গণতন্ত্র

বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র অর্থ জানে না।
 
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাঘা বাঘা প্রফেসরবৃন্দও বুঝে না আসলে গণতন্ত্র কি! আর দেশের বুদ্ধিজীবিদের বুদ্ধিতেও কুলায় বলে আমি বিশ্বাস করি না।
 
শুরুটা কি একটু বেশীই তাচ্ছিল্যমূলক হয়ে গেল?
হলেও আমার কিছু করার নেই- একটা সম্পূর্ণ জাতি যদি সহজ একটা বিষয়-ই না জানে, অথচ সেই বিষয়টা নিয়েই লম্ফজম্ফ করে তাহলে তো আমাকে তাচ্ছিল্যভাবেই কথাটা বলতে হবে।
 
শিক্ষকরাও জানে কথাটা এজন্যই বললাম যে- তারা গণতন্ত্র শব্দটিকে মাত্র একটি অমানানসই এবং প্রয়োজনহীন বাক্যেই আবদ্ধ করে রেখেছে যে ‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা এবং জনগণ কর্তৃক’!
 
উদাহরণটি রীতিমত হাস্যকর!
একটা কোট ব্যবহার করেই ‘গণতন্ত্র’কে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে!
 
বলছি কি- আব্রাহাম লিংকন কি কখনও বলেছিলেন যে গণতন্ত্র মানেই এটা? তাছাড়া আব্রাহাম লিংকন কি আমেরিকার সিভিল ওয়ারে ওই পেনসালভ্যানিয়ার গীটসবার্গের সেই বিষুদবারের বিকেলের (১৯শে নভেম্বর ১৮৬৩) সমাবেশে গণতন্ত্র শিখাতে এসছিলেন?
 
বাংলাদেশ একটা বিভ্রান্ত দেশ, বিভ্রান্তিকর দেশ, এর চালকরাও বিভ্রান্তমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত!
 
অনুগ্রহ করে ‘গীটসবার্গ এড্রেস’টি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে তারপর ‘গণতন্ত্র’ কপচালে বরং বেশী জ্ঞানঅর্জন সম্ভবপর হলেও হতে পারে।
 
বাংলাদেশের শাসক, শিক্ষককুল, বুদ্ধিজীবিরা যদি বিভ্রান্তকর না-ই-বা হতেন তাহলে অন্তত বাংলাদেশের পোষাকী নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রাখতেন না। রাখতে পারতেন না।
 
বাংলাদেশে কোন ‘প্রজা’ বসবাস করে না।
আমি কারো প্রজা নই, আপনিও (সম্ভবত) কারো প্রজা নন।
যে দেশে কোন প্রজা-ই নেই, সে দেশের নাম ‘প্রজাতন্ত্র’ হয় কিভাবে?
 
সুতরাং বাংলাদেশের পোষাকী নাম পরিবর্তন করতে হবে।
সেটা শুধু ‘বাংলাদেশ’ হলেও গ্রহণযোগ্য, নামের মধ্যে চরিত্রও থাকতে হবে- সেটারও কোন প্রয়োজনও দেখি না।
 
প্রজা ছাড়া প্রজাতন্ত্র হতে পারে না।
যাই হোক, আবার ফিরে চলুন গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনায়।
 
গণতন্ত্র সেটাই যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সিদ্ধান্তেই রাষ্ট পরিচালিত হবে এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে।
 
কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ শব্দটিতে অবশ্যই দু’টি দিকে ভাগ করতে হবে।
একটি হলো ‘নির্বাচন ব্যবস্থা’ এবং অপরটি হবে ‘রাষ্ট্রিয় সংবিধান’। দু’টি বিষয় সম্পূর্ণভাবেই ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। একটার সংগে অন্যটির কোনই সামঞ্জস্যতা নেই কিন্তু একে অপরের পরিপূরক।
 
আপনি যদি গণতন্ত্রকে দু’টি দিকে ভাগ না করেন- তাহলে ‘গণতন্ত্র’ আপনার কাছে গুরুত্বহীন এবং বিরক্তিকরও ঠেকবে। অনেকেই গণতন্ত্রকে বিরক্তিকর বলেনও!
 
বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থাতেও গণতন্ত্র নেই, আর রাষ্ট্র পরিচালনায়ও সৃষ্ট সংবিধানেও নেই গণতন্ত্রের ছিটে-ফোঁটা। এরপরও যখন দেখি নেতা-নেত্রীরা ‘গণতন্ত্র’ গণতন্ত্র বলে ছবক দেয়- তখনই আমি বিরক্ত হই।
 
এখানে আরও একটি বিষয়ও আলোচনার দাবী রাখে।
সেটা হলো- গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা বা রাষ্ট্র পরিচালনার ধরণ; একটা হলো ‘সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা’ এবং অপরটি হলো ‘রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা’।
 
আমাদের উপমহাদেশীয় দেশগুলোতে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা দেখা যায়, বিশেষত ভারতে। পাশ্ববর্তী পাকিস্তানের গণতন্ত্র আলোচনারই অযোগ্য। অপর পর্শীরাষ্ট্র শ্রীলংকা, মালদিভস, নেপাল, থাইল্যান্ডও বাস্তবিক গণতন্ত্র অনুপস্থিত।
 
ভুটানের রাজা জিগমে সিগমে ওয়াংচুক দীর্ঘদিন রাজতান্ত্রিক শাসক থেকে পদত্যাগ করে নিজ পুত্র প্রিন্স জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুক কে রাজা ঘোষনা দিয়ে এবং তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিজে চারটি বউ নিয়ে (সেই ৪টি বউও আবার আপন চার-বোন) অবসরজীবন যাপন করে যাচ্ছেন।
 
রাজা জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুক ক্ষমতা গ্রহনের কয়েক বছরের মধ্যেই কোনরূপ জনদাবী ছাড়াই নিজের উন্নত চারিত্রবলে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় নিজেকে শুধুই আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্র-প্রধান ঘোষনা দিয়ে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন।
 
আমি মুলত পালামেন্টারী এবং প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কয়েকটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
 
বাংলাদেশের সংসদীয় বা পার্লামেন্টারী সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের একটা জোড়াতালী দেয়া সংবিধানও রয়েছে- যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকার তখন বাদবাকী জীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য সংবিধানটিতে জোড়াতালী দেয়। দিয়েই যাচ্ছে দিয়েই যাচ্ছে।
 
বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান জেলমুক্ত হয়ে থেকে লন্ডন দিল্লী হয়ে ঢাকায় ল্যান্ড করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের উষ্ণ শুভেচ্ছা নেবার সময় প্রথমেই তাঁর কানে কানে বললেন, ‘তাজউদ্দিন আমি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হবো’।
 
ঐ একটা কথাতেই বাংলাদেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, সরকারব্যবস্থায় স্বেচ্ছাতাড়িতা প্রকাশ পায়।
 
এছাড়া বিদ্রোহী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচে সিনিয়র সদস্য মেজর জিয়াউর রহমান কে সেনাপ্রধান না করে শেখ মুজিব নিজের স্বেচ্ছাচারিতায় সফিউল্লাকে সেনা প্রধান নিয়োগ করে নিজেকেই ‘সংবিধান’ হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন।
 
প্রধানমন্ত্রী হলেন শেখ মুজিব কিন্তু বেশীদিন তার ভালো লাগলো না।
এরপর তিনি বাদবাকী জীবন ক্ষমতায় থাকতে, গণতন্ত্রকে পুরোপুরি হত্যা করে দেশে ‘বাকশাল’ এর নামে গঠন করলেন একদলীয় শাসনব্যবস্থা। পুরোদমে জোড়াতালি শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের সংবিধানটি।
 
শেখ মুজিবের পর নানা চড়াই-উৎড়াই পার হয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের প্রেসিডেন্ট হলেন। তারপর আবারও প্রেসিডেন্ট হলেন এরশাদ।
 
যাই হোক, কথায় কথায় শেখ মুজিব এবং জিয়াউর রহমানের আদর্শের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র লাখো কোটি নেতা-কর্মীরা মুজিব বা জিয়ার প্রেসিডেন্টশিয়াল আদর্শকেই ধারণ করেনা।
 
শেখ হাসিনা বা বেগম জিয়া তাদের সেই ‘পবিত্র আদর্শ’ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে সেই কবেই!
 
বেগম জিয়া একানব্বইতে ক্ষমতা গ্রহন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন এবং ‘গণতন্ত্র’র যেই আসল সৌন্দর্য (যেটুকুই ছিল বাংলাদেশে) সেই আসল সৌন্দর্যটুকুও নির্দিধায় শেখ হাসিনার সহযোগীতা নিয়ে স্বৈরাচারিতা গঠনকল্পে ‘হত্যা’ করলেন।
 
‘গণতন্ত্র’ বলে দিনরাত চিৎকাররত ঐ দুই মহিলার দলে এখন আর কেউ তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেবারও ক্ষমতা রাখেন না- সংবিধান বলে কোন সংসদ সদস্য যদি আজ বেগম জিয়া বা শেখ হাসিনার কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেয় তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ বিলুপ্ত হবে।
 
এই হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র।
এই হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান।
অর্থাৎ শেখ হাসিনা বা বেগম জিয়া যখন যা ভাববেন- সেটাই বাংলাদেশের আইন, সেটাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র!
 
এরকম ঘৃর্ণ, দুর্গন্ধযুক্ত, নষ্ট সংবিধান এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা রয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। হ্যা, উত্তর কোরিয়া আর কিউবায় অবশ্য রয়েছে- যেমনটা করতে চেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাইতো ‘ফলোয়ার মুজিবকে’ পাম দিতে ফিডেল ক্যাষ্ট্রো শেখ মুজিবকে ‘হিমালয়’ উপাধী দিয়েছিলেন।
 
আমি খুব ঘনিষ্ঠভাবে এই পৃথিবীর ৬-সাতটা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞানাজর্নের সুযোগ পেয়েছি; ভারত, চায়না, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং শেষটায় আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও দেখেছি। স্ট্যাডী করেছি রাশিয়া, ইউনাইটেড কিংডম, অষ্ট্রেলিয়া আর ইউরোপিয়ান দেশগুলির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কেও।
 
আমি নির্দিধায় আজ একথা বলতে পারি যে, প্রেসিডেন্টশিয়াল সরকার ব্যবস্থায় প্রতিস্ঠিত গণতন্ত্রই প্রকৃত গণতন্ত্র।
 
আর সেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে হবে ‘ইলেকট্ররাল কলেজ’ ভিত্তিক নির্বাচনব্যবস্থায়। তবে, সেই সংবিধানে ন্যাশনাল পার্লামেন্ট এর থাকে স্বাধীন আইন প্রণয়ণের ক্ষমতা।
 
পার্লামেন্ট শুধুই আইন প্রণয়ন করবে।
প্রেসিডেন্ট সেই অাইন মেনে দেশ পরিচালনা করবে।
 
আইনের বাইরে গিয়ে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বা নিজের ইচছাতে কোন আইন পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারবেন না প্রেসিডেন্ট।
 
পার্লামেন্ট সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহন করবে না- তারা শুধুই আইন প্রণয়ন করবে। আইন প্রণেতাকে রাষ্ট্রিয় ক্ষমতার লোভহীন রাখতে হবে।
 
এবং দেশের প্রতিটি স্তরে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও আঞ্চলিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
 
ইউনিয়ন কাউন্সিল, উপজেলা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, সিটি কাউন্সিল- কোন অনির্বাচিত ব্যক্তিকে ‘ডিসিসন মেকার’ বা সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ক্ষমতা প্রদান করা যাবে না।
 
পুলিশ বাহিনীকে সিটি বা উপজেলা বা জেলা কাউন্সিল এর অধীনে ন্যাস্ত করতে হবে। প্রশাসক বা টিএনও, ইউএনও, ডিসি’র মাধ্যমে শাসনকার্য সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে।
 
পুলিশকে স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা পরিষদের অধীনে নিলে এলাকার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব তার উপর বর্তাবে এবং সে নির্বাচনের ভয়ে কোন অন্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহনে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য থাকবে।
 
এবং বাংলাদেশের মতো চারিত্রিক দেশের নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে:
এক) প্রতিটি নির্বাচিত পদের শাসন মেয়াদকাল হবে ৩ (তিন) বছর। সেটা হোক প্রেসিডেন্ট, বা সিটি মেয়র যা যাকিছু।
দুই) একজন ব্যক্তি তার জীবনে কোন পদেই দু’মেয়াদের বেশী ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।
 
স্বল্পমেয়াদী ক্ষমতাকালে কেউই জনসেবার বাইরে কিছুই চিন্তার সময় পাবে না। এবং নিজেকে ভালো ও সৎ প্রমাণের একটা চমৎকার রাস্তা তৈরী হবে।
 
সবচে খারাপের ভালো নয়- সেরা ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরে।
 
এবং সবচে জরুরী বিষয়টা হলো- প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
 
বেগম জিয়া বা শেখ হাসিনা এককভাবে সিদ্ধান্ত জানাবেন- এই ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলে না। তৃণমুল থেকে কর্মীরা সিদ্ধান্ত গ্রহন করবে কে মনোনয়ন পাবে- বেগম জিয়া বা শেখ হাসিনার কোন ক্ষমতাই সেখানে কাজ করবে না।
 
আর যখন ঠিক এমন একটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশে শুধুমাত্র সেদিনই ‘এই আপনিও’ যোগ্যতা থাকলে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন।
 
আমি আমার জীবদ্দশায় সেই দিনটা দেখে যেতে চাই।
   Send article as PDF