বেশ কিছু ঈদ

প্রায় বছর চারেক হলো আমেরিকায় বসবাস করছি।
এরি মধ্যে ৮ম ঈদটি পার করবো আগামীকাল মঙ্গলবার। ৪টি করেছি রোজার ঈদ আর অলরেডী ৩টি কোরবানীর ঈদও এই দূর দেশের মাটিতেই কাটিয়েছি।
 
আমেরিকায় মুসলমানের সংখ্যা মাত্র ৩.৪৫ মিলিয়ন যা শতকরার হিসাবে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.১%। একটা ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত দেশ থেকে এসে একটা ১% মুসলিমের দেশে পা দিলে যেমনটা লাগতে পারে- অন্য সবার মতো আমারও তেমনটাই লেগেছিল।
 
আমেরিকায় প্রথম ঈদটি করেছিলাম টেক্সাসের ডালাসে; আসলে ঠিক ডালাসও নয়- ওটা আর্লিংটন। ডালাস ও ফোর্ট ওর্থ শহরের সংলগ্ন একটা শহর- তবে ওখানকার সবগুলি শহরকে এক নামেই ডাকা হয় সেটা ‘ডালাস’। আর পুরো এলাকাটাকে শর্টকার্টে বলা হয় ‘ডিএফডব্লিও’ (ডালাস-ফোর্ট ওর্থ)।
 
সেটাও সেই ১৫তে।
টেক্সাস আসলে বিশাল মরুভূমির মতোই যেন বিচ্ছিন্ন বিশাল এক গ্রাম। সামারে তাপমাত্রা ওঠে যায় ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইটে। ‘অসভ্য গরম’ শরীরটাকে পুড়িয়ে দিয়ে যায় মুর্হূতেই।
 
আমি তখন আমেরিকায় নতুন।
ড্রাইভিং জানি না, নিজের গাড়ীও নেই।
আমার বাসা থেকে সবচে কাছের মুদি দোকানটার নাম ওয়ালমার্ট, অন্যটি কুগার! মুদি দোকান বলাতে হাসার কিছু নেই- হাঁটা পথে দূরত্ব প্রায় আড়াই মাইল। বাংলাদেশের ঢাকা শহরের স্ট্যাইলে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত এই আমি যেন এক কুল-কিনারাহীন মানুষ। না আছে সার্বক্ষনিক ড্রাইভার, ব্যক্তিগত এসিসটেন্ট, বাসার কাজের লোকজন! এখানে আমিই আমার চাকর, আমিই আমার কাজের লোক।
 
একটু কায়িক-কষ্ট হলেও কোন সমস্যাই আমার কাছে সমস্যা না; সমস্যাকে সমাধান করাই তো মানুষের কর্তব্য। আমি জানি এসব সমস্যা সাময়িক, সুতরাং ভয় কিসে?
 
পাকিস্তানী বন্ধু সাঈদ ভাই তার গাড়ী নিয়ে প্রায় মাইল সাতেক ড্রাইভ করে আসেন আমাকে সংগে করে মসজিদে নিয়ে যেতে আবার নামাজ শেষে বাসায় পৌছেও দিয়ে যান। এটাই ছিল তার শুক্রবারের আন্তরিক সহায়তা। ঈদের নামাজও সেভাবেই আদায় করলাম ঐ আর্লিটনে।
 
আরেক বন্ধু ইকবাল ভাই দুপুরে আসলেন আমার বাসায়, গল্প করে দিন পাড় করে দিলাম, ঈদ শেষ।
 
বাংলাদেশের বাইরে ওটাই কিন্তু আমার প্রথম ঈদ ছিল না।
১১তে ক্যান্সারে (থাইরয়েড লিম্ফমা) আক্রান্ত আমার শ্বাশুড়ী প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী। কোরবানী ঈদের ৩/৪ দিন আগে বাধ্য হলাম ওনাকে নিয়ে লক্ষ্ণৌ যেতে, ওখানকার বিখ্যাত ‘কিং জর্জ হসপিটাল’ এ তার চিকিৎসা হচ্ছিল। ঈদের দিন সকালে গুরত্বর অসুস্থ রোগী নিয়ে পৌছলাম হসপিটালে। রোগী ভর্তি করানোর পর প্রচন্ড ক্ষুধায় স্যান্ডউইচ আর এক কাপ চা খেতে পূর্ব পরিচিত ‘সৌরভ’ এর দোকানে গেলাম।
 
সে তো অবাক! ঈদের দিন আমাকে ওখানে দেখে বুঝে ফেলল যে রোগী মারাত্মক অসুস্থ। তার সুস্থ্যতা কামনা করে আমাকে বিকেলে তার বাড়ীতে দাওয়াত দিলো কোরবানীর মাংস খাওয়ার।
 
ভারত-বর্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু মুসলিম রয়েছে যারা অসম্ভব ধনী।
 
সামান্য চায়ের দোকান দেখে আমি বুঝতেই পারিনি যে ৩ তিনটি চায়ের বাগানের মালিক ওর বাবা, সংগে রয়েছে আরও কিছু ইন্ড্রাষ্ট্রিজ এর মালিকানাও। একটি স্কুল ও একটি কলেজেরও প্রতিষ্ঠাতা সৌরভের বাবা। আর ওরকম মোট ৭টি বিশেসায়িত চায়ের দোকান রয়েছে ওদের যার মধ্যে একটা রয়েছে নয়া দিল্লীর লোকসভা ভবনের ভেতরেও। সবই তাদের চায়ের স্যাম্পল। আমাকে বিভিন্ন কোয়ালিটির চায়ের সংগে পরিচয় করিয়ে দিলেন, সংগে গিফট হিসাবে দিলেন দুই রকমের দুই কেজি চা পাতাও।
 
আমেরিকায় প্রথম ৫/৬ টা ঈদ কোন কিছু বুঝতে না বুঝতেই কেটে গেল। আর আমি নতুন ব্যবসা নিয়ে মার্কিন মুল্লুকে নিজেকে প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ের স্ট্যাইল আর আমেরিকার স্ট্যাইলে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
 
এর মধ্যেই ড্রাইভিং শিখলাম। গাড়ীও নিলাম। আর গাড়ী চালানো শেখার পর বুঝলাম, আমেরিকাটা আমার এতোদিনের চিন্তার চেয়েও বেশ কয়েকগুন বড়।
 
কত কত শহর যে দেখলাম এই চার বছরে তার লিখেও শেষ করতে পারবো না। লাস ভেগাস, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সসিকো, ওয়াশিংটন ডিসি, ফিলাডেলফিয়া আর নায়াগ্রা’র মতো বড় বড় নামকরা শহরের ফাঁকে ফাঁকে মেনলো পার্ক, ফেয়ারমন্ট, বাল্টিমোর, নিউ হ্যাভেন, ডোভার, হার্টফোর্ড, প্রভিডেন্স, নিউ পোর্ট, মনটাউক, কেন্ট, আটলানটিক সিটি, নিউ মার্কেট, মর্গানটাউন এসব তো নস্যি!
 
ঘুড়ে বেড়াই যখন যে দিকে ‘মন’ চায়।
সামার মানেই গাঢ় সবুজ আমেরিকা। চোখ ধাঁধাঁনো সবুজ চারদিকে। এই সবুজই আবার উইন্টারে সাদা হয়ে যাবে। তার আগে কিছু সপ্তাহের জন্য হয়ে উঠবে লালে রঙিন।
 
গেল চার বছরে একটি মুর্হূতের জন্যও বুঝতে পারিনি কিভাবে লোডশেডিং হয়, এক ন্যানো সেকেন্ডের জন্যও এদেশে কারেন্ট যায় না; ২৪-ঘন্টাই পরিস্কার ঠান্ডা ও গরম পানির উপস্থিতি, রান্নার গ্যাসের চাপ একটু বাড়ে বা কমে না; হরতাল, মিছিল, অবরোধ নামের কোন শব্দও নেই এখানে। কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল- নির্বাচন হয়ে যাবার পর নিউজ দেখে জানতে পেরেছি ‘গতকাল ইলেকশন ছিল’।
 
এই তো গেল বারের আগের বার আমার গলব্লাডারের লেপারস্কপি সার্জারী হলো।
 
প্রচন্ড পেট ব্যথ্যা, যাষ্ট নাইন-ওয়ান-ওয়ান এ একটা শুধুই ফোন কল। ঘড়ি ধরে ৩ মিনিটের মাথায় আমার বাসায় এম্বুলেন্স এসে উপস্থিত। তারপর টানা ৮ দিন হসপিটালে ভর্তি, ১ মাস পর সার্জারী। তারও মাস খানেক পর বাসার ঠিকানায় আমার মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী একটা চিঠি পাঠালো, তাতে লেখা, ‘তোমার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে তোমার চিকিৎসায় মোট ২৭ হাজার ডলার খরচ হয়েছে- এটা কিন্তু কোন বিল না বা তোমাকে পরিশোধ করতে বলছিও না, যাষ্ট তোমাকে জানাচ্ছি যে তুমি চিকিৎসায় সন্তুষ্ট কি না বা তোমার কোন অভিযোগ রয়েছে কি না?’।
 
আগেও বলেছি আমেরিকার মাটিতে যাদু রয়েছে।
আর এই যাদুতে আমিও আটকা পরে গেছি, এই যাদু থেকে বের হওয়া খুবই কষ্টকর। আর তাইতো এই মাটিতে একবার যার পা পরে- সে-ই আটকা পরে যায়। আর এই আটকেপরা মানুষের সংখ্যাটা আজ ৩২ কোটি ছাড়িয়ে!
 
এই ‘ল্যান্ড অব অপুর্চুনিটিজ’ মানুষকে যাদু করে শুধুই ভালবাসা, সুযোগ আর স্বাধীনতা দিয়ে।
 
এতো এতো অবাধ স্বাধীনতা, মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের নিঃশর্ত ভালবাসা, রাষ্ট্র কর্তৃক একজন সাধারণ মানুষকে দেয়া সম্মান আর প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ এবং হালাল উপার্যনের শতভাগ নিশ্চয়তা যখন কোন একটা দেশ প্রতিটি মানুষকে দেয়- তখন তো সেটাকেই এক কথায় ‘যাদু’ বলা যেতেই পারে, তাই নয় কি?
 
আর এই যাদুতে আটকে পরেও ঈদ আসলে-ই নিজের সম্পূর্ণ বুকটাতে কেমন যেন একটা তীব্র হাহাকার শুনতে পাই। বন্ধ চোখে পরিস্কার দেখতে পাই এই পৃথিবীর ঠিক অপর প্রান্তের কিছু মানুষ ট্রেন-বাস-লঞ্চ বোঝাই করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ পরিজনের সংগে ঈদ কাটাতে বাড়ী ফিরছে। নিজের অতি পরিচিত গ্রামে পৌছে ছোট বেলার সব বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনদের সংগে কাটিয়ে দিচ্ছে কত মনোরম সময়, শেয়ার করছে স্মৃতি, খেলায় অংশগ্রহন আরও কত্তকি! বিয়ের দাওয়াতে অংশগ্রহন, সবাই মিলে কতশত মজা।
 
আমি ঐ ঘরে ফেরার সুখটুকুকে এই ১৫ হাজার মাইল দূরে বসে এখনও দেখতে পাই। চোখ ভিজে উঠে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে উঠে।
 
তারপর সেই গরুর হাটে গিয়ে একটা গরু দামাদামী করে কেনা, ভীড়ের মধ্যে সেই কাংক্ষিত গরুটি নিয়ে বাড়ী ফেরা, রাস্তার পাশের প্রতিটি মানুষের একটা কমন প্রশ্ন, ‘ভাই কত হলো?’, তারপর বাড়ী বাড়ী গিয়ে অন্যদের গরু দেখে সকলের আনন্দের শেয়ার নেয়া, পরদিন খুব ভোড়ে উঠে ঈদের জামাত, তারপর কোরবানী, মাংস বানানো, নিজেও একদিনের কসাই হয়ে উঠা, এবং শেষটায় সহায়-সম্বলহীন একদল মানুষ যখন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে একজন একজন করে সামান্য কিছু মাংস নিয়ে যায়- ঐ ৪/৫ টুকরো মাংস প্রাপ্তির পর তাদের চোখের সেই ঝিলিকটুকু, বাড়ীতে গিয়ে রান্না করে সেই মাংস খাবে- সারা বছর তো আর খেতে পারে না- তাই!
 
আমেরিকায় এই ‘অকৃত্রিম ভালোবাসাটুকু’র খুব বেশী অভাব।
 
এই নিঃস্বার্থ আনন্দটুকু একটি মুহূর্তের জন্য খুঁজে পাইনি।
গরুটা জবাই করে প্রথমেই কলিজাটা নিয়ে, সেই তাজা কলিজাটুকু মায়ের হাতের রান্না শেষে খিচুরী দিয়ে খাবার মধ্যে যে আনন্দ- সেটা আমেরিকায় নেই।
 
যেই গ্রোসারীতে কোরবানীর অর্ডার দিয়েছি তারা আমাকে মাংস দিবে রাত ১২টারও পরে। ঈদের দিনে কোরবানীর মাংস খাওয়া হবে না, মধ্য রাতে হয়তো বা খাবো।
 
ঈদ আসলেই শুধু মনে হয়- কি প্রয়োজন ছিল এই হাজার হাজার মাইল দূরে এসে বসবাস করার!
 
অভাগা ঐ দেশটাই তো ঢের ভালো ছিল!
   Send article as PDF