পেছনের ভাবনা

আলীবাবাতে একটা ইনকোয়ারী পেলাম, সুইজারল্যান্ড থেকে একটা কোম্পানী কিছু ‘নাট-বল্টু’ কিনবে। আমি সাপ্লাই করতে পারবো কি না জানতে চেয়েছে।
 
আলীবাবাতে আমি একাউন্ট করেছি সেই ১৯৯৯ সালেই।
ঐ ১৯৯৯ সালেই আলীবাবার জন্ম। আর আমি ইন্টারনেট ব্যবহার করে আসছি ১৯৯৭ সাল থেকে।
 
আর যে ঘটনাটা বলছি সেটা সম্ভবত ২০০৩ বা ২০০৪ এর দিককার কথা।
 
আমি টেকনিক্যাল ডিটেইলস, কোয়ানটিটি এবং কোন পোর্ট পর্যন্ত মাল পৌছাতে হবে জানতে চেয়ে রিপ্লে করলাম। ওদিনই বিস্তারিত জানালো তারা। আমি ৩ দিন সময় নিলাম। এবং এর মধ্যেই স্যাংহাই এর একটা ম্যানুফ্যাকচারার থেকে বিস্তারিত তথ্য এবং অফার নিলাম। সেই অফারের সংগে ৫% এড করে ঐ সুইচ কোম্পানীকে ইনভয়েচ দিলাম।
 
যাই হোক, ব্যবসাটা শেষ পর্যন্ত ঠিক-ঠাক হয়েছিল।
আমি আমার কমিশন বাবদ প্রায় ১২৫০ ডলার আমার ‘ব্যাংক অব চায়না’র একাউন্ট এ পেয়েছিলামও।
 
এভাবেই ব্যবসা করতে হয়।
আমি প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২/৩টি ইনবক্স পাই যেখানে বাংলাদেশের অনেক তরুন আমার কাছে ব্যবসার আইডিয়াস খুঁজেন। এক কথায় তো আসলে কাউকে উত্তর দেয়া সম্ভবপর নয়- তাই আজ এ লেখাটার অবতারণা। অনেকেই উত্তর না পেয়ে হয়তো আমার উপর ইতিমধ্যেই বিরক্ত।
 
আরোও কয়েক ধরণের প্রশ্নও আমি পাই।
কেউ কেউ পড়াশোনা শেষ, এখন কি করা যেতে পারে; কিভাবে ভালো একটা চাকুরী পাওয়া যেতে পারে- সেসব পরামর্শ চায়। আবার অনেকেই কৌতুহল প্রকাশ করে আমি ঠিক কি ব্যবসা করি। ইত্যাদি।
 
কিছু জিজ্ঞাসার উত্তর দেবার চেষ্টা করছি আজ।
 
আসলে ব্যবসাটা আমি খুব কঠিন দৃষ্টিতে দেখি না, আমার কাছে সহজই মনে হয়। আমার হিসাবে এক কথায় ব্যবসা কথাটার মানে হলো, ‘আরেক জনের পকেটের টাকা বৈধ পথে আমার নিজের পকেটে নিয়ে আসা’।
 
আপাত দৃষ্টিতে কাজটা ভয়াবহ রকমের কঠিন হলেও আপনি যদি সামান্য কিছু টেকনিক এপ্লাই করেন- তাহলে আর তা কঠিন থাকবে না।
 
প্রশ্ন এসে যাবে কিভাবে টেকনিকটা এপ্লাই করবো?
এটাই আসল বিষয়।
 
তাহলে টেকনিক এপ্লাই করতে আপনাকে প্রচুর জানতে হবে, পড়তে হবে, গবেষনা করতে হবে, বিষয়বস্তুর উপর যথেষ্ঠ দখল থাকতে হবে। আপনার উপর মানুষের আস্থা থাকতে হবে।
এবং এ সব কিছুর জন্যই প্রচুর সময়ও দরকার।
 
তাহলে আজ টেকনিক বিষয়টা থাকুক, অন্য কোথাও, অন্য কোন সময় সুযোগ মতো আলোচনা করা যাবে। তারচে, আজ আমরা খুব সাধারণ কিছু ব্যবসার বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
 
যারা যারা ব্যবসা করতে চায়, তাদের সকলে এক রকম নন; সুতরাং ঢালাওভাবে একটা কমন বিষয় সবার জন্য প্রযোয্য হতে পারে না। আমি একটু গ্রুপিং করার চেষ্টা করি।
 
গ্রুপ ক) কারো কারো ইনভেষ্ট করার সামর্থ ১ লাখ টাকার মধ্যে
গ্রুপ খ) কারো কারো ইনভেষ্ট করার সামর্থ ৩ থকে ৫ লাখ টাকার মধ্যে
গ্রুপ গ) কেউ কেউ চাচ্ছেন ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতো
গ্রুপ ঘ) কারো কারো বা সেই সামর্থ ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে
 
আমি আজ এই চারটে গ্রুপ নিয়ে- তাদের জন্য আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
 
কিন্তু, তারও আগে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করবো।
১) আপনার ব্যবসা করার মুল উদ্দেশ্য কি?
২) আপনি মাসে ঠিক কত টাকা আয় করতে চান?
৩) আপনি এই ব্যবসাটাকে ভরশা করেই বাদবাকী জীবন পার করে দিতে চান কি না?
৪) আপনি কি উচ্চাভিলাষী? বারবার মতের বদল করার লক্ষ্যন রয়েছে?
৫) ব্যবসা বড় করার জন্য আপনি প্রয়োজনে ভবিষ্যতে স্থান পরিবর্তন করতে চান কি না?
 
না, আমি কোন উত্তর চাচ্ছি না।
আপনার ভেতরে ‘ডিসিশান মেকিং ক্যাপাসিটি’ ঢুকিয়ে দিচ্ছি মাত্র।
 
প্রথম কথা হলো, আপনি ঠিক কি ধরণের ব্যবসা করতে ভালোবাসেন?
 
দ্বিতীয় কথা হলো, যে ব্যবসাটা করতে চাচ্ছেন বা ভালোবাসেন- সেটার কোন অভিজ্ঞতা রয়েছে কি না?
 
এবং তৃতীয় কথা হলো, যে ব্যবসাটা আপনার করতে ইচেছ হচ্ছে- সেই স্পেসিফিক ব্যবসাটার ভবিষ্যত কি? অর্থাৎ আজ থেকে ২০ বছর পরে এই ব্যবসাটা কি চলবে না কি নতুন নতুন প্রযুক্তির ভীড়ে তখন আর এই ব্যবসাটার কোন সামাজিক ডিমান্ড থাকবে না!
 
আমার এই পয়েন্টগুলি আপনাকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে।
 
যদি এসব ভাবনার অসামর্থ হন, তাহলে আপনি প্রথম গ্রুপের (গ্রুপ ক) ব্যবসার দিকে মনোযোগ দিতে পারেন।
 
‘গ্রুপ ক’ কে বলছি, আপনি একটা ফোন-ফ্যাক্স এর দোকান দিতে পারেন। মোবাইল ব্যালেন্স রিজার্চ এবং মোবাইল এক্সেসরিজ এর ব্যবসাটা খুব একটা খারাপ না।
 
আপনার যদি কমপিউটার নলেজ থাকে অর্থাৎ কমপিউটারে ‘বাংলা-ইংরেজী’ কম্পোজ করতে পারেন বা মাইক্রোসফস ওয়ার্ডটা শিখে নিতে পারেন, তাহলে অল্প দামে একটা ভালো সেকেন্ডহ্যান্ড কমপিউটার/ প্রিন্টারও দোকানে রাখতে পারেন।
 
এক দেড়লাখ টাকার বিনিয়োগে আপনি অনেক ভালো আয় করতে পারবেন।
 
ইলেকট্রনিক্স এ যাদের ভীতি রয়েছে তারা ছোট্ট চা-পান-বিড়ি-সিগারেট এর দোকানও দিতে পারেন।
 
তবে, আমি এই গ্রুপটাকে পরামর্শ দিবো- প্রথমেই চট করে কোন ব্যবসায় না জড়াতে। আপনি ঠিক যেটা করবেন তা হলো, ওয়েল্ডিং বা কুক অথবা প্লাম্বার, রং মিস্ত্রি ইত্যাদি যে-কোন একটা হাতের কাজ মন দিয়ে শিখুন- আপনার চাকুরীর কোন অভাব থাকবে না কোন কালেও, বিশ্বের কোথাও।
 
আরও একটা কথা বলে নি, কেউ শেয়ারে ব্যবসা করতে যাবেন না। বাংলাদেশের মানুষ পার্টনারশীপ ব্যবসা করার মতো মানসিকতা পোষন করে না, যোগ্যতাও রাখে না।
 
গ্রুপ খ এর যারা লাখ পাচেক টাকা বিনিয়োগ করার সামর্থ রাখেন, তাদেরকে বলবো- যে ব্যবসাটা করতে চাচ্ছেন আগে কমপক্ষে দুই বছর সময় নিয়ে ঐ ব্যবসা-কেন্দ্রিক কোথাও একটা চাকুরী করুন। সেলস এর কিংম্বা টেকনিক্যাল চাকুরী হলে ভালো হয়; চাকুরী করতে অনেক কষ্ট হবে কিন্তু যদি কাজটা আগে শিখে নিতে পারেন তাহলে ব্যবসায় ভালো করবেন।
 
কারো মুখে গল্প শুনে কিংম্বা আপনার পরিচিত একজন ‘এই ব্যবসা’টা করেছে- খুবই ভালো করতেছে এসব মুখের কথায় কোন ব্যবসায় হাত দিবেন না। প্রত্যক্ষভাবে কাজটা সম্পর্কে আপনাকে শতভাগ অবগত হয়ে ও ন্যূনতম দুই বছরের অভিজ্ঞতা অর্জনের পরই শুধুমাত্র ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে হবে।
 
আপনি একটা গ্রোসারী বা মুদি দোকান করতে পারেন, শাড়ী-কাপড়ের দোকানও খারাপ না। তবে একটু যদি মেধা থাকে তাহলে বলবো- ‘পাকিস্তানী লন’ বা ‘ভারতীয় ভিশাল শাড়ী’র ব্যবসা করতে পারেন। নিজে ইন্ডিয়া গিয়ে শাড়ী নিয়ে আসতে পারেন। প্রথমে কোলকাতা থেকে এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের পর সুরাট (গুজরাট) গিয়েও শাড়ী আনতে পারেন।
 
গ্রুপ গ’কে অনুরোধ করবো- ‘খ’কে বলা বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করুন এবং আরেকটু বড় পরিসরে করা যায় কি না সেটাও ভাবুন। সংগে সীমিত পর্যায়ে হোলসেলও রাখতে পারেন। এবং যদি ইন্টারনেট নলেজ থাকে তাহলে দোকান এর পাশাপাশি ই-কমার্সও শুরু করে দিতে পারেন।
 
শাড়ী বলেছি বলে শুধুমাত্র শাড়ীই বুঝবেন না।
আপনি চাইলে বা বুঝলে চায়না থেকে অনায়াসে ‘লকার’ বা তালা-চাবি, যে-কোন হার্ডওয়্যার, অথবা অন্য যে-কোন প্রডাক্ট নিয়ে আসতে পারবেন।
 
কিন্তু এক্ষেত্রে একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, অবশ্যই বাজারের প্রচলিত প্রডাক্ট আনবেন।
 
নতুন কোন প্রডাক্ট বাংলাদেশের মানুষ সহজে গ্রহণ করে না। বাংলাদেশের মানুষ ‘টয়োটা’ ছাড়া কোন গাড়ী চেনে না। ফ্যান বলতে বুঝে টংগী ন্যাশনাল। সুতরাং এই জাতিকে টয়োটা আর টংগী ন্যাশনালই খাওয়াবেন।
 
আর ‘গ্রুপ ঘ’ কে এবং একই সংগে যাদের হাতে কোন টাকা নেই কিন্তু সাহস আছে, রয়েছে কিছু মেধা তাদের জন্য কমন পরামর্শ হলো, অনলাইনে গুগল, আলীবাবাতে যে-কোন পছন্দসই প্রডাক্ট নিয়ে স্ট্যাডী করুন। যে-কোন প্রডাক্ট এর রুটে ঢুকে যাবেন, ম্যানুফ্যাকচারার এর প্রাইজ এবং রিটেইল প্রাইজ এর মধ্য-খানের ব্যবসাটুকু বোঝার চেষ্টা করুন।
 
দেশী-বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানীর সংগে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ যোগাযোগ করুন। ব্যাংকে একটা বিজনেস একাউন্ট খুলুন এবং সেখানে যতটুকু সম্ভব লেন-দেন করুন। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে কখনওই ব্যবসায় করার কথা চিন্তাও করবেন না।
 
আমি ২৫-৩০ লাখ টাকাওয়ালা এবং টাকা-পয়সা ছাড়া অথচ মেধাবীদের একই গ্রুপ ফেলাতে অনেকে হয়তো অবাক হবেন। কিন্তু আমি নিজেও কিন্তু এই গ্রুপেরই একজন। আমি শূন্য হাতে সেই ১৯৯৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ব্যবসা শুরু করি। অবশ্য সেই আমলে আমার বন্ধুরা যারা বড় অংকের ক্যাপিটাল নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল- তারা কিন্তু প্রতিযোগীতায় আমার সংগে পেরে উঠেনি।
 
সুতরাং আমি পারলে, আপনিও পারবেন।
প্রডাক্ট কেনাবেচাকারীদের জন্য সর্বশেষ পরামর্শ হলো, ‘যে-কোন প্রডাক্ট বিক্রি করে লাভবান হবেন সেই চিন্তা না করে কেনার সময় লাভবান হবার চেষ্টা করুন।’
 
আর যাদের মেধাই একমাত্র ভরসা, তারা সার্ভিস প্রভাইড করা যায় এমন ব্যবসা করুন। অনেক অপুর্চনিটিজ রয়েছে- একটু শুধুমাত্র চোখ-কান খোলা রাখুন।
 
কিছু করতে হবে না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে চায়নিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান ইত্যাদি যে-কোন একটা ভাষা শিখুন। তারপর দেখুন ‘ইন্ট্রাপেটার’ হিসাবে কাজ করে এবং টাকা আয় করে শেষ করতে পারবেন না- ঐ ঢাকা শহরে থেকেই।
 
গার্মেন্টস এর বাইং হাউজ করতে পারেন, বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে পারেন। চায়নাতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কাজ করে খুব অল্প সময়েই আমার পরিচিত একটা ছেলে আজ দারুণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আপনিও পারবেন।
 
এবং শেষটায় বলবো, ব্যবসা করবেন ব্যাংকের টাকায়- অবশ্যই নিজের টাকায় নয়। নিজের টাকা দিয়ে শুরু করুন, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করুন।
 
ব্যাংকের কাজ বিনিয়োগ করা, ব্যাংকের কাজটা ব্যাংককেই করতে দিন, আপনি কেন করবেন। তবে, অবশ্যই ব্যাংকের কোন ‘এসএমই লোন’ নিবেন না- ওটা স্রেফ ভাওতাবাজী, ব্যাংকিং নষ্টামী। সিসি নিবেন (লাইন অব ক্রেডিট), এলসি সুবিধা নিবেন।
 
চোখ-কান খোলা রাখুন, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করুন- আপনাকে টাকার পেছনে নয়, টাকাই তখন আপনার পেছনে দৌড়াবে।
   Send article as PDF