হিরো আলমদের বাংলাদেশ

হিরো আলমকে নিয়ে কখনও দু’লাইন লিখতে বসবো সেটা কখনও ভেবে উঠতে পারিনি কোনদিনও। কিন্তু বাস্তবতা, বাংলাদেশ এবং অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে ও সেই সংগে ‘বাংলাদেশ ও হিরো আলম’ নিয়ে কিছু না লিখে স্বস্তি পাচ্ছি না।
 
শুনছি হিরো আলম নাকি কিসব নাচানাচি আর গানের ভিডিও তৈরী করে- যদিও দেখা হয়নি তার একটিও (রূচিতে আসেনি)। হিরো আলমের তৈরী ভিডিও আমার রূচিতে আসেনি এটা যেমন নির্জলা সত্য ঠিক অনুরূপভাবেই বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালে নির্মিত (হূমায়ুন আহমেদ মারা যাবার পর) কোন টিভি নাটক, সিনেমা দেখার মতো রূচিও আমার নেই। কাজেই হিরো আলমকে আলাদা করে দেখারও সুযোগ কম- হিরো আলমের কথানুযায়ী সে যদি একটু লম্বা ও ফর্সা এবং পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে হতো- তাহলে তাকে আলাদা করাই তো সম্ভব হতো না।
 
আরোও একটা লাইন যোগ করা এখানে অপ্রাসংগিক হবে না যে, বাংলাদেশী শিল্পীরা প্রায়ই অভিযোগ করে যে ভারতীয় বিশেষ করে কোলকাতায় বাংলাদেশী প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলি দেখানো হয় না যদিও ভারতীয় চ্যানেলগুলি বাংলাদেশে দেদারসে চলছে!
 
অভিযোগ গুড়তর।
কিন্তু বাস্তবতা কি বলে?
 
মীর আবছার আলীর তৈরী ‘মীরাক্কেল’ বা জি বাংলার সারেগামা অথবা সেখানকার নাটকগুলি দেখে না বাংলাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। বলতে পারবেন বাংলাদেশের কোন মানুষটা ‘এতটা’ আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশী কোন টিভি চ্যানেলের কোন নাটক বা প্রোগামটি দেখেন?
 
না। কোন নাটক বা প্রোগ্রামের নামই বলা সম্ভব নয় যেটা জনপ্রিয়তার মাত্রায় উঠতে পেরেছে।
বলছি কি, তাহলে ভারতে যদি বাংলাদেশী টিভি প্রচার করা হয়-ই, তাহলে দাদারা বাংলাটিভির ঠিক কোন অনুষ্ঠানটি দেখবে একটু বলুন তো দেখি?
 
দাদারা কি বাংলাদেশের ‘টক-শো’ দেখবে টিভি খুলে (তাও যেখানে বিরোধী মতকে সুযোগও দেয়া হয় না) না কি শেখ হাসিনার সাংবাদিক সম্মেলনে তোষামোদী নাটক দেখবে বসে বসে?
 
হিরো আলম তো যোগ্য নয়, তাহলে যোগ্যতম ব্যক্তিটি কে- একটু বলুন তো?
 
জনপ্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি।
ক্রিকেটের বাইরে তার জ্ঞান এবং দেশীয় রাজনীতিতে তার সম্পৃক্ততা কতটুকু? শুধুমাত্র ক্রিকেটে জনপ্রিয় এজন্য সে জাতীয় সংসদে বসবে ‘আইন প্রণয়ন’ করার জন্য?
 
টিভি নায়িকা তারানা হালিমকে আমরা দেখেছি মন্ত্রী বানানো হয়েছে।
সেই মন্ত্রী তারানা হালিমকে বলতে শুনেছি ‘যার পাসপোর্ট নেই সে বাংলাদেশী নাগরিক না’।
 
এতটা মূর্খতা নিয়ে কিভাবে একজন মন্ত্রণালয় পরিচালনা করে- সেটাই তো আমি ভাবতে পারি না।
 
জাতীয় সংসদে কিছু মহিলা সংসদ সদস্যকে বক্তৃতা দিতে দেখেছি, ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
 
একজন মহিলাকে দেখেছি, লেখা দেখে দেখেও ভুল বানানে (ক্লাস টু’র বাচ্চাদের মতো) ভাংগা ভাংগা উচ্চারণে বক্তব্য দিতে। আরও একজন মহিলাকে দেখেছি উচ্চগলায় বক্তব্য দিচ্ছে, ‘দেশে নির্বাচন উঠিয়ে দেয়া হোক- শেখ হাসিনা সারাজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
 
আমরা সংগীত শিল্পী মমতাজকে দেখেছি সংসদ সদস্য হিসাবে জাতীয় সংসদে!
 
এরা যদি সংসদ সদস্য হবার যোগ্য হতে পারে- তাহলে হিরো আলমের কি দোষ- চেহারা খারাপ? শুদ্ধ ভা্ষায় কথা বলতে পারে না? খাটো বেঁটে? অরূচিকর ভিডিও গান বানায়? আর বাদবাকীরা কি খুবই সুশ্রী? খুবই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে? উঁচু-লম্বা? ‘খায়রুন লো তোর লম্বা মাথায় চুল’ কি খুবই উন্নত সংগীত? রবীন্দ্র সংগীত পর্যায়ে?
 
একটু ভালো করে চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে দেখুন- পরিস্কার দেখতে পাবেন শেরে বাংলা নগরে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ৩৫০জন হিরো আলম বসে বসে হাতে তালি দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত!
 
আচ্ছা বলুন তো একজন ‘সংসদ সদস্য’র কাজ কি?
বাংলাদেশের কেউ একজন সংসদ সদস্য’র কাজ কি সেটা জানে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
 
একজন ‘সংসদ সদস্য’ হবেন ‘আইন প্রণয়নকারী’।
দেশটা কিভাবে চলবে, কোন নীতিতে, কোন আইনে, দেশে কিভাবে কি হবে, কার কি ক্ষমতা, কার কি দায়িত্ব ইত্যাদি।
 
কিন্তু বাংলাদেশ কি বলে?
প্রথম কথাই বলে দেয়া হয়েছে ‘সংসদ সদস্য’ যে দল থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি সেই দল যা চাবে ‘তাকে’ শুধু সেটাই চাইতে হবে। অর্থাৎ শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ চাচ্ছে ‘তত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হবে’ এবং তার দলের সকলকে বাধ্যতামূলকভাবে এই প্রস্তাবে হ্যাঁ বলতে হবে। যদি কেউ না বলে তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ-ই বাতিল।
 
এবার নিন আইন তৈরী করেন তো দেখি কোন সংসদ সদস্য পারে?
ওখানে ৩৫০ জন গরুও যদি বসিয়ে দেয়া হয়- তারাও দরকার মতো ‘হাম্বা’ বলতে পারবে- মানুষ বসানোর দরকারটা কি তাহলে?
 
সুতরাং সেখানে হিরো আলম বসলেই কি আর হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বা বি চৌধুরীর ‘পাতায়া-ফেরত পুত্র’ মাহি বসলেই বা সমস্যা কোথায়? বলতে হবে তো শুধুমাত্র ‘হাম্বা’!
 
বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার নামে তৈরী করে রাখা হয়েছে একটি চরম স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। যেখানে সংসদ সদস্যরা একটা গরু বা কলাগাছ কিছু একটা হলেই হবে!
 
এবার আসেন দ্বিতীয় বক্তব্যে।
একজন এমপি বা সংসদ সদস্য শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন করবেন।
 
কিন্তু বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে সেটা হলো এমপি সাহেব হলেন তার এলাকার প্রেসিডেন্টসম। এলাকায় খবরদারী, এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা, এলাকার লোকল পলিটিক্স নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সবকিছুই তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে বা করানো হয়। কিন্তু কথা ছিল তিনি জাতীয় সংসদে বসে দেশের আইন প্রণয়ন করবেন।
 
তিনিই যদি সবকিছু করেন- তাহলে স্থানীয় জেলা প্রশাসন, নির্বাচিত উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদের কাজ কি?
 
এগুলি নিয়ে বাংলাদেশ ভাবে না, জানে না।
সবাই জানে ক্ষমতা হাতে পেতে হবে। যার হাতে ক্ষমতা সেই-ই সবকিছু, সে-ই টাকা তৈরীর মেশিন।
 
সুতরাং যেনতেনভাবেই হোক আমাকে ‘এমপি’ হতে হবে।
 
এটাই যখন দেশের অবস্থা, তখন সেই দেশে মাশরাফি এমপি হলেই কি ক্ষতি আর হিরো আলম এমপি হলেই বা কি লাভ?
 
আর তাইতো আজ নায়ক-নায়িক, গায়ক-গায়িকা, ব্যবসায়-শিল্পপতি, ইয়াবা ব্যবসায়ী, পুলিশ, সেনা বাহিনী সবাই এমপি হতে ব্যস্ত। সবই কিনছে নমিনেশন।
 
আপনি-ই বা বাদ থাকবেন কেন?
   Send article as PDF