

তারপরও তার দেশের জনগণ নিজেদের টাকা নিজেরা জরুরী দরকারেও বাইরে নিতে পারে না।

আমোরকারই একটা অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থার নাম ‘পে-পল’ যার ব্যাপ্তী বিশ্বব্যাপী। পে-পল ক্রস বাউন্ডারী ব্যাংকিং করে- অর্থাৎ পে-পল দিয়ে এই পৃথিবীর এক প্রান্তের টাকা মুহুর্তে অন্য প্রান্তে ট্রান্সফার করা যায়। পে-পল শতভাগ নির্ভরযোগ্য। প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যবসা হচ্ছে শুধুমাত্র এই পে-পল দিয়ে।

কিন্তু পে-পল বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে না।
পে-পল জানে বাংলাদেশ থেকে টাকা ফেরত নিয়ে আসা যাবে না- বাংলাদেশ শুধু টাকা নিতে জানে; সুতরাং তারা বাংলাদেশকে এলাউ করে না। বাংলাদেশ পে-পলে কোন একাউন্টও করতে পারে না।

এই হলো আবুলের গল্প।
আবুলরা যুগে যুগে আবুল-ই থেকে যায়। তাদের আবুল হয়ে থাকতেই ভালো লাগে।

এই সব আবুলরা আবার পিএইচডি ডিগ্রী নেয়, আমেরিকায় পড়াশোনাও করে, কেউ কেউ স্কলার্সও। কিন্তু তারা জনের কাছ থেকে কিছুই শিখে না। শুধুই ২ আর ২ নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর খুঁজতে থাকে একটা টাকাও যেন বাইরে চলে না যায়।

দেশের টাকা দেশে রাখতে হবে।
এভাবেই আবুল একদিন আরও বড় আবুল হবে।

আবার আমার মতো কেউ কেউ সেই আবুলকে ফুটবলের মতো লাথি মেরে উড়িয়ে দিয়ে অমান্য করে বর্বর আইনকে, বর্বর রাষ্ট্রকে।

আমি বিশ্বাস করি- আমার দলে লোক আস্তে আস্তে একদিন বাড়বেই।
মানুষ তার নিজের ভালোটা বুঝবে না- এটা হতে পারে না।

আবুলের আবুলীয় সংবিধান ধ্বংশ না করতে পারলে বাংলাদেশের মানুষ ঐ ‘অাবুল’ এর হাত থেকে রেহাই পাবে না- বাইরের সুন্দর চাকচিক্যময় করিৎকর্মা আর মেধাবী বিশ্বকে দেখতেও পাবে না।

মাঝে মধ্যে কিছু ধ্বংশ কিছু সুন্দরের জন্ম দেয়।

   Send article as PDF