মাথা উঁচু করে থাকা একজন শেখ মুজিব

বাংলাদেশের বা পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে শেখ মুজিবর রহমান নিঃসন্দেহে অহংকার করার মতো একটি নাম। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে সমাজের একজন অতি সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র নিজ দক্ষতায় দেশের রাষ্ট্রনায়ক হতে পারে। শেখ মুজিবর রহমান কোন পরিবারতন্ত্র থেকে বা কোন সরকারী আনুকুল্য কিম্বা বাই চান্স নেতা বনে যান নি; তিনি যা কিছুই করেছেন তার সবটুকুই নিজস্বতা দিয়ে।

সেই যোগ্যতা শেখ মুজিবর রহমানের ছিল।
এই আর্টিকেলে আমি আজ শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে ‘নেগেটিভ’ কিছু না লেখার চেষ্টা করবো। তারপরও শুধু একটা প্রসংগ শুরুতেই উল্লেখ করবো, আর সেটা হলো তিনি প্রকৃতপক্ষেই ‘বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা’ ছিলেন। এবং ঠিক এই স্থানটিতেই তিনি ‘সীমাবদ্ধ’ হয়ে গিয়েছিলেন, ‘গন্ডিতে আবদ্ধ’ হয়ে পরেছিলেন।

আমাদের বুঝতে হবে তখন ‘বাংলাদেশ’ বা ‘বাঙালী’ নিয়ে কোন দেশ ছিল না, ছিল একটা জাতির খন্ডিত অংশবিশেষ মাত্র। কিন্তু সেসময় দেশটা ছিল বহুজাতিক একটি দেশ এবং দু’টি বিচ্ছিন্ন ভুখন্ড যাদের মাঝে মিনিমাম দূরত্ব ছিল আকাশ পথে ১৫০০ মাইল।
এমন একটা বহুজাতিক দেশের নেতা হবার মতো ‘যোগ্যতা’ বা ‘দক্ষতা’ শেখ মুজিবর রহমন ধারণ করতেন না; তিনি ছিলেন শুধুই ‘বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা’। এবং এই বাঙালীরা বসবাস করতেন ‘পূর্ব বাংলা’য় যার পোষাকী নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’। বাদবাকী অর্ধেক বাঙালী বসবাস করতেন বা এখনও করেন পশ্চিম বাংলায়- যেটা ভারত-বর্ষে অবস্থিত। কিন্তু তারপরও আমরা যদি শেখ মুজিবের কলেজ জীবন পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাবো সেই অল্প বয়সেও তখনকার ‘বাংলা প্রদেশ’ এর রাজধানী কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) এর জিএস (সাধারণ সম্পাদক) ছিলেন তিনি। অসাধারণ এক তুখোর ও প্রচন্ড জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন তরুন শেখ মুজিব। কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে থাকার সময়টাতে শেখ মুজিব ছিলেন সেই কলেজের প্রাণ- একথা বলতে আমার কোনই দ্বিধা নেই; অন্তত আমি যতটুকু জানতে পেরেছি বিভিন্ন রেফারেন্স থেকে।


সেই তুখোর ছাত্র নেতা শেখ মুজিবের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেই সময়গুলোতে কলিকাতায় পদচারণা করতেন ডেপুটি মেয়র হিসাবে বা ছিলেন বাংলার প্রাদেশিক মন্ত্রীও।


হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অধীনে শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। মজার বিষয় হলো, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যেই কলিকাতায় বসে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং যেদিন তাদের আন্দোলন সফল হলো সেদিনই তিনি জানতে পারলেন যে আন্দোলন সফল হলেও এই প্রাণের কলিকাতা নগরী আর তাদের নেই। তাদের মাথায় যেন ভূমিধস হয়েছিল সেদিন। কিন্তু আমি বিষয়টিকে দেখবো নেতা হিসাবে তাদের লজ্জাজনক ব্যর্থতা হিসাবে- তারা সেদিন তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারেননি। আন্দোলনের মুল দাবীতেই তারা তাদের পায়ের নীচের মাটিকেই ধরে রাখতে পারেননি।


পাকিস্তান স্বাধীন হলো। এবার তাদের কলিকাতা ছাড়তে হবে; ও মাটি আর তাদের না। শেখ মুজিব কলিকাতায় পার্টনারশীপে একটা রেষ্টুরেন্ট গড়ছিলেন- সেটাও তাকে ছেড়ে দিতে হলো। তিনি খালি হাতে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় এসে একটা মেসে উঠলেন।
আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে থাকলেন বেশ কয়েক মাস কলিকাতাতেই। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন তিনি। অবশেষে মেদেনীপুরের তল্পিতল্পা গুটিয়ে তিনি ঢাকায় না এসে পাড়ি জমালেন করাচীতে।


হ্যা, করাচী তখন পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় রাজধানী। পাকিস্তান-ভারতের মতো দেশে কাউকে জাতীয় রাজনীতি করতে হলে তো কেন্দ্রিয় রাজধানীতেই থাকতে হবে। শেখ মুজিব প্রথমেই নিজের অলক্ষ্যেই ছিটকে পড়লেন ‘জাতীয় রাজনীতি’ থেকে এবং হয়ে গেলেন আঞ্চলিক নেতা এবং পরিণত হলেন শুধুমাত্র ‘বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা’য়।
বিষয়টাকে আমরা আরও একটু ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষন করতে পারি এক কথায়। সেটা হলো, রংপুরের রহিম উদ্দিন ভরসা কিন্তু রংপুরেরই নেতা; তিনি কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নেতা নন। জাতীয় নেতা হতে হলে তাকে ঢাকামুখী রাজনীতি করতে হবে। আপনি জাতীয় নেতা হবেন কিন্তু বসবাস করবেন টেকনাফে- বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানে অন্তত এমনটা সম্ভব নয়; এসব দেশের বাস্তবতায়।


এটা আমেরিকায় সম্ভব। শিকাগো থেকে সেখানে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হতে পারছেন, জর্জ বুশ পারছেন টেক্সাস এর কোন এক অজ গ্রাম থেকে এসে কিংম্বা ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউ ইয়র্কে থেকেই পেরেছিলেন। আমেরিকা দেশটা এভাবেই গড়া। পাকিস্তান বা বাংলাদেশ নয়।


যাই হোক, আমাদের আলোচনা শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশ।শুরুতেই যে ভুলটা শেখ মুজিব করেছেন তাকে তো সেই রেজাল্টই উপভোগ করতে হবে। হলোও তাই। তিনি নেতৃত্ব দিলেন ঢাকা কেন্দ্রিক। করাচী বা রাওয়ালপিন্ডির রাস্তাঘাট বড়ই অচেনা তার। তার উপর দেশ দখলে নিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। নেতৃত্বে আইয়ুব খান।


উচ্চাভিলাসী সেনা শাসক আইয়ুব খান পাকিস্তান দেশটারই আমুল পরিবর্তন করলেন। তিনি পূর্ব বাংলাকে করলেন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৭টি প্রদেশকে জুড়ে দিয়ে এক ইউনিট পাকিস্তান করে ফেললেন। দুটোই প্রদেশ থাকলো তখন; পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান নামের।


ঢাকাকে করা হলো সেকেন্ড ক্যাপিটাল। সেকেন্ড ক্যাপিটালে গড়ে তোলার কাজে হাত দিলেন আইয়ুব খান, গড়লেন আজকের সুরম্য শেরে বাংলা নগরের সংসদ ভবন। অপরদিকে ইসলামাবাদে দিলেন মেইন রাজধানী গড়ায় হাত। একই সংগে ঢাকাকে করা হলো পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী। আর ‘ওয়ান ইউনিট’ পশ্চিম পাকিস্তানের একক প্রাদেশিক রাজধানী করা হলো লাহোরকে। ৩টি রাজধানী গড়েছেন তিনি- শেখ মুজিব তার তীব্র বিরোধীতা করলেন।


সেনা অফিসার আইয়ুব খান দেশটাকে আরও কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করে একটি সম্পূর্ণ গনতান্ত্রিক ‘ইউনাইটেড ষ্টেটস’ না করে উল্টো পথে ‘শক্তিশালী’ পাকিস্তান করার নামে গণতন্ত্রকেই বিকশিত হতে দিলেন না।


অথচ, তারই অদূরদর্শিতার ফলাফল আজ ভোগ করছি আমরা বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ। জেনারেল আইয়ুব খান বাংলাদেশকে যা করে দিয়ে গেছেন সেটা অচিন্তনীয়, তার ডেভেলমমেন্ট প্লান এর ধারে কাছেও কেউ বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করতে পারেনি।
আইয়ুব খান যদি ওয়ান ইউনিট শক্তিশালী পাকিস্তান চিন্তা না করে ইউনাইটেড ষ্টেটস চিন্তা করতেন এবং একটি পুর্নাংগ ‘গণতন্ত্র’ ডেভেলপমেন্টে হাত দিতেন- তাহলে পাকিস্তান দেশটির নাম আজ এই বিশ্বের মানুষ সম্মানের সাথেই উচ্চারণ করতো। কিন্তু এই একটা জায়গায় তিনি বড় বেশী ভুল করে ফেলেছিলেন।


তার এই ভুলের খেসারত খুব দ্রুতই দেয়া হলো। গণতন্ত্রকে তিনি বিকশিত করার পরিবর্তে তার পেশী শক্তি দিয়ে সব কিছু পরিচালনা করতে থাকলেন। ঢাকায় প্রাদেশিক নেতা বারবার শেখ মুজিবকে বন্দি করে কারাগারে পুরতে লাগলেন, শেখ মুজিব তখন জাতীয় রাজনীতি নিয়ে নয়- পূর্ব পাকিস্তানের ৬ দফার স্বায়স্তশাসন নিয়ে আঞ্চলিক আন্দোলন করছেন।


আইয়ুব খান কোনো বিরোধী মত সহ্য করতেন না। ফলাফল তাকে গণআন্দোলনের কাছে মাথা নোয়াতে হলো। কিন্তু তিনি কোন দায় না নিয়ে ক্ষমতা দিয়ে দিলেন আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে।


মাথামোটা ইয়াহিয়া খান সঠিক কোন হিসাব নিকাশ না করেই সরাসরি জাতিয় নির্বাচন দিয়ে দিলেন। সেই জাতিয় নির্বাচনে জাতীয়ভাবে প্রতিদ্বন্দিতা করলেন দুই জন ‘আঞ্চলিক নেতা’।


বুঝুন অবস্থা।নির্বাচন হচ্ছে ‘জাতীয় সংসদে’র কিন্তু নেতারা সব ‘আঞ্চলিক মানের’। পশ্চিমের জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা শহর চিনেন না, চিনেন না এখানকার মানুষদের। অপরদিকে পুবের শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সম্পূর্ণই অচেনা রাওয়ালাপিন্ডির রাস্তাঘাট, মানুষ।


এহেন দু’জন আঞ্চলিক নেতা কিভাবে জাতীয় নির্বাচন করবেন?ফলাফলও তাই হলো।
শেখ মুজিবর রহমান পুবের সব আসন জয় করলেন আর পশ্চিমের সবগুলি পেলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। পশ্চিমের একটি আসনও পেলেন না শেখ মুজিব; পুবের একটা আসনও পেলেন না ভু্ট্টো।


এরা কেমন জাতীয় নেতা?যা হবার তাই হলো।যতটুকু যোগ্যতা, ততটুকুই তো হবে।
এক দিকে শেখ মুজিব, অন্য দিকে ভুট্টো আর মাঝখানে স্থুলবুদ্ধির ইয়াহিয়া খান। এই তিনজনই এবার ‘একক ক্ষমতা’র মালিকানা চাচ্ছেন- অথচ একজনও উপযুক্ত নয় বিশাল দেশ পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকারের নেতৃত্ব দিতে।


শুরুহলো তিনজনের মধ্যে যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ পরিণত হলো শেষ পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে এবং যা আমাদের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ।


শেখ মুজিব পরিস্থিতি বুঝতে পারলেন। শেখ মুজিব মনে প্রানে পাকিস্তান রক্ষা করতে চেয়েছেন। তিনি ভারতকে পছন্দ করতেন না, বিশ্বাস করতেন না। সেটা তার জীবনী ঘাটলেই পরিস্কার বোঝা যায়। যুদ্ধ এড়াতে তিনি পাকিস্তানী আর্মির কাছে আত্মসমর্পন করলেন।


কিন্তু দেশজুড়ে মার্চের ৩ তারিখ থেকেই আওয়ামী লীগের কর্মী-নেতারা মিলে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরী করে ফেলেছেন শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রীত্ব দেবার দাবীতে- যৌক্তিক দাবী তাদের আওয়ামী লীগ দুই দেশ মিলিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে। সেই আওয়ামীদের নেতৃত্বের অরাজকতা এতই বেশী ছিল যে সে সময় (মার্চের ৩ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে) প্রায় ২৫ হাজার অবাঙলীকে হত্যা করা হয়েছে; বাংলাদেশ থেকে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে গেছে হাজার হাজার অবাঙালী।


এমন এক অরাজকতার মধ্যেই শেখ মুজিবকে আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং ঢাকায় অপারেশন সার্সলাইট পরিচালনা করলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। নেতৃত্ব দিল জেনারেল টিক্কা খান- যাকে কসাই টিক্কা বলা হতো।


নিরীহ মানুষের উপর রাতের আঁধারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চালালো গণহত্যা। তারপরের ঘটনা আমরা সকলেই জানি। শুরু হলো যুদ্ধ। ১৬ই ডিসেম্বর পাক বাহিনীর পক্ষে ৪৫ হাজার সেনা নিয়ে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পন করলেন ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনীর কাছে। আটক করা হলো মোট প্রায় ৯৫ হাজার সামরিক-অসামরিক পাকিস্তানীকে এবং তাদেরকে যুদ্ধবন্দি হিসাবে নিয়ে যাওয়া হলো দিল্লীতে।


আর চলে যাবার সময় ভারতীয় সেনারা সংগে করে নিয়ে গেল পাকিস্তানীদের সকল সামরিক ও আবাসিক সরঞ্জাম, গাড়ী, অস্ত্র, সবকিছু; বাদ যায়নি ঘরে আবাসিক জিনিসপত্র খাট, ফ্রিজ, টিভি কিছুই! অথচ সবকিছুরই উত্তরাধিকারিত্ব ছিল বাংলাদেশের। পাকিস্তান সৃষ্টিকে ভারত মেনে নিতে পারেনি কোন কালেই- সেই পাকিস্তানকে ভেংগে দিয়ে চুড়ান্ত এক বিজয় অর্জন করলো ভারত।


ওদিকে নানা নাটকীয়তার পর জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন। শেখ মুজিবকে জেলখানা থেকে মুক্তি দিলেন। শেখ মুজিব চলে গেলেন লন্ডনে।
শেখ মুজিব তার যাত্রার শুরুটাই করলেন একটা বড় ধাপ্পাবাজী দিয়ে।


যেই ধাপ্পাবাজী দিয়ে তিনি পূর্ব বাংলার মানুষকে বুঝিয়েছিলেন পাকিস্তানীরা এদেশ থেকে সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে ঠিক তেমনি একটা বড় মাপের ধাপ্পাবাজী এবার তিনি দিলেন বিশ্ববাসীকেও। বললেন ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে- যেটা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং অবাস্তব এক পরিসংখ্যান।


মাত্র ৪৫ হাজার পাকিস্তানী সেনা ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করবে- সেই যুগে সেটা ছিল অসম্ভব (কোন বোমাবাজী বা উপর্যপুরী বিমান হামলা ছাড়াই)। প্রতিদিন ১১,৫০০ মানুষকে গুলি করে হত্যা করা মাত্র ৪৫,০০০ সেনার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া প্রতিটি গ্রামে গড়ে ৪৬জন করে মানুষ মারাও যায়নি। আমার নিজের গ্রামে মারা গিয়েছিল মাত্র ৩ জন। কোন কোন গ্রামেও ১জনও মারা যায়নি। ঘটনাচক্রে কিছু এলাকায় শতাধিক মানুষ শহীদ হয়েছে। কিন্তু সেটা ৩০ লাখ নয়। সংখ্যাটি ম্যাক্সিমাম এক থেকে দেড় লাখ হতে পারে।
একটা দেশের যাত্রার শুরুটাই হলো একটা মিথ্যা জালিয়াতি দিয়ে। যাই হোক, এরপর শেখ মুজিবুর রহমান একটি অসাধারণ কাজ করলেন।


তিনি প্রথম সাক্ষাতেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে বাংলাদেশ থেকে তার সেনাদের ফিরিয়ে নিতে প্রচন্ড চাপ দিলেন। আমার ধারণা ইন্দিরা গান্ধি এতটা চাপ তার প্রধানমন্ত্রীত্বে অন্য কিছুতেই পাননি। এবং শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বের কাছে ইন্দিরা গান্ধির মতো নেতা মাথা নোয়াতে বাধ্য হলেন। ফিরিয়ে নিলেন তার সেনাবাহিনী।


এই অসাধারণ কাজটি শেখ মুজিবের মতো নেতার পক্ষেই সম্ভব ছিল।
যদ্দিন ক্ষমতায় ছিলেন শেখ মুজিব, কারো কাছে মাথা নোয়াননি। সর্বদা মাথা উচু রেখে কথা বলতেন তিন। অনেক অন্যায় তিনি করেছেন, দেশে গণতন্ত্র হত্যা করেছেন, মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা দেননি, অন্যায় শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছেন জাতির উপর, অদক্ষ শাসক হিসাবে দুর্ণাম কুড়িয়েছেন, একনায়কতন্ত্র চালিয়েছেন, বাকশাল করেছেন, রক্ষী বাহিনী দিয়ে মানুষ হত্যা করিয়েছেন, সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করেছেন।


কিন্তু মাথা নোয়াতে জানতেন না শেখ মুজিবর রহমান।আমরণ তিনি ভারতের কাছে মাথা নীচু করেননি। ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিতে যাবার সময় তাকে উপদেশ দেয়া হয়েছিল দিল্লী হয়ে যাবার জন্য, গর্জে উঠেছিলেন শেখ মুজিব- তিনি ভারতের কাছে মাথা বন্দক রেখে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেননি।


শুধুমাত্র তার অদূরদর্শী শাসন-ব্যবস্থাটুকু বাদ দিলে একজন ‘মহান নেতা’ হিসাবে তার তুলনা পাওয়া কস্টকর। মানুষের দোষগুন থাকবেই। শেখ মুজিবর রহমান কোন মহামানব ছিলেন না। আমাদের মতোই সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু তার মাথা উচুঁ রেখে কথা বলাকে আমি স্যালুট করি।


আমাদের দেশে সব তো আজ মোসাহেব; তোষামদীর বাইরে কেউ কিছুই শিখে নি, জানেও না।


কিন্তু এই দেশটিরই নেতা, বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবর রহমান একজন আজিবন মাথা উঁচু করে রাখা মানুষ। শেখ মুজিবের মতো মাথা উচুঁ করতে জানা কিছু মানুষই শুধুমাত্র বর্তমান স্বৈরশাসকের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচাতে পারে। হাজার হাজার তোষামদে পরিপূর্ণ এই জাতি আর কবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে- আমি জানি না।


এই শূণ্য থেকে উঠে আসা মাথা উঁচু করতে শেখানো মহান মানুষটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

   Send article as PDF