ল্যাটিন

’বাংলাদেশ নাকি এখন সত্যি সত্যিই বড়লোক দেশ হয়ে গেছে!’ দেশের বড় বড় মন্ত্রীরাও পর্যন্ত লাফিয়ে লাফিয়ে বলে বেড়াচ্ছে। তাদের নাকি ওহন বার্ষিক মাথাপিছু আয় ২,৫৫৪ ডলার।

মানে দৈনিক একজন বাংলাদেশীর গড় আয় ৭ ডলার; যদিও আমাদের নিউ ইয়র্ক সিটিতে এই ৭ ডলার একজন মানুষের মোটে আধ ঘন্টার আয়ের চেয়েও ৫০ সেন্ট কম। অর্থাৎ একজন নিউ ইয়র্কার প্রতি ঘন্টায় আয় করে কমপক্ষে ১৫ ডলার।

যাই হোক, আমি আমেরিকার সংগে বাংলাদেশকে নিয়ে আর তুলনায় যাচ্ছি না। একটু ভিন্ন গল্প করি তারচে বরং।

আমরা জানি আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটি গোলাকার, কমলালেবুর মতো গোলাকার। ফুটবলের মতো গোলাকার বললে কি সমস্যা হতো- কে জানে?

পৃথিবীটাকে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত বরাবর সোজাসোজি যদি ফুটা করা সম্ভব হতো; ধরুন বাংলাদেশের ঢাকা থেকে একটি লম্বা ও শক্ত দেখে লোহার রড যদি ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব হতো- তাহলে সেই রডটি গিয়ে দক্ষিন আমেরিকার দেশ পেরু‘র রাজধানী লিমার নীচের (দক্ষিনে) দিকে কোন এক গ্রামকে ফুটো করে বের হয়ে যেতো।

দক্ষিন আমেরিকায় পেরু, এবং তার প্রতিবেশী বলিভিয়া, ইকুয়েডর, প্যারাগুয়ে এরা কিন্তু মোটেও ধনী কোন দেশ নয়। বরং যথেষ্ঠ দরিদ্র দেশ বললেও ভুল বলা হবে না।

উল্লেখিত দেশগুলোর কোনটিরই বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় ৬,০০০ ডলারের বেশী নয়; আবার বলিভিয়া বা নিকারাগুয়ার বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় যথাক্রমে মাত্র ৩ হাজার এবং ২ হাজার ডলারের মতো। নিকারাগুয়াতো সেই হিসাবে বাংলাদেশের চেয়েও হতদরিদ্র; ইন্ডিয়ার মতো।

যাই হোক, অতি সম্প্রতি আমি লাটিনের দেশগুলো নিয়ে একটু স্ট্যাডী করার চেষ্টা করে চলছি। ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে। ল্যাটিনের মেক্সিকো থেকে শুরু করে চিলি পর্যন্ত বলতে গেলে সবগুলো দেশের ভাষাই স্প্যানিশ। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ব্রাজিল।

ল্যাটিন আমেরিকার সবগুলো দেশ দীর্ঘসময় স্পেন এর দখলে ছিলো। এবং সেই দীর্ঘ সময়টাতে স্পেনিশ ভাষাটি দক্ষিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পরে। আর ব্রাজিল ছিলো পুর্তগীজদের দখলে, তাই তো তারা পুর্তগীজ ভাষায় কথা বলে। ওরা ইংলিশও জানে না। একমাত্র ব্যতিক্রম ছোট্ট দুটি দেশ গায়ানা ও ফ্রেন্স গায়ানা এরা যথাক্রমে ইংলিশে ও ফ্রাঞ্চ ভাষায় কথা বলে- গায়ানা বৃটিশ ঊপনিবেশিক ছিলো এবং ফ্রেন্স গায়ানা এখনও ফ্রান্সের অংশ; তাদের কারেন্সী ইওরো; এবং ফ্রেন্স গায়ানা টেকনিক্যালি ইওরোপের অংশ। এবং ইওরোপের একমাত্র রকেট উৎক্ষেপন কেন্দ্রটিও এই ফ্রেন্স গায়ানাতেই (লাটিন আমেরিকায়) অবস্থিত- যা ভৌগলিকভাবে ইওরোপিয়ান ভূখন্ডে অবস্থিত নয়।

আর একটা সময় পর্যন্ত নেদারল্যান্ডের দখলে থাকা ভারতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ল্যাটিনের দেশ সুরিনামের রাষ্ট্রিয় ভাষা ডাচ। এ দেশটিরও মাথাপিছু আয় ৬ হাজার ডলারের মতো।

আমরা যদিও ল্যাটিনের মানুষদেরও তাদের ভাষার করণে গণহারে স্প্যানিশ বলে থাকি; আদতে তারা কিন্তু স্প্যানিশ নয়। স্প্যানিশ হচ্ছে স্পেনের অধিবাসীরা। এরা হলো হিস্পানিক। স্পেনের ভাষা এবং হিস্পানিক ভাবের কারণে এদেরকে আমরা স্পেনিশ বলেই ডেকে ফেলি। এদের তিনটি অংশ; মুল দলটি আদিবাসী আমেরিকান বা উত্তরে যাদের রেড ইন্ডিয়ান বলা হয়। আরও একটা অংশ যারা হোয়াইটদের সংগে মিলে-মিশে নতুন ’প্রজন্ম’ বা গোত্র তৈরী করে নিয়েছে – তাদের বলা হয় ’মিষ্টিজো’ – এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আরও রয়েছে নিখাদ হোয়াইট বা সাদারা। ল্যাটিনের দেশগুলোতে যথেষ্ঠ সংখ্যায় হোয়াইট পিপলস বসবাস করে আসছে। এসব হোয়াইটরা মুলত আসছে (এখনও আসতেছে) ইওরোপ থেকে, আমেরিকা থেকে।

আদতে, আমেরিকা বা ইওরোপের কৃত্রিম জীবন যারা পছন্দ করে উঠতে পারছে না; তারাই মাইগ্রেন্ট করে চলে যাচ্ছে ল্যাটিনের দেশগুলোতে। ‍ওখানে জমি খুব সস্তা। খরচ-পাতিও যথেষ্ঠ কম। বিশাল বিশাল জায়গা জমি কিনে ওখানে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করছে ব্যাপক সংখ্যায় ইওরোপিয়ানরা। এবং ওসব দেশের সরকারগুলোও চাচ্ছে তাদের কম জনসংখ্যার দেশে বিদেশীরা দলে দলে আসুক; তাদের ভিসা পলিসি সহজ; ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা আরও সহজ- গেলেই গ্রীনকার্ড দিয়ে দেয়। আর ওসব দেশের পাসপোর্ট থাকলে পুরো ইওরোপ-রাশিয়া–জাপান-ইউকেসহ প্রায় দেড়শ দেশে অন এরাইভাল ভিসা পাওয়া যায়।

এই অধম নিজেও আমেরিকার কৃত্রিম জীবনে হাপিয়ে উঠছি দিনকে দিন। প্রায়ই ভেবে চলছি আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে ল্যাটিনের কোথাও চলে যাবো কিনা। প্যারাগুয়ায়েতে প্রতি হেক্টর জমির দাম ২০০ ডলারের মতো। অর্থাৎ প্রতি একর জমির দাম মাত্র বাংলাদেশী টাকার ৬,০০০ টাকার মতো। ম্যানপাওয়ারও অনেক চিপ- ২০০ ডলার স্যালারী দিলে মাথা মোটা ঠান্ডা মনের কর্মঠ স্পেনিশগুলোকে পুরো মাস দিন-রাত খাটানো যায়। যেখানে আমেরিকার উচ্চ বেতনের কারণে ম্যানপাওয়ারের কথা ভাবাও সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে!

হয়তো সে কারণেও ল্যাটিনের দেশ, পরিবেশ ও সেখানকার মিষ্টিজো ও ইন্ডিজিনিওস পিপলস বা আদিবাসীদের নিয়ে স্ট্যাডী করে চলছি। দেশগুলোতে আদিবাসীদের কোনই পাত্তা নেই- ক্ষমতা ও অর্থ সবই সাদা ও মিষ্টিজোদের হাতে। এবং এরা ধনী। আদীবাসীরা বলতে গেলে এখনও আদিম জীবন যাপন করে বা দারিদ্রসীমার অনেক নীচে এদের জীবন-মান।

বাংলাদেশে যেমন সরকারী ছত্র-ছায়ায় আওয়ামীরা দেশের ক্ষমতা ও অর্থের একছত্র মালিকানা পেয়ে গেছে; অনেকটা ঠিক তেমনই। কিন্তু বাংলাদেশের যেমন আওয়ামীরা অভদ্র, বেকুব, মুর্খ, মোসাহেবীতে অভ্যস্ত এবং নিম্ন রুচি ও চরিত্রের মানুষ ঠিক তার বিপরীতে লাটিনের হোয়াইট ও মিষ্টিজো বিত্ত ও ক্ষমতাবানরা অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত, ভদ্র, চতুর, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ভদ্রলোক।

আর বাংলাদেশ থেকে প্রকৃতির অমোধ নিয়মে আওয়ামীদের তাড়ানো গেলেও যারা ক্ষমতাবান হয়ে আসবে তারা যে আওয়ামীদের চেয়ে খুব একটা ভালো হবে না – সেটা আমি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারে। অন্ততপক্ষে আওয়ামীরা সে বীজ দেশের মাটিতে খুব সফলভাবেই বুনে দিয়ে গেছে যা যাচ্ছে; ধ্বংস করে দিয়েছে দেশের মেরুদন্ড নামের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও। সরকারী পৃষ্টপোষকতায় নীতি বা নৈতিকতাবোধ অলরেডী বিদেয় নিয়েছে বাংলাদেশ থেকে।

এবার মুল কথায় ফিরি।

একটু আগেই তো বললাম যে, ল্যাটিন আমেরিকার চিলি, মেক্সিকো ও ব্রাজিল-আর্জেন্টনা ছাড়া কোন দেশেরই গড় বার্ষিক আয় ৬ হাজার ডলারের খুব একটা উপরে নয়। কোন কোন দেশের আয় ২ হাজার ডলারের মধ্যেও।

তাই আমার ধারণা ছিলো, ওরাও গরীব বাংলাদেশও গরীব। তাহলে তো, যেহেতু ’সমানে-সমান’ সেহেতু বাংলাদেশীদের ওসব দেশের ভিসা পাওয়া সহজতর হবে; বা হওয়া উচিত।

সেই ভেবে, কয়েকটা দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে তাদের দেশের কিছু পলিসি নিয়ে একটু যোগাযোগ করি। প্রধান সমস্যা হচ্ছে ওরা ইংলিশ বলতে গেলে জানেই না। আমি গুগল ট্রান্সলেটর এর সাহায্য নিয়ে স্পেনিশে ইমেইল করি।

প্রায় সবগুলো দেশের মন্ত্রণালয় থেকেই ভালো রেসপন্স পাই। কিন্তু যে বিষয়টাতে আটকে যাই সেটা হচ্ছে ওরা ’বাংলাদেশ’ নামক দেশগুলোকে খুব ভয় পায়। নাম শুনলেই কেন যেন একটু পিছিয়ে চলে যায়।

অবশেষে প্যারাগুয়ায়ের একজন এটর্নীর সংগে গেল হপ্তায় কথা বললাম সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে। সেখানে SUACE নামে একটা অতি চমৎকার ইমিগ্রেশন প্রোগ্রাম রয়েছে যেটাতে পৃথিবীর সকল দেশের মানুষই আবেদন করার যোগ্য- বাংলাদেশও যোগ্য বলেই সব স্ট্যাডীতে পেয়েছিলাম। কিন্তু প্যারাগুয়ায়েন হোয়াইট এটর্নী (ভদ্রমহিলা) সেদিন আমার ভুল ভেংগে দিলেন। তিনি বললেন, ’You are a Bangladesh citizen, you cannot apply for the Paraguayan permanent residence permit through SUACE. This is because our immigration office has a list of citizenships that are considered “sensitive” and have to undergo through a particular screening process to obtain the residence permit. Therefore, some benefits are restricted, like applying to the permanent residence through SUACE.’

যাই হোক, যে কথাটি আমি বার বার, বার বার করে বলে আসছি, কি হবে ধনী হয়ে, কি হবে আড়াই হাজার ডলার বার্ষিক আয় করে লম্ফজম্ফ দেখিয়ে যদি বাদবাকী বিশ্বের কাছে আমরা ‘সেনসেটিভ’ জাতি হয়ে যাই?

টাকা পরেও কামানো যাবে; চলুন না আগে সভ্য ও ভদ্র হই।

পেরু, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, প্যারাগুয়ে, নিকারাগুয়া, গায়ানার মতো দরিদ্র দেশগুলোও আমাদের ভিসা দেয় না। কি লজ্জা!

   Send article as PDF