থ্যাংক য়্যূ

সব গল্পের পেছনেই একটা করে গল্প থাকে।
যেটাকে বলে ‘বাহাইন্ড দ্য ষ্টোরি’ বা ‘শানে-নজুল’।

স্যার আইজ্যাক নিউটন সাহেব অনেক কষ্ট করে, দীর্ঘ সময় নিয়ে, জটিল সব গবেষণা করে লিখলেন ‘ক্যালকুলাস’। পানডুলিপি যখন শেষ পর্যায়ে- ঠিক তখনই তার অতি প্রিয় পোষা কুকুরটি মোমবাতি উল্টে দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলল সেই ‘ক্যালকুলাস’।

ব্যাচারা নিউটন!
কি আর করবেন? আবার পুরো শক্তি নিয়ে নতুন করে বসে পড়লেন সেই ক্যালকুলাস লিখতে এবং লিখলেন।

এটা ইতিহাস।
কারণ ক্যালকুলাস এবং নিউটন দু’টোই অতি বিখ্যাত বিষয়।

এবার নিজের কথা বলি।
আমার এসএসপি পরীক্ষার পর আমি সুযোগ পেলেই মিরপুরের বোটানিকেল গার্ডেনে বিশেষত বিকেল বেলায় ঘুরতে যেতাম। বিকেল সময়টুকু আমার যে খুব বেশী প্রিয়।

এমন কোন সপ্তাহ ছিল না যে আমি একবার, দুইবার না যেতাম।
যাই হোক, সেই যাতায়তের কোন একপর্যায়ে একটি বিশেষ স্মৃতিময় ঘটনার আবির্ভাব হলো আমার জীবনে।

১৯৯৭ সালের বন্যার সময় এসে সেই ঘটনায় কিছু রং-চং মেখে ভাবতে লাগলাম এটা উপন্যাস জাতীয় কিছু যদি লিখে ফেলি তাহলে তো খারাপ হয় না! এই বয়সেই যদি বিখ্যাত-টিখ্যাত কিছু একটা হয়ে যাই মন্দ কি!

যাই হোক।
বাংলাদেশে কমপিউটারের প্রথম পর্যায়েই আমার কমপিউটারে হাতেখড়ি।

আমার একটা কমপিউটার স্কুল হলো।
এরপর কমপিউটার নিয়েই জীবনের বেশী ভাগ সময় পার হতো। এরমধ্যে নিলক্ষেতে একদিন ইউসড একটি ‘কমপ্যাক’ ব্রান্ডের 80486 ল্যাপটপ মেশিন পেয়ে গেলাম মাত্র ৪০,০০০ টাকায়- খুব শখ; কিনেই ফেললাম।

সেটা ৯৬ সালের কথা- ওই সময় ল্যাপটপ মানে বিশাল ব্যাপার। ল্যাপটপ নিয়ে ঘুরি; খুব মজা। ৯৭ সালে বাংলাদেশে একটা দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হলো। আমার অফিসে পানি উঠে গেল; সুতরাং অফিস বন্ধ।

বন্যা হলেই আমার আব্বা একটা ছোট নৌকা কিনতেন।
ওবারও কিনলেন।

আমি সারাদিন সেই নৌকায় বসে ল্যাপটপ চালাতাম।
হঠাৎ একদিন মাথায় আসলো- আরি! এটাই তো মোক্ষম সময় আমার উপন্যাস লেখার।

লিখতে শুরু করলাম।
বেশীরভাগ কাজই বন্যার মধ্যে এগিয়ে গেল।
সর্বমোট প্রায় ৫/৬ মাস লেগে গেল লিখতে। আমি ঐ ল্যাপটপেই কিন্তু লিখেছি- কাজেই কোন হাতে লেখা পানডুলিপি ছিল না।

বাংলাবাজারের ‘রেমন পাবলিকেশন্স’ এর কর্ণধর রাজন ভায়ের সাথে পরিচয় হল। ভদ্রলোক কিছুটা পড়েই আমাকে বললেন- আমি এটা প্রকাশ করবো।

আমি তো খুব খুশী।
ভদ্রলোককে ‘ট্রেসিং আউট’ করে দিয়ে আসলাম। কভার পেইজটি আমি একজনকে দিয়ে করিয়ে সেটাও দিলাম। তারপর চলল প্রতিক্ষা। ছাপার হরফে, মোটা কভারে প্রিন্ট হয়ে প্রকাশিত হবে আমার প্রথম উপন্যাস; সে কি কষ্টকর আনন্দময় অপেক্ষা!

যা-ই হোক, প্রতিক্ষা আর শেষ হয় না।
রাজন ভাই প্রতি সপ্তাহেই বলেন আগামী সপ্তাহে আসেন- এর মধ্যে হয়ে যাবে। ৩ মাস হয়ে গেল। উনিও বুঝলেন সময়টা মনে হয় একটু বেশীই হয়ে গেল! আমাকে নিয়ে প্রেসে গেলেন; প্রেসওয়ালা আমার কোন ট্রেসিংই খুঁজে পেলেন না।

আমি খুব সহজে ‘বিরক্ত’ বা ‘বিস্মৃত’ হই না।
বাংলাদেশ ভূখন্ডে বসবাস করি তো- এদেশে বসবাস করতে হলে বিরক্ত বা বিস্মৃত হতে নেই; যে-কোন অনঅভিপ্রেত পরিস্থিতির জন্যই প্রস্তত থাকতে হয়।

কিন্তু কষ্ট হলো এজন্য যে, আমি আমার ল্যাপটপের উইন্ডোজ ৩.১ ভার্ষন ফরমেট করে উইন্ডোজ ৯৫ ইন্সটল করেছি। এবং আমার লেখা উপন্যাসের কোন কপি রাখিনি।

সুতরাং, আমি যেহেতু মহা বোকা; সেহেতু আমার জন্য এটাই উচিৎ শিক্ষা হয়েছে!

স্যার নিউটনের চিন্তা মাথায় আসলো।
উনি যদি ক্যালকুলাসের মতো একটা রসকসহীন বিষয় দ্বিতীয়বার লিখতে পারেন- আমি কেন মজার কিছু স্মৃতিময় উপন্যাস দ্বিতীয়বার লিখতে পারবো না।

আবার বসে পড়লাম।
শুরু করলাম, শেষও হলো।

আমি খুশী হলাম, দ্বিতীয়বারের লেখাটা প্রথমবারের চেয়ে পরিপক্ক হয়েছে। রাজন ভাইয়ের কাছে আর যাবো- প্রশ্নই আসে না!

গেলাম ‘বর্ণবিচিত্রা’য়।
উনি সম্পর্কে আমার মামা। বললেন, ‘তুমি যদি টাকা দাও তাহলে আমি ছাপতে পারি।’

দিলাম টাকা। উনি ছাপলেন।

সপ্তাহখানেক পর ‘বইমেলা ২০০০’ এ বর্ণবিচিত্রা প্রকাশনীর ষ্টলে আমার বইটি দেখা গেল, উপন্যাসটির নাম ‘থ্যাংক য়্যূ’। বেশ বিক্রিও হয়েছিল। আমার কাছে এখন আর অবশিষ্ট ১টি কপি রয়েছে, সংগে করে আমেরিকায় নিয়ে এসেছি।

প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস প্রথম সন্তানের মতোই।
তবে, যে বিষয়টা আমাকে সবচে বেশী আন্দোলিত করেছিল; সেটা বলি।

আমি কয়েকটি কপি নিয়ে বাড়ীতে গেলাম।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পর রাতে আব্বার হাতে একটি কপি দিলাম; সাহস করে বললাম, ‘আব্বা, এটা আমার লেখা; আজই প্রকাশিত হয়েছে’। আব্বা বইটি নিলেন।

এখানে বলে রাখি, আমার আব্বা অফিসে ব্যস্ত থাকতেন, বাড়ীতে দৈনিক পত্রিকা ছাড়া বই কখনো পড়তে দেখতাম না। কিন্তু আমার সেই আব্বা আমার লেখা বইটি ঐদিনই পড়ে শেষ করেছিলেন এবং আমাকে নয়, আমার মা’র কাছে আমার লেখার খুব প্রশংসা করেছিলেন।

অনেক বছর হয়ে গেলো, প্রায় ২০ বছর। সেই হিসাবে প্রায় ২০ বছর পর ‘রেমন পাবলির্শাস’ এর রাজন ভাইয়ের নামটা আমার মনে রাখার কথা নয়। কিন্তু ওনাকে আমার কখনো-ই খারাপ মানুষ বলে মনে হয়নি। হয়তো তখন তিনি ‘কোন সমস্যার সময়’ পার করছিলেন।

যাই হোক, ওনাকে মনে রাখার কারণটিও বলে দিই, সম্ভবত বিষয়টিতে তিনিও অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন বা ওটা ছিল তার চরিত্র-বিরোধী।

ওনি আমাকে একদিন ফোন করে ডেকে নিয়ে একটা গিফট দিয়েছিলেন। আর সেই গিফটটা ছিল ১৫০০ বই যার মধ্যে দেশের বিখ্যাত লেখকদের অনেক মজার মজার গল্প, কবিতা, উপন্যাস ছিল।

বইগুলো আরও সমৃদ্ধ করেছিল আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীটিকে।

   Send article as PDF