বাংলাদেশের সংবিধান!!!

মাথায় জট লেগে রয়েছে বেশ কয়েকদিন।
 
দু’টো বিষয় নিয়ে লিখবো- একটা হলো ‘রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি ও গণতন্ত্রায়ন’ এবং অপরটি ‘বিচারপতি ও তাদের নিয়োগ’ নিয়ে।
 
তত্ব, তথ্য, লজিক, পয়েন্টস এবং উদাহরণ সবই মাথায় ঘুরছে কিন্তু কী-বোর্ডে ফিংগারগুলি বসালেই আলসেমীতে পেয়ে বসছে!
 
কি যে করি?
কিছুই লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
 
দিন কয়েক আগে কে যেন একজন জানতে চাইলেন বাংলাদেশের সংবিধানটি কে লিখেছেন?
 
খুবই যুৎসই একটা প্রশ্ন।
এই প্রশ্নটির উত্তরও বাংলাদেশের মানুষ সঠিকভাবে জানে না।
 
ড. কামাল হোসেনকে সকলেই দেখিয়ে দেয়- সংবিধানের প্রণেতা হিসাবে। আসলে-ই কি তাই?
 
একটা দেশ কিভাবে চলবে, কিভাবে তার আইন-প্রণয়ন হবে, সরকার ব্যবস্থা কিরূপ হবে, কিভাবে সরকার নির্বাচিত হবে, অর্থনীতি, অর্থব্যবস্থা, বিচার ও আইন এবং আইন বিভাগ পরিচালনা, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, যোগাযোগ, ডাক ব্যবস্থা ইত্যাদি সবই একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে এবং সেই নিয়মতান্ত্রিকতাকেই সংবিধান বলা হবে।
 
বাংলাদেশের কি আদৌ কোন সংবিধান রয়েছে?
প্রায় ১০০ বছর বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং বাকী একশ বছর বৃটিশ রাজ কর্তৃক শাসিত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ। তারও আগে শাসিত হয়েছে মোঘল সাম্রাজ্যের আওতায়। মোঘলদের আগে হাজার হাজার স্থানীয় জমিদাররাই ছিল ভারতীয় উপমাহাদেশীর সরকার। ওসব জমিদারদের ‘ইচ্ছে’-ই ছিল তখনকার ‘সংবিধান’।
 
মোঘলদেরও সেভাবে কোন সংবিধান ছিল না। রাজার ইচ্ছাই আইন। ইচ্ছাই সংবিধান (যেমনটা এখন হাচিনার ইচ্ছাই সংবিধান)।
 
তৎকালে রাজা চাইলে রাষ্ট্রিয় কোষাগার শূণ্য করে নিজ প্রায়ত স্ত্রীর জন্য ‘তাজমহল’ও বানিয়ে ফেলা হতো- পরিণামে পুরো দেশবাসীকে মোকাবেলা করতে হতো দুর্ভিক্ষের (চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে আবার কোন কোন প্রেসিডেন্ট তার ছেলেদের বিয়েতে কোটি টাকা খরচ করেছেন- তিনি আবার জাতির নাকি পিতাও!)।
 
যাই হোক।
বলছিলাম ‘সংবিধান তৈরী’ নিয়ে।
 
জমিদার বা মোঘল রাজাদের আমলেও জমিদার বা রাজারাই বিচারকার্য পরিচালনা করতো- দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া। রাজ পরিবারের খরচের পর কিছু থাকলে সেই অর্থে অর্থ ব্যবস্থাপনা হতো রাষ্ট্রের, প্রজাদের।
 
বৃটিশরা ভারতবর্ষকে তাদের আদলে একটা রাষ্ট্রিয় অবকাঠামো, পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বিভাগ, কেন্দ্রিয়- আঞ্চলিক ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য বিষয়াবলী ও তার পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে একটা ‘সংবিধানের মতো’ কিছু তৈরী করে দিলেন।
 
তারপর ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন।
ভারত ও পাকিস্তান নামীয় দু’টো (আদতে তিনটি) রাষ্ট্রের উদ্ভব হলো।
 
ভারতীয়রা পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যেই নিজেদের জন্য একটা ‘সংবিধান’ (যা মুলতঃ বৃটিশদের দেয়া সংবিধানের কিছুটা কাটছাট করে ফটোকপি করা) তৈরী করলো; তবে সেটাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির কেন্দ্রিয় সরকার প্রতিষ্ঠা করলো। এবং তারা ওটাতেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে থাকলো। এবং তারা অবশ্যই সেই সংবিধানকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকতে পেরেছে।
 
অপরদিকে, পাকিস্তানীরা কোন সংবিধান প্রণয়নের দিকে না গিয়ে কে সিংহাসনে বসে ‘ক্ষমতা এনজয়’ করবে- সেই পরিকল্পনায় দিনাতিপাত করতে লাগলো। ১৯৪৭ সালে একটা স্বাধীন দেশ গঠন করে কোন যৌক্তিক বা দিক-নির্দেশনা ব্যতীতই তার প্রথম সাধারণ নির্বাচন করার সময় হলো ১৯৭০ সালে এসে। বৃটিশদের দিয়ে যাওয়া সেই সংবিধানটিতে তারা বলতে গেলে শুধুই ‘বৃটিশ’ শব্দটিকে প্রতিস্থাপন করে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি বসাতে পেরেছিল। পরিবর্তন বা সংযোজন যেটুকু হলো সেটা শুধুই বৃটিশ রাজের পরিবর্তে নির্বাচিত রাজারা দেশ চালাবেন।
 
পাকিস্তান গেল। বাংলাদেশ হলো।
একটা সংবিধান দরকার। ড. কামাল হোসেন সাহেবদের নেতৃত্বে সেই সংবিধানের ‘পাকিস্তান’ শব্দটি কেটে ‘বাংলাদেশ’ প্রতিস্থাপনা করা হলো এবার।
 
জোড়াতালি দেয়া ছেড়া মডার্ণ জিন্স প্যান্টের মতোই তৈরী হয়ে গেল রেডিমেড সংবিধান।
 
এরপর সেই রেডিমেড সংবিধানে ঐ ছেড়া জিন্স প্যান্টের মতোই ‘সংশোধনী’র নামে ক্ষমতাসীন সরকারের নেতৃত্বে ও স্বার্থে একবার কিছু অংশ কাটা হয়, আবার কিছু অংশ জোড়াতালি দেয়া হয়।
 
এটাই বাংলাদেশের সংবিধান।
এটাতে কোন সৌন্দর্য নেই, এটাতে কোন স্বকীয়তা নেই, এটাতে কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না, এটাতে গণতন্ত্রের কোন অস্তিত্বও থাকে না। এটাকে শুধুই স্বার্থের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে, হচ্ছে ঠিক যেভাবে ব্যবহার করা হয় বাজারের নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের শরীর।
 
বৃটিশরা এই পৃথিবীর প্রায় ৭০% ভুখন্ড দখল করার সামর্থ দেখিয়েছিল। এবং তাদের দখলিকৃত- পরবর্তীতে ছেড়ে যাওয়া ভুখন্ডগুেলের অধিকাংশে বলতে গেলে এখনও তাদের দেয়া সংবিধানই ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। তারা ওভাবে কাটাছেড়া করেনি যেভাবে করা হয়েছে বাংলাদেশেরটা।
 
একমাত্র ব্যতিক্রম আমেরিকা।
আমেরিকা বৃটিশদের বিদেয় করার পর তাদের সংবিধানটিও আস্তাকুড়ে ছুড়ে মেরেছিল। আর তাই তো আমেরিকান কন্সিটিউশনে বৃটিশদের কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।
 
আমেরিকান গণতন্ত্র, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, বিচার বিভাগ সবই অনন্য, সবই ভিন্ন, সবই সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।
 
একটা জাতিকে, একটা দেশকে উত্তীর্ণ হতে হলে ‘কাটপিস’ দিয়ে নয়- নিজস্বতা দিয়ে, দূরদর্শীতা দিয়ে, সভ্যতা দিয়ে, এবং দেশের গণমানুষের স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দিয়ে, গণমানুষের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, গণমানুষের অধিকারকে সব কিছুর আগে স্থান দিয়ে যদি তৈরী করা যায় একটা সংবিধান- তাহলেই একটা দেশ শুধু সামনে এগুতে পারে।
 
সামনে এগুনোর মতো বাংলাদেশের ঠিক কি রয়েছে- বলতে পারবেন?
 
এনিওয়ে এখন যেটা নিয়ে লিখলাম- সেটা নিয়ে দশ মিনিট আগেও কিছু ভাবিনি। দেখা যাক ভেবে রাখা বিষয়দু’টিকে আর্টিকেলে রূপ দিতে পারি কি না।
   Send article as PDF