বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা নয়

আমি শেখ হাসিনার প্রচন্ড রকমের বিরোধীতা করি কয়েকটি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট কারণে।

১) বাংলাদেশে সামান্য করে হলেও (কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ পরিবেশে) একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো; সেই সামান্য গণতন্ত্রটুকুকেও হত্যা করেছে (তার বাবার একদলীয় বাকশালী স্ট্যাইলে) – শেখ হাসিনা এবং অবৈধ, অনৈতিক এবং সরকারী সন্ত্রাসী লাইসেন্সড বাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা আকড়ে রেখেছে।

২) বিচার-বর্হিভূত এবং রাষ্ট্রিয় হত্যাকান্ডের মাধ্যমে শতশত নিরাপরাধ মানুষকে উদ্দেশমূলকভাবে (বিরোধী মত দমনে) হত্যা করেছে শেখ হাসিনা। হাজার হাজার বিরোধী দলীয় (বিশেষত বিএনপি-জামায়াতের) নেতা-কর্মীকে গুম ও ভয়াবহ রকমের শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে চিরতরে পুংগ করে দিয়ে হাজার হাজার পরিবারকে অসহায় অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে শেখ হাসিনা।

৩) একটা দেশের মেরুদন্ড হলো দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থা। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে গত ১২ বছরে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। পড়াশোনার বিন্দুমাত্র স্ট্যান্ডার্ড নেই। বছর বছর লাখ লাখ ছেলে-মেয়েকে ‘জিপিএ-পাইপ’ বানিয়ে সার্টিফিকেট ধরিয়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে যারা শুধুমাত্র এতটুকুই শিখেছে যে, শেখ মুজিব ছাড়া বাংলাদেশ হতো না। ব্যস, এর বাইরে তারা ১টি লাইনও লেখার যোগ্যতা অর্জন করেনি। বাংলাদেশ এক ভয়াবহ অযোগ্য প্রশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে অযোগ্য-জিপিএপাইপ শিক্ষিত মূর্খদদের দ্বারা দেশটি পরিচালিত হবার অবস্থায় পৌছেছে। এর জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী শেখ হাসিনা।

৪) বাংলাদেশের এডমিনিষ্ট্রেশন, পুলিশ, বিজিবি, এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে- তাদের সামনে টাকার মুলো ধরিয়ে রেখে। এবং এদের তথা সামগ্রিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ অর্পন করা হয়েছে ভারত সরকারের হাতে। ‘বাংলাদেশ’ বলতে এখন শুধুুমাত্র ভুখন্ডটিই রয়েছে কিন্তু কর্তৃত্ব করছে ভারত। এমনটাকেই বলা হয়ে ‘দেশ বিক্রি করা’ – যেটা সম্পূর্ণ করেছে শেখ হাসিনা।

৫) বাংলাদেশটা আজ রাষ্ট্রিয় লুটপাটের এক ভয়ংকর ঠিকানা। প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে ৪-পাঁচ গুন অতিরিক্ত খরচ ধরে ‘প্রজেক্ট বানিয়ে’ বাড়তি টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে পাচার করা এখন যেন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। যতটুকু হিসাব পাওয়া যায় তাতে পরিস্কার বোঝা সম্ভব যে গত ১২ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তার ‘লোকজন’ (MEN) কম করে হলেও ১৫ লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট করেছে এবং বিদেশে পাচার করেছে। কানাডার বেগমপাড়া বা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম, সিংগাপুরের সেরা ধনীর তালিকায় এদের নাম সবার আগে খুঁজে পাওয়া যায়।

৬) বাংলাদেশটির নামকাওয়াস্তে স্বাধীনতা আছে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কোনই স্বাধীনতা নেই। তারা মুক্তভাবে কথা বলতে পারছে না। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করার কথা পুলিশের- যেজন্য তারা জনগণের কষ্টের টাকায় বেতন নেয়, অথচ তারাই আজ দেশের সবচে বড় সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। চাাঁদাবাজী, খুন, ধর্ষন এখন পুলিশের নিয়ন্ত্রণে চলছে। দেশটা আজ সন্ত্রাসী, খুনী, চাাঁদাবাজ ও ধর্ষকদের অভয়রাণ্যে পরিণত করে দিয়েছে শেখ হাসিনা। দেশের বিচারপতি, জাজ, বিচারব্যবস্থা আজ বেশ্যালয়ের সংগে তুলনীয় পর্যায়ে পৌছে দিয়েছে শেখ হাসিনা।

এই ৬টি মারাত্মক হটকারী কারণ যদি একটি কালো মার্কার পেন দিয়ে মুছে দেয়া যেত- তাহলে কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আমরা দেখতে পেতাম আগামী ৫ থেকে ১০ বছর পর বাংলাদেশ সত্যি সত্যি একটি দুর্দান্ত দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। ঢাকা শহরের আমুল পরিবর্তন আমরা দেখতে পাবো- এই শহরেও মেট্রো রেল চলবে, যা ঘন্টায় বহন করবে লাখ লাখ যাত্রী। শহরের চেহারা পরিবর্তন করার জন্য যা যথেষ্ঠ। এছাড়াও বেশ কয়েকটি দূরদর্শি রোড-নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে এই সময়ের মধ্যেই। পদ্মা সেতু, বরিশাল খুলনা পর্যন্ত রেললাইন, চট্রগ্রাম থেকে কক্সেস বাজারের নতুন রেল লাইন যোগাযোগ বিপ্লব এনে দিবে। বেশ কয়েকটি একাধিক লেনের হাইওয়ে দেশের চেহারায় আভিজাত্য এনে দিবে কোনই সন্দেহ নেই। এবং এসবেরও একক কৃতত্ব কিন্তু সেই একই শেখ হাসিনারই।

আরও একটা কাজের জন্য শেখ হাসিনা স্মরনীয় হয়ে থাকবেন সেটা হলো তিনি দেশের অর্থনীতিকে অনেক বড় করে ফেলতে পেরেছেন- যেটা করা উচিত ছিলো আরও ৩০ বছর আগে। ১৯৯০ সালে যেখানে বাংলাদেশের বাজেট ছিলো মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকা তা আজ ৩০ বছরের মধ্যে বেড়ে হতে পেরেছে ৫৬৮ হাজার কোটি টাকা – যা সত্যিই প্রশংসনীয়। এছাড়া বাংলাদেশের ফরেন রিজার্ভ নিঃসন্দেহে আজ ঈর্ষণীয় একটি পর্যায়ে পৌছেছে।

কিন্তু শেখ হাসিনার পাপের পাল্লা এতটাই ভারী যে- তার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডও সম্পূর্ণ ম্লান করে দিয়েছে তাকে।

আপনার যদি স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকারই না থাকে তাহলে বিশাল রোড নেটওয়ার্ক দিয়ে কি করবেন? আপনি যদি স্বাধীনভাবে কথাই বলতে না পারেন তাহলে আপনার রাষ্ট্র ভাষা ঠিক কি কাজে লাগবে? আপনি যদি একজন ব্যক্তি বা পরিবার দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে শোষিতই হতে থাকেন তাহলে তাহলে তো বৃটিশ বা পাকিস্তানীরাই ভালো শাসক ছিলো অন্তত্যপক্ষে তাদের শাসনের তো একটা কোয়ালিটি ছিলো; শক্ত পুলিশ ও নৈতিক বিচার ব্যবস্থা ছিলো- তাহলে স্বাধীনতা দিয়ে কি করবেন? আর বিশাল অর্থনীতির সুবিধাভোগী শুধুই সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ, কিন্তু তারা তো দেশের মাত্র ২০%; বাদবাকী ৮০% লোক কোথায় যাবে কি খাবে কোথায় ঘুমাবে তার কোনই নিশ্চয়তা নেই দেশে।

যাই হোক, যা দিয়ে শুরু করেছিলাম কথা বলা, সেটা হলো আমি ঠিক কি কারণে শেখ হাসিনার বিরোধীতা করি – সুনির্দিষ্ট কারণগুলো বলে দিলাম।

আমি রাজনীতি করি না। আমি বিএনপির সমর্থক নই, বিএনপি’র রাজনীতি পছন্দও করি না। তাছাড়া পরিবারতন্ত্রকে আমি শুধু অপছন্দই করি না, ঘৃণাও করি সমান্তরালভাবে। আমি জামায়াতের সংগেও সংশ্লিষ্ট নই, মেধাবিহীন জামায়াতের রাজনীতিই করা উচিত নয়। তাদের আগে মেধা অর্জনের পথে অগ্রসর হওয়া উচিত- তারপর রাজনীতি। মেধাহীন রাজনীতিকে সমর্থন করার প্রশ্নই আসে না।

তবে, যেহেতু তুলনামুলক বিচারে বেগম জিয়া অতি অবশ্যই শেখ হাসিনার চেয়ে অধিকতর গণতন্ত্রে বিশ্বাসী অর্থাৎ ‘মন্দের ভালো’ হিসাবে এবং বাংলাদেশের মানুষ (আমি বাদে) যেহেতু ‘পরিবারতন্ত্রেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে’ বা বিকল্প কোন নেতৃত্ব নেই বিধায় – বেগম জিয়া-ই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচে জনপ্রিয় নেতা সেহেতু আমার সমর্থনও তাঁর প্রতিই চলে যায়।

আমরা বেগম জিয়ার ১০ বছরের শাসন দেখেছি, তাকে আমি পূর্ণ গণতন্ত্রের পক্ষের ব্যক্তিত্ব হিসাবে রায় দিতে অপারগ। তার শাসন ব্যবস্থাও ভুলে ভরা; এবং উন্নয়নও আহামরি কিছুই ছিলো না। কিন্তু তার চমৎকার ব্যক্তিত্ব এবং নমনীয় শাসন ব্যবস্থাকে আমি সবসময়ই ‘মন্দের ভালো’ হিসাবে চিহ্নিত করি। তিনি উগ্র নন, তিনি অপরকে সম্মান করতে জানেন; যেটা শেখ হাসিনা জানেন না।

কিন্তু আমি যেহেতু অন্ধ নই, সেহেতু বেগম জিয়া বা বিএনপি কিংম্বা জামায়াতের ভুলগুলিও আমার চোখে আটকে যায়, আমি সমালোচনা করি; প্রয়োজনে তীব্র প্রতিবাদ জানাই, কখনও সখনও প্রয়োজন মনে করলে ট্রল করি। এটা আমার অধিকার।

যে অধিকার বলে আমি আওয়ামী লীগের প্রতিটি অন্যায়র প্রতিবাদ করি, সমালোচনা করি ঠিক একই অধিকার বলে আমি বিএনপি এবং জামায়াতেরও সমালোচনা করি। নিন্দা জানাই, ট্রল করি।

আর, আমার যেহেতু কোন রাজনৈতিক অভিলাস নেই সেহেতু আমি কারো লেজুরবৃত্তি করি না, কারো তোষামদীও করি না। তাই কাউকে খুশী করার জন্য লিখি না।

আমার লেখায় যারা আহত হন, তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করারও আমার কোন দায় নেই। আমি বরং খুশী হই আমার ভুল ধরিয়ে দিলে- আমি নিজেকে এবং নিজের লেখাকে সংশোধন করে নিতে প্রস্তত সবসময়।

   Send article as PDF