চলুন তাহলে আমেরিকা

শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, বলতে গেলে পুরো পৃথিবীর প্রায় সকলেরই অনেকটা একই রকমের কৌতুহল, কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় আমেরিকায় আসা যায় বা গ্রীনকার্ড পাওয়া যেতে পারে।

খুবই জটিল একটা প্রশ্ন যার এক কথায় উত্তর দেয়াটা বলতে গেলে অসম্ভব। এবং সবচে সঠিক সত্যটি হচ্ছে ‘আমেরিকায় বৈধভাবে গ্রীনকার্ড নিয়ে আসাটা যদিও অসম্ভব নয় কিন্তু খুবই ‘দুরহ’ একটি কাজ। একটু বিস্তারিত বললে হয়তো বুঝতে সুবিধে হবে।

ইন্ডিয়া বা ইওরোপ-অষ্ট্রেলিয়ার একটা টুরিষ্ট ভিসা যেমন কিছু বেসিক ডকিউমেন্টস দিতে পারলেই হয়ে যায়- আমেরিকার বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টো, এরা কোন ডকিউমেন্ট দেখে ভিসা দেয় না; স্রেফ ওরাল কিছু কথপোকথনে ওরা বুঝে নেয় আগ্রহী ভিসা-প্রার্থী আমেরিকার ভিসা পাবার যোগ্য কি না! ব্যস হয়ে গেল। কোন পেপারস এর প্রয়োজনই নেই বলতে গেলে; শতকরা হারে ১% এদিকওদিক হয় হয়তোবা।

যাই হোক, সে কথায় পরে আসছি- আমি একটু বিস্তারিত উত্তর দেবার চেষ্টা করবো।

আমেরিকা ‘ডাইভারসিটি লটারী’ প্রোগ্রাম এর আওতায় প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে ৫৫ হাজার লোককে নির্বাচিত করে সরাসরি গ্রীনকার্ড প্রদান করে- আমেরিকা যাবার সুযোগ করে দেয়। এতে শুধুমাত্র ১২ বছর পড়াশোনা করার সার্টিফিকেট থাকলেই যে-কেউ লটারীতে বিজয়ী হওয়া সাপেক্ষে আমেরিকা যেতে পারে।

তবে, আমেরিকায় যে-সব দেশের জনসংখ্যার সংখ্যা তুলনামুলকভাবে বেশী সেসব দেশকে লটারী থেকে বাদ দেয়া হয় বিধায় জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশ ঐ লটারীতে অংশগ্রহন করতে পারছে না। আমেরিকায় ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশীদের সংখ্যা বেড়ে গেছে এবং কয়েক বছর যাবৎ গণহারে নেপালীরা ডিভি লটারী জিতে আমেরিকায় আসা শুরু করেছে।

আমেরিকায় যারা গ্রীনকার্ড হোল্ডার – তারা তাদের স্ত্রী-সন্তানকেও সংগে নিয়ে যেতে পারে। আর সিটিজেন হবার পর পিতা-মাতা, এমনকি ভাই-বোনের পরিবার ও তাদের অবিবাহিত (অনুর্ধ ২১) সন্তানদেরও গ্রীনকার্ড করিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াটিতে বর্তমানে আবেদন করার পর প্রায় ১৪-বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।

আমেরিকায় যত সংখ্যক বাংলাদেশী বর্তমানে বসবাস করছে তার মধ্যে বলতে গেলে ৯০% লোকই ডিভি লটারী অথবা তাদের মাধ্যমে চেইন মাইগ্রেশন এর সুযোগে গ্রীনকার্ড পেয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আমেরিকায় আসতে কোন যোগ্যতা থাকার প্রয়োজন হয় না। আত্মীয়তার বন্ধনেই আমেরিকায় গ্রীনকার্ড নিয়ে চলে আসা যায়।

এবার চলুন কিভাবে যোগ্যতা দিয়ে আমেরিকার ভিসা পাওয়া সম্ভব সেটা আলোচনা করি।

কমপক্ষে এইচএসসি পাশ, ইংলিশে কথা বলায় দক্ষ এবং নিজ পরিবারের যে-কারো নামে বিগত ছয় মাসেরও বেশী সময় ব্যাংক ন্যূনতম ৪০ লাখ টাকা জমা রয়েছে (এফডিআর হলেও চলবে) তারা আমেরিকার কোন একটা ইউনিভার্সিটি (ষ্টেট ইউনির্ভাসিটি হলে ভালো হয়) থেকে আই-টুয়েন্টি নিয়ে ষ্টুডেন্ট ভিসার জন্য ইন্টারভিও দিতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিসা হয়ে যায়।

আমেরিকার ভিসার সংগে ‘কপাল’ এরও একটা সম্পর্ক রয়েছে- কপালে থাকলে ভিসা পেয়ে যাবেন; ষ্টুডেন্ট ভিসাটাই সবচে সহজ। ৫,৩০০ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশ আমেরিকায় পড়াশোনার জন্য বিশ্বে সবচে ভালো স্থান বলেই পরিগণিত হয়।

যাদের টাকা নেই কিন্তু ষ্টুডেন্ট হিসাবে খুবই ভালো এবং ইংলিশেও স্মার্ট- তারা ১০০% স্কলারশীপের জন্য ইউনির্ভাসিটিগুলিতে ট্রাই করতে পারেন- পেয়ে গেলে ব্যাংকে টাকা ছাড়াই ভিসা হয়ে যাবে এক চান্সে।

আমেরিকাতে সারা বছরই বিভিন্ন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স’ লেগেই থাকে; অবশ্য এদেশের সবকিছুই ইন্টারন্যাশনাল। অনলাইনে খোঁজ করে কোন একটা কনফারেন্সে অংশগ্রহনের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করে ফেলুন। ওরা ইনভাইটেশন লেটার পাঠিয়ে দিবে আপনার ঠিকানায় সংগে ইউএস এম্বাসীতেও। লাইনে দাঁড়িয়ে যান ইন্টারভিউ এর জন্য- দেখেন কপালে থাকতেও পারে; হয়তো লেগেও যাবে।

আরও একটা চমৎকার বুদ্ধি রয়েছে।
আপনি বাংলাদেশী কিন্তু বসবাস করছেন ভিন্ন একটা দেশে যেমন চায়না, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, আরব আমিরাত কিংম্বা সাউথ আফ্রিকাসহ যে-কোন দেশে। রয়েছে রেসিডেন্ট ভিসা। আপনি ষ্টুডেন্ট বা চাকুরী অথবা ব্যবসা করছেন ওখানে। খুবই ভালো- ওসব দেশে অবস্থিত আমেরিকান এম্বাসীতে গিয়ে টুরিষ্ট ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যান- ভিসা পাবার সম্ভাবনা খুবই বেশী। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য এম্বাসী আবেদনকারীর ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও বৈধ কাগজপত্রদিও দেখে থাকে।

এবার চলুন টুরিষ্ট ভিসা নিয়ে একটু আলোচনা করি।
আপনি মোটামুটি ৫/৬টা দেশ ভ্রমণ করেছেন স্বপরিবারে। এই ধরুন ইন্ডিয়া, চায়না, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, সৌদী আরব ইত্যাদি। আপনার ছেলে-মেয়ে ঢাকার ভালো কোন স্কুলে পড়ে- তুখোড় ইংলিশ বলে। দাঁড়িয়ে যান স্বপরিবারে। আপনার বাচ্চাকে ইংলিশে কয়েকটা প্রশ্ন করবে- ব্যস; হয়ে গেল। অথবা আপনাকে বা আপনার স্ত্রীকে কিছু প্রশ্ন করে বাংলাদেশে আপনার ‘সোসাল স্ট্যাটাস’ ওরা বুঝে নিবে। উপযুক্ত মনে করলে ভিসা পেয়ে যাবেন অনায়াসেই- কোন ডকিউমেন্টই ওরা দেখবে না। না ব্যাংক ব্যালেন্স, না বাড়ী গাড়ীর কাগজপত্র। ওরা মুখের কথায়ই বুঝে ফেলবে ‘এসব’ আপনার রয়েছে কি না!

এসবের বাইরে আমেরিকার ভিসা পাবার আর কোন বুদ্ধি নেই।
তবে আপনি যদি হয়ে থাকেন একজন ‘সেলিব্রেটি’ (ফেসবুক সেলিব্রেটি না কিন্তু); বাস্তব জীবনে আপনি আপনার ক্ষেত্রে একজন সফল ব্যক্তি। দেশের সবাই আপনাকে এক নামে চেনে- তাহলে তো কথাই নেই! মাত্র ৩ মাসের মধ্যে ঢাকায় বসেই আপনি পেয়ে যাবেন আমেরিকান গ্রীনকার্ড একজন ‘এক্সট্রা অর্ডিনারী’ পার্সোনালিটি হিসাবে।

আরও একটা বুদ্ধিও আছে- আপনি যদি হয়ে থাকেন হাসিনার কাছের মানুষ অথবা কোন বড় ব্যবসায়ী নেতা; এফবিসিসিআই এর অন্তত জেনারেল বডি মেম্বার, তাহলেও প্রতিবছর হাসিনা যে পংগপাল নিয়ে জাতিসংঘে ভাষন দিতে আসে, সেই দলের একজনও হয়ে যেতে পারেন অনায়াসেই।

আরও ৩-টি অপশন রয়েছে।
আপনার কাছে যদি কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা থেকে থাকে- সেক্ষেত্রেও আমেরিকায় ৫-বছরের জন্য ‘রিজিউনাল সেন্টার’এর মাধ্যমে বিনিয়োগ করে পেয়ে যেতে পারেন পুরো পরিবারসহ গ্রীনকার্ড। অবশ্য এক্ষেত্রে প্রসেসিং-এ প্রায় ২ বছর সময় লেগে যায়।

এছাড়া কমবেশী ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার শর্তে পেতে পারেন ই-টু ভিসা; তবে এক্ষেত্রে খুবই অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী না হলে পুরো টাকাটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে কারণ ই-টু ভিসা দু’বছর পরপর রিনিউ করা হয় এবং আপনাকে বিদেশী হিসাবে ট্যাক্স পেমেন্ট করে আমেরিকায় বসবাস করতে হবে; এবং ই-টু ভিসা থেকে কখনওই গ্রীনকার্ড পাওয়া যাবে না। আর ১ কোটি টাকাকে যখন ডলারে ৮৫ দিয়ে ভাগ করবেন তখন ঐ টাকাটা এদেশের মানে খুবই সস্তা হয়ে যাবে।

তবে, এবং আপনি যদি দুর্ধর্ষ কোন ব্যবসায়ী হয়ে থাকেন; যদি ঢাকায় ভালো ব্যবসা থেকে থাকে এবং আমেরিকায় ১ বছরের মধ্যে কম করে হলেও এক-দেড় মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করার সামর্থ থেকে থাকে- তাহলে চেষ্টা করতে পারেন এল-ওয়ান ভিসার জন্য। এটা খুবই সহজ শর্তে একটা ভিসা কিন্তু সময় মাত্র ১ বছরের।

সোজা রাস্তা সব বলেই দিলাম।
তবে সবচে সহজ রাস্তাটি এখনও বলিনি। একজন আমেরিকান সিটিজেনকে বিয়ে করে ফেলুন। কোন হিসাব ছাড়াই ৭/৮ মাসের মধ্যে পেয়ে যাবেন গ্রীনকার্ড। ব্যস খেল খতম। তারপর মাত্র ৩ বছরেই আমেরিকান কালো পাসপোর্টও। যদিও অন্য সব ক্ষেত্রে ৫ বছর পর আমেরিকার সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করতে হয়।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আপনার কোনটাই হিসাবে মেলাতে পারলেন না।
অথচ আমেরিকায় যাবেন-ই! তাহলে আপনার জন্য রয়েছে সেই মেক্সিকো দিয়ে আমেরিকা যাবার দু-নম্বরী বুদ্ধি। জীবনের ঝুঁকি প্রতি পদে পদে, বিশাল জংগল, জংলী অঞ্চল, পানামা খালসহ ৭/৮টা দেশ সড়ক পথে পাড়ি দিয়ে লাখ বিশেক টাকা খরচ করে অবশেষে (যদি ইতমধ্যে মারা না গিয়ে থাকেন) আমেরিকা পর্যন্ত হয়তো পৌছতে পারবেন- কিন্তু তারপর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টর ‘আইসিই’ পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কোর্টে কমবেশী ২০ হাজার ডলারে বন্ড দিয়ে হয়তো ছাড়াও পেতে পারবেন। কিন্তু সেই গ্রীনকার্ড পাওয়া সোনার হরিণই হয়ে থাকবে যদি কপালটা খুবই ভালো না হয়ে থাকে! করবেন চেষ্টা? এজন্য আপনাকে সর্বপ্রথম ব্রাজিল বা সাউথ আমেরিকার কোন একটা দেশে আসতে হবে।

শেষটায় আরও একটা দু’নম্বরী বুদ্ধি সংযুক্ত করে দিচ্ছি।

অনেকেই ‘কাগুজে বিয়ে’ করেও আমেরিকায় চলে আসছে গ্রীনকার্ড নিয়ে- এটাও সহজ বুদ্ধি তবে টাকা খরচা হয়ে যায় কম করে হলেও অর্ধ-কোটিরও বেশী!

আর শেষটায় একটি ভালো উপায় বাতলে দিচ্ছি।
এটাকে বলে ‘এমপ্লয়মেন্ট বেইজড গ্রীনকার্ড’; প্রসেসিং করতে ১৮ মাস সময় লাগে। কমবেশী ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার খরচ হয় – স্বপরিবারে গ্রীনকার্ড নিয়ে চলে আসতে পারবেন। এতে আমেরিকার কোনও একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী স্পন্সর করে এবং ২-বছর ষ্টেট মিনিমাম ওয়েজে চাকুরী করা বাধ্যতামূলক। কোন যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না – যে কেউই আসতে পারে।

সে যা-ই হোক, যেভাবেই হোক এখানে আসার পর কাজ-না-জানা বাঙালী রেষ্টুরেন্টে থালা-বাটি ঘসে, গ্রোসারীতে মাছ-মাংস কেটে, ক্লিনিং, লোড-আনলোড, কন্সট্রাকশন এর লেবার এর কাজ করে প্রথম কয়েক বছর সত্যিই খুব কষ্ট ভোগ করে- যদিও দিন বা সপ্তাহ শেষে মোটাসোটা ডলার সব দুঃখই ভুলিয়ে দিতে পারে। এবং ওয়ার্ক পার্মিট পাবার পর আরেক ডিগ্রী উন্নতি হয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার হতে পারলে সপ্তাহে ১৫০০ ডলার আয়ের নিশ্চয়তা পাওয়া সম্ভব যেটা মাস শেষে গিয়ে ঠেকে ৬ হাজার ডলারে- বাংলাদেশের টাকায় গাড়ী চালিয়ে মাসে ৫ লাখ টাকা!

এবং,
সংগে থাকবে নিজেকে মানুষ ভাবার নিশ্চয়তা, একটা মুহূর্তের জন্য কারেন্ট-পানি-গ্যাস যাবে না, স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ, ধূলাবালি-মাস্তান-হরতাল-ধর্মঘটহীন সমাজ ও জীবন, এবং যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে এদেশের মাটিতে জন্ম নেয়া আপনার সন্তানটিও হতে পারবে হয়তো বা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। আমেরিকা বাংলাদেশের হাচিনা-খালেদা পরিবারের মতো কোন পরিবারের হাতে জিম্মি না। এখানে সকলের হাতেই সমান ক্ষমতা।

সত্যি বলতে আমেরিকায় আসার পরই আপনি বুঝতে পারবেন ‘আপনি সত্যিই একজন মানুষ’; আর তখনই আপনি ‘মানুষ এবং অমানুষ’ এর পার্থক্যটুকুও ধরে ফেলবেন আপন বিবেচনাতেই।

ওয়েলকাম টু দ্য ইউনাইটেড ষ্টেটস অফ আমেরিকা।
ওয়েলকাম টু দ্য ল্যান্ড অব অপুর্চুনিটিজ।

   Send article as PDF