অলটারনেটিভ

অফিসে কাজ করছিলাম।
রাত এগারোটার দিকে আশরাফ মামা’র ফোন; আরেকটু বসতে বললেন- আমার জন্য ডানকিন থেকে কিছু ‘বেগান’ নিয়ে আসছেন। সুগারটা একটু বেশী, নইলে খাবারটা দারুন পছন্দের আমার। আশরাফ মামা মাঝে মধ্যে আমাকে ডানকিটের ফ্রি কফির টোকেন দেন। ডানকিনের কফিটা খারাপ না। তবে, কফির জন্য সত্যিই স্টারবাক-ই সেরা।
আশরাফ মামা ডানকিন এর একটি ষ্টোরের ডিউটি ইনচার্জ হিসাবে মোটামুটি ৫০০ ডলারের উপর সপ্তাহে আয় করেন। কিন্তু কাজটা দীর্ঘ সময় নিয়ে করতে হয়, তাই ব্যবসায়ের চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন; আসেন প্রায়ই আমার অফিসে, এটা সেটা গল্প করেন। আমারও মামাকে ভালই আগে।
রাত ০০.১৫ দিকে বাসার উদ্দেশ্যে অফিস থেকে বের হলাম। জ্যাকসন হাইটস এন্ড রুজভেল্ট এভিনিউ থেকে এক্সপ্রেস ই অথবা লোকাল আর ট্রেন নিয়ে ল্যাক্সিনটন এভিনিউ থেকে লোকাল সিক্স ট্রেনে চেপে ক্যাসেল হিল এভিনিউ আমার ডেষ্ট্রিনেশন।
আজ সকাল থেকে কপালটা খারাপই যাচ্ছিল। কেন যেন মনে হল কিছু ভোগান্তি হবে। নিউ ইয়র্কে ২৪-ঘন্টাই বাস-ট্রেন চলাচল করে। সদা জাগ্রত একটি শহর। পৃথিবীর আর কোথাও ২৪ ঘন্ট সচল কোন শহর রয়েছে বলে জানা যায় না, অন্তত আমি জানি না।
তবে, রাত ১১টার পর বাস বা ট্রেন সার্ভিস একটু স্লো হয়ে যায়।
আমি প্লাটফর্মে ঢোকার পরপরই এক্সপ্রেস এফ ট্রেন আসলো। আমি এফ ট্রেনে যাব না কারণ এফ ট্রেনের ল্যাক্সিনটন এভিনিউ এন্ড সিক্সটিথার্ড ষ্টেশনটি প্রায় ২৫ তলা সমান মাটির নীচে। ৩টি এক্সিলেটরে উপরের মেইন রোডে ৩টি ব্লক হেটে ফিফটিনাইন ষ্ট্রিটে এসে ল্যাক্সিনটন এভিনিউতে ঢুকতে প্রায় ৪টি ব্লক হাটতে হয়; আজ শীত একটু বেশী- আমি হালকা জামা পড়ে বের হয়েছি, শীত লাগছে।
কাজেই এক্সপ্রেস ই ট্রেনের জন্য ওয়েট করছি। মিনিট সাতেক পর ই ট্রেন আসলো ঠিকই কিন্তু লোকাল ট্রাকে। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম লোকাল ট্রেনেই যদি যাই তবে আর ট্রেনেই যাব। কিন্তু, আগেই বলেছি আজ কপাল খারাপ। আর ট্রেনের কোন খবরই নেই। আরেকটা এক্সপ্রেস এফ চলে গেল। এরপর আবার মিনিট পাচেক পর ই লোকাল। চিন্তুা করলাম, ভুল করবো না। লোকাল ই ট্রেনে চেপে বসলাম। ফিফটি থার্ড ষ্ট্রিটে নেমে এক্সিলেটরে উপরে উঠে বা’দিকে কিছুটা সামনেই ল্যাক্সিনটন ফিফটি ফাষ্ট ষ্ট্রিট ষ্টেশন, কাছাকাছি পৌছতেই দেখলাম ট্রেন দাড়িয়ে রয়েছে। এখানকার ট্রেনগুলিও খুবই দুষ্ট, কোন ষ্টেশনেই ৩০ সেকেন্ডের বেশী দাড়ায় না। আমি ভাল দৌড়াতে পারি। অনেকের সাথে আমিও দৌড়ে ট্রেনের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এটা খুব বিজি ষ্ট্রেশন বাট মজার ব্যাপার হলো আমি প্রতিদিনই সম্পূর্ণ কাততালীয়ভাবে বসার সিট পেয়ে যাই। আজ যেহেতু কপাল খারাপ সেহেতু দাড়িয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ আমার চোখে একটি বিষয় আটকে গেল। সিক্স ট্রেন তো যায় পার্কচেষ্টার বা পেলহাম বে ষ্টেশনে কিন্তু এখানে লেখা দেখছি ওডলন বাউন্ট ফোর ট্রেন। ফোর ট্রেন চলে সাধারণত মাটির আরও একতলা নীচ দিয়ে যেটা সম্পূর্ণ এক্সপ্রেস লাইন। আমি কি চোখে ভুল দেখছি? ভাল মত খেয়াল করলাম, এটা সিক্স ট্রেন নয়, ফোর ট্রেন কিন্তু চলছে লোকাল রুটে।
আমি তো জানিই যে আজ আমার কপাল খারাপ, নিশ্চয়ই আরও ভোগান্তি রয়েছে কপালে।
ওয়ান হান্ডডেট এন্ড টোয়ান্টি ফাইভ ষ্টেশনে নেমে আমাকে আবার সিক্স ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ১২৫ ষ্টেশনে ট্রেন থামতেই নামবো- সেই মুহুর্তে এনাউন্সমেন্ট শুনলাম- সিক্স ট্রেন আজ চলছে না। বাইরে- উপরে স্যাটল বাস দেয়া আছে হান্টস পয়েন্ট পর্যন্ত।
রাত তখন একটা বেজে গেছে। কপাল তো আজ শুধু খারাপ না! ভয়াবহ খারাপ।
বাইরে বের হলাম, ফ্রি স্যাটল বাস রেডী। উঠে বসলাম, বাস ছেড়ে দিল। এবং হান্টস পয়েন্ট ষ্টেশনে পৌছে গেলাম। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম এবার কিভাবে যাবো? ড্রাইভার বলল ষ্টেশনে চলে যাও- এখান থেকে সিক্স ট্রেন চলছে।
সাবওয়ের ভেতরে নামলাম, একটা ব্লাক মেয়ে ইমারজেন্সী গেইট খুলে দাড়িয়ে রয়েছে এবং ভেতরে ঢুকতে বলছে- কার্ড পাঞ্চ করতে হবে না; ফ্রি এন্ট্রি। অবশেষে সিক্স ট্রেনে উঠলাম।
এবং আজকের মতো ভোগান্তি এখানেই শেষ হল।
উপরের এই লম্বা প্যাচাল পারার একটাই কারণ, আর তা হলো- নিউ ইয়র্ক ২৪ ঘন্টাই সচল একটা শহর। রাস্তা-ঘাটে যে-কোন সমস্যা যখন তখন হতেই পারে; কিন্তু তার জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এক মুহুর্তের জন্যও বন্ধ থাকে না। অলটারনেটিভ ট্রান্সপোর্ট সম্পূর্ণ রেডী করে তারপরই এখানে কোন রাস্তা বন্ধ করা হয়। প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত অলটারনেটিভ। আমি আজকে নিয়ে এপর্যন্ত ৩ বার এরকম ট্রান্সপোর্ট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি এবং প্রতিবারই দেখেছি- অলটারনেটিভ আগেই রেডী হয়ে আছে। কোন দিন বিপদে পড়িনি- আর তাই এখন বিপদের কোন চিন্তাই মাথায় কাজ করে না আমেরিকায়।
বাংলাদেশে থাকতে একটা কথা প্রায়ই শুনতাম, ‘ইন্টারন্যাশনাল ষ্ট্যান্ডার্ড’। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বা সার্ভিস ইন্টারন্যাশনাল ষ্ট্যান্ডার্ড হিসাবে প্রদান করা হয়। যেমন হংকং ব্যাংক (এইচএসবিসি), স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, এয়ালাইন্সগুলি এরকম।
আর, আমেরিকায় দেখলাম সবকিছুই এখানে ইন্টারন্যাশনাল।
শুধুমাত্র বাংলাদেশী মালিকানাধীন হাতে গোনা অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান (কয়েকটি রেষ্টুরেন্স আর গ্রোসারী- তাও আবার যেগুলোর কাষ্টমার শুধুই বাংলাদেশীতেই সীমাবদ্ধ) বাদে সম্পর্ণ দেশটাই ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড। শুধু এখানকার হংকং ব্যাংক (এইচএসবিসি) আর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক- দুটির অবস্থা আমাদের দেশের সোনালী, জনতা ব্যাংকের সাথেই তুলনীয়!
এবার মূল বিষয়টি বলি।
সত্যি বলতে কি আমেরিকা দেশটাই একটা ‘ইন্টারন্যাশনাল’ দেশ। এদেশের সবকিছুই ইন্টারন্যাশনাল। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
১) বাংলাদেশের ইন্টারনেট ডোমেইন হলো ডট কমের পর- ডট বিডি (), ভারতের ডট আইএন, মালয়েশিয়ার জন্য ডট এমওয়াই, চায়নার জন্য রয়েছে ডট সিএন, কানাডার জন্য ডট সিএ, বৃটিশদের জন্য আছে ডট ইউকে ইত্যাদি। কিন্তু আমেরিকার জন্য কোনটি বলুন তো?
না, আমেরিকার জন্য কোন রাষ্ট্রগত ডোমেইন নেই। কারণ আমেরিকা ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি- কাজেই তার জন্য ডোমেইন থাকবে কেন? এরা সরাসরি ব্যবহার করে ডট কম, ডট এডু, ডট বিজ ইত্যাদ্যি। কারণ আমেরিকাই তো ডোমেইনের জন্মদাতা এবং লালন-পালনকারী। আমেরিকার জন্য কোন কান্ট্রি ডোমেইনের দরকার নেই- এরা তো ইন্টারন্যাশনাল।
২) গুগল অার্থ সফটওয়ারটি অনেককেই ব্যবহার করেন বিশ্ব মানচিত্র দেখার জন্য। একটু ভাল করে খেয়াল করলে দেখবেন- বিশ্বের প্রতিটি শহরের মধ্যে একটা লাল পয়েন্ট থাকে এবং সেখানে ক্লিক করলে শহর, ষ্টেট বা প্রভিন্স এবং দেশের নাম দেখায়।
এবার আমেরিকার কোন একটি শহরের উপর ক্লিক করুন। দেখবেন শহরটির নাম দেখায় সংগে শুধুমাত্র ঐ ষ্টেটের সংক্ষিপ্ত কোড শো করে; কোন দেশের নাম দেখায় না।
কারণ, আমেরিকা তো ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি।
৩) নিউ ইয়র্ক শহরকে বলা হয় ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড বা বিশ্বের রাজধানী। নিউ ইয়র্কের বাসিন্দাদের বলা হয় নিউইয়ার্কার। বিশ্বের প্রায় ১৯২টি দেশের মানুষ এই শহরে বসবাস করে। এই শহরে বসবাস করতে কোন বৈধতার দরকার পড়ে না; যে কেউ বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে কোন রকমে একবার যদি নিউ ইয়র্ক শহরে ঢুকে পড়তে পারে- ব্যস তার আর কোন সমস্যা নেই। নিউ ইয়র্কে সবাই বৈধ। নিউ ইয়র্কের সকলেই নিউ ইয়ার্কার এবং সকলেই কোন জিজ্ঞাসা ছাড়াই পাবেন আইডিএনওয়াইসি বা নিউ ইয়র্ক সিটি আইডি কার্ড। পুলিশের পর্যন্ত কোন ক্ষমতা নেই কাউকে তার বৈধ কাগজ রয়েছে কিনা প্রশ্ন করার।
কারণ এটা ইন্টারন্যাশনাল শহর; এটার মালিক সবাই।
৪) ইন্টান্যাশনাল শহরের পুলিশের ক্ষমতা শুনবেন?
– ধরুন পুলিশ আপনাকে ধরতে এসেছে কারো অভিযোগের ভিত্তিতে। আপনি দরজা খুলছেন না। পুলিশ আপনাকে সর্বোচ্চ অনুরোধ করার ক্ষমতা রাখে দরজা খুলে দেবার জন্য। আপনি না খুললে- পুলিশের কোন ক্ষমতাই নেই আপনাকে সে এ্যারেষ্ট করে। ইভেন আপনার বাসার দরজায় কোন টোকা দেবারও ক্ষমতা রাখে না কোন পুলিশ অফিসার।
– পুলিশ আপনাকে এ্যারেষ্ট করেই ফেলল। আপনি যত বড় অপরাধীই হোন না কেন- আপনি যদি এবার বলে বসেন- আমি তোমাদের সাথে কোন কথা বলবো না, ব্যস, পুলিসের সব ক্ষমতা শেষ। আপনার এটর্ণী না আসা পর্যন্ত পুলিশের কোন ক্ষমতাই নেই আপনাকে কোন প্রশ্ন করার। গায়ে হাত তো অনেক পরের হিসাব।
– পুলিশ আপনাকে এ্যারেষ্ট করেই ফেলেছে। আপনি হাতে সামান্য ব্যাথা পেয়েছেন- শুধু একটা অভিযোগ দায়ের করে দেন ঐ পুলিশের বিরুদ্ধে; এবার দেখুন অবস্থা- বল কোন দিকে দৌড়ায়!
– রাস্তায় কোন পুলিশ আপনাকে আপনার আইডি দেখাতে বলার ক্ষমতাও রাখে না।
– আপনার কোন এসেট বা প্রাপার্টি ওয়ারেন্ট ছাড়া সার্চ করারও কোন ক্ষমতা নেই পুলিশের।
কারণ ঐ একটাই- আপনি তো ভাই ইন্টারন্যাশনাল শহরের অধিবাসী। আপনার ক্ষমতাই সবার আগে। আপনার সেবার জন্যই তো পুলিশ। সে আপনার চাকর, আপনার পাহারাদার।
আরো কিছু বলার ছিল। আজ আর পারছি না। ঘুমুতে হবে।
   Send article as PDF