বাবা-চাচার জাতীয় সংবাদ

তখন আমি অনেক ছোট।
স্কুলে পড়তাম, আমার বাবা ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা। আমাদের গ্রামের বাড়ীতেই তখন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকাটি নিয়মিত রাখা হতো।

সেই গ্রামে প্রতিদিন পত্রিকাটি পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে যেত; তারপরও প্রতিদিনই পেতাম; পত্রিকা মানেই শান্তি। এই বিশাল দুনিয়ার যাবতীয় খবরাখবরের লোভ নিবারণ করতো আমার সেই শৈশবের প্রিয় দৈনিক পত্রিকাটি।

তখন হয়তো ক্লাস ফাইভে বা সিক্সে পড়ি।
সম্ভবত রবিবার তখনও সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল। একদিন দুপুরে আমার সবাই খেতে বসেছি। আমার আব্বা আমার পত্রিকা পড়ার এই আগ্রহকে খুবই মুল্যায়ন করতেন; উৎসাহ যোগাতেন। ঐ খাবারের সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই যে তুমি প্রতিদিন পত্রিকা পড়ার জন্য উম্মাদ হয়ে থাকো, কোন সংবাদটি তুমি প্রতিদিনই পড়ো এবং কেন পড়?’

এমন প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না- তারপরও স্বাভাবিকভাবেই বললাম, ‘আমি আন্তর্জাতিক এরপর জাতীয় রাজনীতি, প্রতিটি বিজ্ঞাপন, এবং সবচে মনোযোগ দিয়ে পড়ি সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয়গুলো।’

আমি জানি না আমার এমন একটা উত্তরের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন কি না। তবে তিনি একই সংগে হতবাক এবং অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন যে আমি প্রতিদিন ‘সম্পাদকীয়’ পড়ি এটা জেনে। তিনি হয়তো ভাবতেই পারেননি যে আমি ঐটুকুন বয়সে পত্রিকার সম্পদকীয়, তাও আবার মনোযোগ দিয়ে পড়ি।

যাই হোক, সম্পাদকীয় আমার বরাবরই ভালো লাগতো। আর ইত্তেফাকের সেই সময়ের সম্পদকীয়গুলো নির্ভেজাল, নিরপেক্ষ এবং বুদ্ধিদীপ্ত হবার পাথেয়।

জাতীয় সংবাদগুলো তো পড়তামই। এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় তখন। কিন্তু ঐ সময়ই নিয়মিত যেটা আমার বিরক্তি যোগাতো সেটা ছিল ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেবজাদাদের ব্যক্তিগত নিউজ।

ইত্তেফাকে যেহেতু বড় করেই লেখা থাকতো এর প্রতিষ্ঠাতা তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, এবং আমি জানতাম যে এই সাহেবজাদারা তারই গুণধর সুপুত্র; আব্বার থেকেই জেনেছিলাম তাদের পরিচয়টুকু। সুতরাং প্রতিদিন প্রথম পাতায় এই দু’পুত্রের সংবাদটুকু প্রকাশ করতেই হবে!

এরপর একদিন হঠাৎ চোখে পড়লো ইত্তেফাকের কোন এক জেলা বা থানার স্থায়ীয় একজন সংবাদদাতার বৃদ্ধ পিতা বার্ধক্যজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেছে- সেটাও নিউজ। আর ইত্তেফাক যেহেতু একটি প্রধান জাতীয় পত্রিকা; সুতরাং তাদের চাপাইনবাগঞ্জের কানসাটের সংবাদদাতা বা কুড়িগ্রামের রাজীবপুরের স্থানীয় সংবাদদাতার পিতা বা মাতা মারা গেলে সেটাও ‘জাতীয় সংবাদ’ হিসাবেই ছাপা হয়!

আমি প্রচন্ড হেসেছিলাম, নিজে নিজে- একটা জাতীয় পত্রিকার চরিত্র দেখে।

আমি সেই কৈশরেই প্রচন্ড লজ্জা পেয়েছিলাম, এমন একটা দেশে আমরা বসবাস করি- যেখানে ‘এসব’ অপ্রয়োজনীয় নিউজও প্রথম বা শেষ পাতায় প্রকাশিত হয়; যেখানে একই সংগে প্রকাশিত হয় প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান বা প্রেসিডেন্ট গর্ভাচেভ কিংম্বা প্রেসিডেন্ট এরশাদ, বেগম জিয়া বা শেখ হাসিনার নিউজ এবং রাজীবপুরের স্থানীয় সংবাদদাতা জনৈক গোলাম হোসেনের পিতা কামাল হোসেন ৮৭ বছর বয়সে বাধ্যর্কজনিত রোগে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না … … … রাজেউন)।

এরপর থেকে এসব ‘বিরক্তিকর’ সংবাদগুলি দেখলেই আমি উচ্চাস্বরে হাসতাম, লোকজন থাকলে অবশ্য বাঁকা হাসি হাসতাম। এখনও হাসি যখন এই তো গত ২/৩ দিন আগেও দেখলাম মানবজমিনের কোন স্থানীয় সংবাদদাতার মা মারা গেছে। আমার সিমপ্যাথি জন্মায় না, হাসি পায়।

কতগুলি গাধা সংবাদপত্রের মালিক ও সম্পাদক হয়েছে বলে তারা তাদের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সংবাদকে জাতীয় সংবাদে পরিণত করে ফেলেছে। কতটা অযোগ্য, অথর্ব লোকজন বাংলাদেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে- আমার বাঁকা হাসিটা তার জন্যই। বাঁকা হাসিটা ওসব সম্পাদক প্রকাশক আর তার মালিকদরে মুর্খতার জন্য উৎসর্গকৃত।

কোন সংবাদটাতা কোথায় প্রকাশিত হবে, কোন সংবাদটির সংবাদ হবার গুরুত্ব পাবে কি না; সেটাই তো এরা জানে না। তারা জানেই না যে, ‘কোন ঘটনা যখন স্বাভাবিকতা হারায় সেটাই তখন সংবাদ হয়’। কোথাকার কোন আবুলের বৃদ্ধ পিতা মারা যাওয়াটা যে সংবাদ হতে পারে না- সেটা বাংলাদেশের সাংবাদিকবৃন্দ জানেই না।

বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলোও ঠিক তাই; তারাও তাই করে যাচ্ছে।

যাই হোক, আজ এত বছর পর খুব আত্মতৃপ্তি লাগছে।
সিএনএন এর বর্তমান সময়ের সবচে জনপ্রিয় সাংবাদিক ক্রিস কুওমো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। গত সপ্তাহে তাকে আমি সর্বশেষ সিএনএন এ ‘কুওমো প্রাইম টাইম’ অনুষ্ঠানে দেখেছি; আমি তার ভক্ত। তার অনুষ্ঠানের ভক্ত। মিস করি না। কিন্তু হঠাৎ করেই আজ প্রায় ৫/৬ দিন হয়ে গেছে সে সিএনএন এ অনুপস্থিত।

আমি বার বার সিএনএন চ্যানেলে তাকে খুঁজে বেড়াই, কিন্তু তিনি নেই; তার কোন খোঁজ-খবরও নেই।

সিএনএন এই পৃথিবীর সবচে জনপ্রিয় এবং সবচে বড় সংবাদমাধ্যম আর ক্রিস কুওমো সেই সিএনএন এর সবচে জনপ্রিয় সাংবাদিক, এবং একই সংগে সে নিউ ইয়র্কের গভর্ণর এন্ডু কুওমো’র ছোট ভাই। অথচ মানুষটা হারিয়ে গেছে, কোন খবর নেই।

অবশেষে আজ জানতে পারলাম তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত।
না, কোন নিউজে এটা প্রচার হয়নি; সিএনএনও ১টি বারের জন্য প্রচার করেনি। কারণ এটা নিউজ হবার যোগ্য কোন সংবাদ নয়। প্রাইম মিনিষ্টার বরিস জনসনদের করোনা পজেটিভ যেখানে নিউজ হয় সেখানে ক্রিস কুওমো কোন নিউজ নয়।

এটা সিএনএন জানে, বুঝে।
আর তাইতো সিএনএন সংবাদ জগতের শীর্ষে অবস্থান করে সারা বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে আর বাংলাদেশের সংবাদ পত্র ও টিভি চ্যানেগুলি ভারতীয় পত্রিকা থেকে কপি করে সংবাদ পেষ্ট করে পত্রিকা চালায় বলেই আবুলের বাবা কাবুলের ডায়রিয়াও সংবাদ হয়ে যায়।

তাছাড়া হবেই বা না কেন?
শেখ হাসিনা আর ঐ কাবুলের যোগ্যতা তো একই সমান।

আর, তাই তো এটিএন বাংলার মালিকানার জোরে আজ বাংলাদেশে সংগীত শিল্পীতে পরিণত হয়েছে ইভা রহমান ও বুকের উপর প্যান্ট পড়া সেই ভদ্রলোক মাহফুজুর রহমান না কি যেন নাম তার! গান করার নূণ্যতম যোগ্যতাও যাদের নেই, তারাই।

পার্থক্য হচ্ছে শেখ হাসিনা বন্দুকের নলে ক্ষমতায় রয়েছে আর কাবুলের হাতে বন্দুকটি নেই; কাবুলকে বন্দুকটি দিন- দেখতে পাবেন সেও ঠিক-ঠাক হাসিনার মতোই সব দখলে রাখতে পারবে।

বাংলাদেশে যোগ্যতা লাগে না, বন্দুক থাকলেই চলে।
বৃটিশরাতো ২০০ বছর ঐ একটি বন্দুক দিয়েই ভারতবর্ষকে শাসন করে গেল; এখনও ঐ বন্দুটিই ভরসা।

যোগ্যতা দিয়ে হবে টা কি?

যাই হোক, আমার সেই বাঁকা হাসিটা যে পবিত্র ছিল, নির্মল ছিল সেটা আজ সিএনএন থেকে স্বীকৃতি পেয়ে আনন্দ লাগছে।

   Send article as PDF