আনন্দ আনন্দ

১৯৯৭। ঢাকা
মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফি জেতার সাফল্যে বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহনের যোগ্যতা অর্জন করে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের দারুন এক আনন্দের দিন। বাংলাদেশের মানুষ আনন্দ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেদিনের সেই আনন্দ সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেল। বাংলাদেশের লাখো কোটি মানুষকে সেদিন সেই আনন্দের বাড়াবাড়ির খেসারত দিতে হয়েছিল। এমন কোন মানুষ সেদিন ছিল না যাকে রং দিয়ে লালে লাল করে দেয়া হয়নি। অনেকে চাকুরী’র ইন্টারভিও বা হাসপাতালে তার প্রিয়জনকে দেখতে যাওয়াটাও গৌণ হয়ে গিয়েছিল আমাদের আনন্দের কাছে। অনেক বিদেশী অতিথী, গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এর অংশগ্রহণকারীদেরও ওই আনন্দের খেসারত দিতে হয়েছিল সিদিন। কেউ বাদ যায় নি। বাঙালী সেদিন বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে- আনন্দ কি জিনিস, কত প্রকার ও কি কি?
 
এরকম আনন্দ এখনও আমরা দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থার্টি ফাষ্ট নাইটে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাটিঠে কোন অভাগা তরুনীকে সকলের সামনে জামা-কাপড় টেনে ছিলে ফেলে আমাদের দেশের সোনার ছেলরা। আমরা আনন্দপ্রবণ জাতি। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য।
এখানেই আমাদের আনন্দ শেষ নয়।
 
আরোও বেশী আনন্দও আছে আমাদের দেশেই। বাংলাদেশের কয়টা মেয়ে বলতে পারবে যে- পাবলিক বাসে উঠে ভীড়ের মধ্যে বাস কন্ডাক্টার বা অন্য কোন পুরুষ হাতের পিষ্ঠ না হয়েছেন? ঢাকার গাউছিয়া’র ভীড়ের চাপে নোংড়ামির শিকার হননি এমন কোন ভদ্রমহিলা খুঁজে পাওয়া রীতিমত গবেষণার বিষয় আমাদের সোনার বাংলাদেশে!!!
 
২০০৩। কলকাতা
হঠাৎ ইচ্ছে হল কলকাতায় থার্টিফাষ্ট নাইট উৎযাপন করতে যাব। অনেক শুনেছি, নিজের চোখে দেখতে চাই ওরা কেমন মজা করে।
ওরাও বাঙালী। গেলাম কলকাতা। নিউ মার্কেট, পার্ক ষ্ট্রিট এলাকায় রাত ১২টা থেকে প্রায় ৩ টা পর্যন্ত কাটালাম।
 
কত সুশৃঙ্খল, কত আনন্দ। সবাই দল বেধে মজা করছে রাস্তার পাশে ফুটপাতে, রেষ্টুরেন্টে। কেউ রাস্তায় নামছে না; কেউ কাউকে ধাক্কা দিচ্ছে না। সবাই যার যার মত। কেউ অন্যের সমস্যার কারণ হচ্ছে না। কত আনন্দ। কত আনন্দ।
 
তারপর ব্যাংকক, কুয়ালা লামপুর, স্যাংহাই ও হংকং এ সৌভাগ্য হয়েছে থার্টি ফাষ্ট নাইট দেখার, চাইনিজ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আনন্দের অংশীদার হবার।
শৃঙ্খলা ও আনন্দ সাথে অন্যের বিরক্তির কারণ না হওয়া।
 
২০০৯। গৌহাটি
অনেক সভ্যতার মধ্যেও আমার দেখা বিশ্বের সবচে নোংড়া দেশ ভারত। ওদেশের মানুষ বাথরুমের বদলে রাস্তায় প্রস্রাব করাটাকেই বেশী গুরুত্ব দেয়। আর সেই বিশাল ভারতবর্ষের মধ্যে সবচে অপরাধপ্রবণতার শীর্ষস্থানগুলির মধ্যে অন্যতম আসামের রাজধানী গৌহাটি। ওখানকার মানুষগুলি নাকি উগ্র। কলকাতা ও আগরতলা থেকে এমনটাই ধারণা নিয়ে গৌহাটি গেলাম।
ঘটনাক্রমে আমার ফেরার দিন ছিল ‘হলি উৎসব’। আগের দিন লক্ষ্য করলাম পুরো শহরময় নানা রঙের ‘রং’ বিক্রি হচ্ছে দোকানে, রাস্তার ফুটপাতে।
যা-ই হোক, সকালে ঘুম ভাংলো হোটেলে। টিভি ছাড়লাম। কোন কোন টিভিতে লাইভ হলি উৎসব দেখাচ্ছে। মানুষ একে অপরকে রং ছিটাচ্ছে। ইনজেকশনের সিরিঞ্জে তরল রং নিয়ে একে অপরকে আক্রমন করছে।
আমি গোসল করে রেডী হয়ে নিচে যাব, ব্রেকফাষ্ট করে একটা রিক্সা নিয়ে ২ ঘন্টা ঘুরবো। দুপুরের পর আমার আগরতলার উদ্দেশ্যে আমার বাস ছাড়বে।
নীচে নামার পর রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। আমার হোটেলের নীচেই অনেককে দেখছি হলি খেলছে। কিন্তু কিছটা অবাক ও বিস্ময় নিয়ে দেখলাম আমাকে কেউ টার্গেট করছে না। রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম, কেশিয়ারের সাথে কথা বললে সে আমাকে আশ্বস্ত করলো আপনাকে কেউ রং দেবে না; আপনি তো অতিথি।
 
কিন্তু আমি যে অতিথি, সেটা এরা কিভাবে বুঝবে?
ভদ্রলোক বললেন, বোঝা যায়, তাছাড়া আপনি ভাল জামা-কাপড় পড়েছেন; আপনি কারো টার্গেট হবেন না। নিশ্চিন্তে বেড়িয়ে পড়ুন।
 
আমি একটা রিক্সা ঘন্টা হিসাবে ভাড়া নিয়ে ‘নিশ্চিন্তে’ বেড়িয়ে পড়লাম। রংগারঙ্গির মধ্যে দিয়ে আমার রিক্সা যাচ্ছে- আমাকে সবাই দেখছে কিন্তু কেউ আমাকে আক্রমণ করেছে না।
 
গৌহাটি রেল ষ্টেশনের পার হবার পর একটি ফ্লাইওভারের নীচে ৩/৪ টা ছেলে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। ওরা আমার রিক্সা থামালো। আমি ওদের বললাম, দেখ- আমি একটু পর আমার বাস, আমি তোমাদের আনন্দ দেখতে বের হয়েছি। আমার জামা-কাপড়টা নষ্ট করো না প্লিজ।
 
ওরা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, তোমাকে কেউ ঝামেলা করবে না- তুমি নিশ্চিন্তে যাও। আমি শুধু গৌহাটি বাসীর পক্ষ থেকে তোমার কপালে সামান্য একটু রঙের আঁচড় দেব এবং তুমি তোমার রুরে যেয়ে রুমাল দিয়েই তুলে ফেলতে পারবে। তবে, তুমি অনুমতি না দিলে দিব না।
ছেলেটার কথায় আমি খুব মজা ও আনন্দ পেলাম এবং ওকে অনুমতি দিলাম। সে আমার কপালে খুব হালকা করে একটি টিপের মতো একে দিল। তারপর হাসি মুখে বিদায় দিল।
 
২০১৫ । নিউ ইয়ক।
আজ হ্যালুইন। গত রাত থেকেই আমেরিকা আনন্দে ভাসছে। আমেরিকানরাও ভুত নিয়ে প্রচুর আনন্দ করে। নারী-পুরুষ-কিশোর-কিশোরীরা রংবে-রঙের ভুত-পেত্নী সেজে রাস্তায় ট্রেনে মজা করছে। শিশুরা ছোট ‘ভুত বাস্কেটে’ চকলেট কালেকশন করছে।
 
কিন্তু কেউ কাউকে ভয়ও দেখাচ্ছে না, উক্তত্তও করছে না।
যার যার আনন্দ তার তার কাছে।
 
নিজের আনন্দ নিজের পরিবার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে করে যাচ্ছে। বাইরের কারো বিরক্তির কারণ হচ্ছে না।
   Send article as PDF