অগোছালো

সার্জারী হলো মাস খানেকেরও উর্দ্ধে।
সুস্থ্য-ই হয়ে উঠেছি; কিন্তু গতকাল সকালে হঠাৎ করেই নাভীর ঠিক উপরটাতে ব্যাথা শুরু হলো। অফিসে গেলাম, রাতে ফিরেও এলাম। ঘুমুতেও গেলাম সেই সহনীয় ব্যাথা নিয়েই কিন্তু ঘুম যখন শেষ হলো- দেখলাম কোন ব্যাথা নেই।
 
ডাক্তার ভেন্সিস সাধারণত মঙ্গলবার দু’টার পর সেন্ট বার্ণাবাস হসপিটালে আউটডোর রোগীদের সময় দেন।
আমি জানি আজ ওনাকে পাবো না। অবশ্য একটা ফোন করলে সে আমাকে পার্সোনালী সময় দেবে সেটা সে আমাকে বলেও রেখেছে।
 
কিন্তু তাকে ফোন করতে ইচ্ছে করছে না।
জানি না যে ঠিক কি কারণে যেন- ডাক্তার ভেন্সিস আমাকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেন; রোগীর চেয়েও বেশী- বিষয়টা আমি ওনার ব্যবহারে বুঝতে পারি।
 
আমি ফোন দিলে ওনি খুশীই হবেন।
কিন্তু দিলাম না।
 
অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম।
ক্যাসেল হিল এভিনিউ থেকে সাবওয়েতে সিক্স ট্রেনে উঠি। আমার বাসার সামনেই বিএক্স২২ বাস ষ্টপেজ- এই বাসটা ফোর্ডহ্যাম পর্যন্ত যায়, হসপিটালের ঠিক কাছেই (ওটা পাড় হয়েই ক্যাসেল হিল সাবওয়ে ষ্টেশন)।
 
বাস ষ্টপেজ এর ঠিক কাছে পৌছার পর আমাকে দেখে ড্রাইভার বিএক্স২২’র আর্টিকুলেটেড বাসটি থামালেন; উনি হয়তো ভেবেছেন- আমি ওনার প্যাসেঞ্জার।
 
আমি মজা পেলাম।
বাসে উঠে বসলাম। চিন্তা করলাম হসপিটাল হয়েই যাই। যদিও ডাক্তার ভেন্সিস এর সংগে দেখা হবার কোন চান্সই নেই- তবুও।
 
আসলে এই বাসটি ব্রঙ্কস বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানার ভেতরে দিয়ে যায়- এলাকাটা খুবই নয়নাভিরাম। এবং বোনাস হিসাবে অনেক চমৎকার মানুষদের সংগ উপভোগ করা যায়।
 
আমি আসলে এমনই!
মাঝে মধ্যে এরকম পাগলামী আমার চরিত্রের একটা বৈশিষ্ঠ্য।
ভাল লাগে। আসলে ভাল লাগাটাই জীবনের সবকিছু।
 
একটা চান্স নিলাম।
যদিই ডাক্তার ভিন্সেসকে পাওয়া যায়?
 
না। নেই। রিসিপ্টশন থেকে বলে দিল আগামীকাল আসতে। এটাতো আমি জানতাম-ই। ফোন করলেই ওনি আমাকে ওনার চেম্বারে ডাকবেন। কিন্তু ফোন করলাম না। কালই দেখা করবো।
 
হসপিটাল থেকে বের হয়ে মিনিট ১৬ হাঁটলেই ফোর্ডহ্যাম ডি ট্রেন সাবওয়ে স্টপেজ।
 
হাঁটা শুরু করলাম। ঠিক তখনই হাঁটতে হাঁটতে মাথায় একটা লেখা চলে আসলো। লেখাটা সারাদিন মাথায় খুব ঝামেলা করে যাচ্ছে।
 
লিখি তাহলে।
কি বলেন?
 
আমার দু’টি ভাগিনা। গল্পটা আগেও করেছি।
একটার নাম হোয়াইট অন্যটার ব্লাক। আসলে হোয়াইটটার নাম হলো টিটু- ও ছিল বেশ ফর্সা, সে এখন ঢাকার এডভোকেট। আর ব্লাকটা, মানে মিঠু প্যারিসে একটা ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট কিনে সেটাই এখন চালাচ্ছে- এটা ঠিক আফ্রিকানদের মতোই কালো।
 
এই দুইটা ভাগিনা আমার ছোট বেলার সার্বক্ষনিক সংগী।
অন্য বাংলায় সাগরেদ।
 
দুইটাই ভয়াবহ শয়তান। আমি খুবই পছন্দ করতাম দু’টোকে। চমৎকার বুদ্ধি রাখে ওরা। আর এটাও বুঝতাম ওরাও আমার জন্য পাগল।
 
ব্লাক আর হোয়াইট ছিল মানিক-জোড়া।
সারাদিন একসংগে ঝগড়া-জাটি-আনন্দ সব কিছু!
 
আমাদের বাড়ীর সামনেই ছোট একটা নদী।
কোন এক দুপুরে আমি আর এই দুই ভাগিনা মিলে নদীতে গেলাম গোসল করতে।
পানিতে নেমেই ব্লাক আর হোয়াইট দুষ্টমী থেকে লাগিয়ে দিল মারামারি।
 
বড়টা হোয়াইট, ওর শক্তি বেশী।
আর ছোটটা- মানে ব্লাক, ওটার বুদ্ধি বেশী।
 
বড়টা শক্তির প্রয়োগ আর ছোটটা মস্তিষ্ক প্রসূত খোঁচা; লেগে গেল যুদ্ধ।
হোয়াইটটা যখন বেশী মারমুখী- ব্লাকটা নদী সাঁতরে চলে গেল ঐ পাড়ে; ওপাড়ে গিয়ে সে বড় ভাইকে আরও অপমানসূচক তীর্যক বাক্য ছুড়তে শুরু করলো।
 
হোয়াইট এক পর্যায়ে বলল, ‘তুই এপারে আসবি না, বাড়ী আসবি না- তখন দেখাবো তোকে’।
ব্লাকটার তাৎক্ষনাৎ ভেরী স্মার্ট এনসার, ‘আসবো না মানে- আমি কি সাড়া জীবন এপাড়েই থাকবো না কি?’
 
সেদিনের ব্লাকের এই উত্তরটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। আজ থেকে ৩০ বছর আগের সেই কথা কি তাহলে হুবুহু বলে দিতে পারতাম?
 
আচ্ছা। অন্য কথা বলি।
বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটা বিষয় খুব বেশী লক্ষ্য করা যায়।
 
দেখবেন ৫/৭ জন ছেলে মেয়ে এক সংগে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ কোন একজন-কে ফোন দিল, ‘কি করিস? কার সংগে?’ ইত্যাদি প্রশ্ন।
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরগুলি হয়ে থাকে, ‘এইতো বয়ফ্রেন্ডদের (বা গার্লফ্রেন্ডদের) সংগে গল্প করছি/ আড্ডা দিচ্ছি’ ইত্যাদি।
 
বা একটা ছেলে ও মেয়ে ভার্সিটি বা কলেজের সহপাঠি/ সহপাঠিনী- একে অপরের সংগে পরিচয় করিয়ে দিতে কোনই দ্বিধাবোধ করে না যে, ‘ও আমার বয় ফ্রেন্ড/ গার্ল ফ্রেন্ড’।
 
আমাদের দেশে ‘ছেলে বন্ধু’ বা ‘মেয়ে বন্ধু’ বিষয়টাকে যেভাবে আমরা চিন্তা করি- বাস্তবে ‘বয় ফ্রেন্ড’ বা ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ কিন্তু একই রকম অর্থ বহন করে না।
 
আসল অর্থটা হলো ‘বয় ফ্রেন্ড’ বা ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ মানেটা হবে ‘তারা পারষ্পারিক কমিটেড বা স্বীকৃত কাপল’। আরও সহজে বললে- অর্থটা ‘স্বামী-স্ত্রী’- বাট বিয়েটা হয়নি এখনও; কিংম্বা ‘লিভ টুগেদার’ করছে।
 
অর্থাৎ ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ বা ‘বয় ফ্রেন্ড’ এর প্রকৃত অর্থ কোন অবস্থাতেই স্রেফ ‘ছেলে বন্ধু’ বা মেয়ে বন্ধু’ হতে পারে না বা হয় না। বিষয়টা অনেক গভীর।
 
বয় ফ্রেন্ড বা গার্ল ফ্রেন্ড বহুবচন হয় না, হতে পারে না।
 
পশ্চিমের ছেলে-মেয়েদের ‘এক জন’ এর বেশী বয় বা গার্ল ফ্রেন্ড থাকে না; থাকতে পারে না। অপছন্দ হলে বা ব্রেকআপ হলে তারপরই তারা অন্যজন কে সংগী করে। এক সংগে দু’জনকে নয়। এটা অসভ্যতা।
 
বাংলাদেশ থেকে যারা ভেবে বসে থাকে- আমেরিকা ইওরোপের ছেলে-মেয়েরা ‘ফ্রিসেক্স’ করে- তারা যে কতটা বোকাদের সর্গে বসবাস করছে সেটা তারা কিন্তু নিজেরাও জানে না।
 
তো, এরকমই আমার একটা ভাল বান্ধবী; অনেক গল্প করতাম। দুষ্টমীও করতাম।
একদিন সে একটু বেশী বাড়াবাড়ি বা আমাকে খোঁচা দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে।
 
আমি ওকে মজা করে বললাম, ‘তোমাকে ডিম থেরাফী দেয়া উচিৎ’।
মেয়েটা হেসে দিল। বলল, ‘কোন ব্যাপারই না। ডিম থেরাফী দিলে কি হয়?’
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, ‘কি হয় মানে? বুঝ না? একটা ডিম … কিভাবে সম্ভব?’
মেয়েটা অাবারও হেসে দিয়ে বলল, ‘এত ছোট একটা মুরগী যদি এত বড় একটা ডিম পারতে পারে- আর এত বড় একজন মানুষ সামান্য একটা ডিম নিতে পারবে না! এটা কোন শাস্তি হলো? সামান্য একটা বিষয়!’
 
আমি বিভ্রান্ত হলাম।
আরি! ভেবে দেখিনি তো বিষয়টা! সত্যিই তো। জীবনে মনে হয় প্রথমবার তর্কে পরাজিত হলাম।
 
যাই হোক।
বাংলাদেশের মানুষ দু’টি কাজ খুব ভালো ভাবে করতে পারে।
১) উপদেশ দেয়া।
২) তর্কে লিপ্ত হওয়া।
 
কাউকে উপদেশ দেয়াটা আমার বরাবরই অপছন্দ।
আমি কখনওই কাউকে উপদেশ দিই না। ‘টু দা পয়েন্ট’ এ কথা বলে যুক্তি দিই- যুক্তি মানলে মানলো- না মানলে নেই।
 
অনেকে অবশ্য প্রায়ই আমার কাছে উপদেশ চায়।
কিন্তু আমি উপদেশ দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি না।
 
কেন করি না?
আমার দেয়া উপদেশ যদি আপনি না-ই বা মানেন; তাহলে শুধু শুধু উপদেশ দিয়ে নিজের কাছে নিজে ছোট হবার কোন মানে হয়?
 
কাজেই বুদ্ধিটা হলো- কেউ উপদেশ চাইলে তাকে ঘোরাবেন; ভাবনা-চিন্তার জন্য সময় নিবেন- যদি দেখেন সে সত্যিই আপনার উপদেশ এর জন্যই অপেক্ষায় রয়েছে- তবেই তাকে উপদেশটি দিবেন। এতে তার উপকার হবে। আপনিও প্রশান্তি পাবেন।
 
সরি; আমি মনে হয় উপদেশ-ই দিয়ে ফেললাম!
 
এবং।
তর্ক করবেন না।
আমার কাছে কেউ সার্বক্ষনিক উপদেশ নেবার জন্য ঘোরাঘুরি করলে আমি একমাত্র যে উপদেশটা দিই- সেটা হলো ‘জীবনে কোনদিন তর্ক করবেন না, কারো সংগে তর্কে লিপ্ত হবেন না’।
 
আসলে তর্ক না করার অনেক সুবিধা।
আপনার সামনে যদি কেউ ভুল যুক্তি দেয়, ভুল বা অন্যায় কথাও বলে, ভুল তথ্য উপস্থাপনও করে- আপনি চুপ করে থাকুন। সে বেশী কথা বলছে বলে মনে হলেও আপনি চুপ থাকুন। তবুও তর্ক করবেন না।
 
একটা সময় আবিষ্কার করবেন- এসব লোকেরাই কোন একদিন অাপনাকেই ডাকছে- তাদের নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি তর্কটির সমাধান করে দিতে।
 
এটাই কি বেশী আনন্দের নয়?
   Send article as PDF