জম্মু ও কাশ্মির এবং ভারতীয় আগ্রাসন

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা হয় একটা ‘বিবাহ’ নামের চুক্তি-নামার মাধ্যমে। ‘ডিভোর্স’ নামের আরেকটি ধারা ঐ চুক্তি-নামাকে বাতিল করে দেয়।
 
ছেলে বা পুরুষরা সারাজীবন-ই নামের আগে ‘মিষ্টার’ ব্যবহার করে থাকে হোক সে বিবাহিত বা চিরকৃমার।
 
কিন্তু মেয়েদের বিষয়টা একটু ভিন্ন ও জটিল; তারা বিয়ের পূর্বে ‘মিস’ এবং বিয়ের পর হয়ে উঠে ‘মিসেস’।
 
কিন্তু আপনি কি জানেন যে- কোন মেয়ের ডিভোর্স হয়ে গেলে বা তার স্বামী মারা গেলে সে কিন্তু আর ‘মিসেস’ থাকে না; অর্থাৎ সে আবার সবচুক্তির ধারা বাতিল হয়ে যাওয়াতে নতুন করে হয়ে ওঠে ‘মিস’।
 
অর্থাৎ মেয়েটি যাবতীয় সবকিছুকে শ্রেফ অতীত করে দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্বতায় ফিরে আসে- আগের কোন কিছুই আর তার বর্তমানে থাকতে পারে না।
 
ডিভোর্স হয়ে যাওয়া সেই পুরুষ আর চাইলেই এই মেয়েকে ফিরে পেতে পারে না; ইসলামী আইন মতে তারজন্য সেই মেয়েকে একটা ‘হিল্লা বিয়ে’ অতিক্রম করে আসতে হয়। মানে, একটা ‘চুক্তি’ করে আবার মন চাইলেই সেই চুক্তি বাতিল করা যায় না। চুক্তি বাতিলের আগে বিশদভাবে চিন্তাভাবনা করে নিতে হয়।
 
চলুন কাশ্মির নিয়ে আলোচনা করি।
বৃটিশরা ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দু’টি ভাগে ভাগ করে দেবার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করলো।
 
অবশ্য তাদের ‘উপনিবেশ’গুলিকে স্বাধীনতা দেয়া ছাড়া বৃটেনের কাছে অন্য কোন উপায়ও ছিল না; আমেরিকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেবার একমাত্র শর্তই ছিল বিশ্বময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বৃটিশ উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা দিতে হবে।
 
বৃটেন পরাজিত হবার ভয়ে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে আমেরিকাকে নাকে খত দিয়েই তাদের পক্ষে যোগ দিতে অনুরোধ করে।
 
সে যাই হোক, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র নেতৃত্বে মুসলিমদের নিয়ে পাকিস্তান আর মহাত্মা গান্ধি, জহরলাল নেহেরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং সরদারজি প্যাটেল এই চারজনের নেতৃত্বে হিন্দুস্তান গঠিত হবে হিন্দুদের নিয়ে।
 
আসলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের চিন্তাতে ‘পাকিস্তান’ ছিল শুধুই বর্তমান পাকিস্তান ভুখন্ডকে নিয়ে। কিন্তু ‘বেঙ্গল প্রভিন্সের’ মুসলিম নেতারাও পাকিস্তানের পক্ষে আন্দোলনে নামায় হিসাব এলোমেলো হয়ে উঠে। ওদিকে পাঞ্জাব নিয়ে ঠিক একই সমস্যা দেখা দেয়। মুসলিম পাঞ্জাবীরাও পাকিস্তানে যোগ দিতে দাবী তোলে।
 
পাঞ্জাব ও বেঙ্গল এর কিছু নেতাদের আর্জিতে বৃটিশরা তখন এও চিন্তা করে শুধুমাত্র পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান নয়; পাশাপাশি বেঙ্গল ও পাঞ্জাবকেও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষনা দেয়া হবে; অর্থাৎ দু’টি নয় ৪টি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে ভারত-বর্ষ ভেংগে। পাকিস্তান, হিন্দুস্তান, বেঙ্গল ও পাঞ্জাব।
 
কিন্তু তৎসময়ে বিশ্বটাউট হিসাবে পরিচিত ছিল সর্দারজি বল্লবভাই প্যাটেল। প্যাটেল এতে বেঁকে বসেন। (মনে রাখবেন এই সরদারজি পাটেল এর অনুসারী আজকের সন্ত্রাসী নরেন্দ্র মোদী। সর্বশেষ অটল বিহারী বাজপেয়ী পর্যন্ত বিজেপি’র নেতারা ততটা সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না; কিন্তু বর্তমান বিজেপি সম্পূর্ণ উগ্র-হিন্দুত্ববাদ ও সন্ত্রাসবাদের দিক্ষা নিয়েই চলছে।)
 
সেই প্যাটেল বেঁকে বসাতে বৃটিশরা আর ৪টি রাষ্ট্র গড়তে পারেননি।
সর্দারজি প্যাটেল বৃটিশদের বলে দেন- হয় সম্পূর্ণ বেঙ্গল এবং সম্পূর্ণ পাঞ্জাব পাকিস্তানে ঢুকবে বা হিন্দুস্তানে ঢুকবে নয়তো বা বেঙ্গল ও পাঞ্জাব দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একভাগ পাকিস্তানে অন্যভাগ হিন্দুস্তানে ঢুকবে। আলাদাভাবে স্বাধীন ‘বেঙ্গল’ বা স্বাধীন ‘পাঞ্জাব’ হতে পারবে না। বৃটিশরা ঝামেলা কমাতে সর্দারজি প্যাটেলের সিদ্ধান্তে মত দেন।
 
ফলে ভেংগে যায় বেঙ্গল; ভেংগে যায় পাঞ্জাব। একভাগ ইষ্ট বেঙ্গল ঢুকে পাকিস্তানে, ওয়েষ্ট বেঙ্গল হয়ে যায় হিন্দুস্তান।
 
আর পাঞ্জাবও দু’ভাবে বিভক্ত হয়ে এক পাঞ্জাব যায় পাকিস্তান; অপরটি রয়েছে ভারতে।
 
একক বেঙ্গল বা একক পাঞ্জাব আর টিকে না।
 
বলছিলাম কাশ্মির নিয়ে।
কাশ্মিরের সংগে আরও কয়েকটি রাজ্যও তখন ছিল যাদের পরিণতিও ভারতের সন্ত্রাসী হাতের স্বীকার হতে হয়েছে পরবর্তীতে।
 
আমরা জানি বৃটিশরা পুরো ভারতবর্ষকে দখল করে ২০০ বছর শাসন করেছে। কিন্তু ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন একের পর এক ভারতীয় রাজ্যগুলি দখল করতে ছিল তখন বেশীরভাগ মুসলিম রাজারা ইংরেজদের সংগে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন; ব্যতিক্রমও আছে আবার বেশীরভাগ হিন্দু রাজারা বৃটিশদের কাছে আগে নতি স্বীকার করে নেয়; এরও ব্যতিক্রম ছিল।
 
যাই হোক, ‘নেজামে হায়দ্রাবাদ’ এবং ‘জম্মু ও কাশ্মির’ রাজ্যদু’টিও বৃটিশদের কাছে আত্মসমপর্ণ করে তাদের শাসনকর্তা হিসাবে মেনে নেয়। নেজামে হায়দ্রাবাদ এর রাজা ছিলেন মুসলিম এবং নেজামে হায়দ্রাবাদ রাজ্যটিও ছিল মুসলিম প্রধান। অপরদিকে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যটির রাজা ছিলেন হিন্দু কিন্তু এই রাজ্যটিও মুসলিম প্রধান।
 
আগেই পদানত হবার পুরুস্কার স্বরূপ বৃটিশরা পুরো ভারতবর্ষ শাসন করলেও নেজামে হায়দ্রাবাদ, জম্মু ও কাশ্মির, সিকিম ইত্যাদি রাজ্যগুলিকে প্রথম থেকেই স্বাধীনতা দিয়ে রাজাদের রাজত্ব করার সুযোগ রেখেদিয়েছিল। এরা তখনও মুলত স্বাধীন রাজ্য ছিল। বৃটিশরা এদের শাসন করতো না- সহযোগীতা করতো। এখানকার রাজারাও বৃটিশদের তোষামদী করে ক্ষমতা দখলে রাখতো।
 
বৃটিশরা যখন হিন্দুস্তান-পাকিস্তান ভাগ করে দিয়ে যায়; তখন তারা এই স্বাধীন রাজ্যগুলিকেও বলতে গেলে স্বাধীনতা দিয়ে যায়।
 
কিন্তু ‘হিন্দুস্তান’ সেটা মেনে নেয়নি।
হিন্দুস্তান বা ভারত প্রথম থেকেই জবরদখল করাকেই তাদের আদর্শ হিসাবে গ্রহন করে। এক ঝটকায় তারা সৈন্য পাঠিয়ে দখল করে নেয় মুসলিম প্রধান নেজামে হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি।
 
জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যটির রাজা হিন্দু হওয়াতে- তাকে ছলে বলে কৌশলে ভারতের সংগে একীভূত হবার প্রস্তাব দেয়।
 
কিন্তু মহারাজা হরি সিং ছিলেন প্রচন্ড জনপ্রিয় ও বুদ্ধিমান শাসক; মুসলিমদের কাছেও তিনি সমান জনপ্রিয় ছিলেন।
 
মহারাজা হরি সিং, পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান সকলে মিলে জাতিসংঘের স্মরণাপন্ন হয় এবং জাতিসংঘের তত্বাবধানে জম্মু ও কাশ্মিরে একটা গণভোট করে সেই ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবার ফয়সালা হয় যে জম্মু ও কাশ্মির স্বাধীন থাকবে অথবা পাকিস্তানে একীভূত হবে অথবা হিন্দুস্তানে যোগ দিবে।
 
তিনি বুঝতে পারছিলেন তার পক্ষে হয়তো ‘স্বাধীন’ রাজ্য হিসাবে টিকে থাকা কষ্টকর হবে। এর মধ্যে ভারত সরকার একটা চাল চালে, তারা মহারাজা হরি সিংকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানায় এবং দিল্লি পৌছা মাত্র তাকে আটক করে ফেলে। কিন্তু বুদ্ধিমান রাজা ভারতের সংগে একীভূত হবার বদলে ভারতকে কিছু শর্ত দেন- এবং ঐ শর্তগুলিই ছিল মুলত আলোচিত ‘৩৭০ ধারা’। যেখানে তিনি তার রাজ্যকে স্বাধীন রেখেই ‘৩৭০ ধারা’ মতে ভারতে যোগ দিতে বাধ্য হন।
 
কিন্তু পাকিস্তান যখন জানতে পারে যে- মহারাজা হরি সিংকে নয়া দিল্লী আটক করেছে এবং জোর করে জম্মু ও কাশ্মির লিখে নিচ্ছে তখনই কাল বিলম্ব না করে পাকিস্তান জম্মু ও কাশ্মিরে তাদের সৈন্য পাঠিয়ে বর্তমান আজাদ কাশ্মির পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয়। অপরদিকে বাদবাকী অংশে ভারত তার সৈন্য পাঠিয়ে দখলদারিত্ব বজায় রাখে। ওদিকে চায়নাও পাকিস্তানের সহযোগীতায় কিছু অংশ ‘আকসাই কাশ্মির’ নিজ দখলে নেয়।
 
সেই থেকেই বর্তমান জুম্ম ও কাশ্মিরের সমস্যা জিইয়ে রয়েছে।
আর এবার সরদারজী প্যাটেল এর উত্তরসূরী নরেন্দ্র মোদী সেই কাশ্মিরের চুক্তিবদ্ধ হবার ‘৩৭০’ ধারা বাতিল করে সেখানে সৈন্য পাঠিয়ে তাদের দখলদারিত্ব বজায় রাখার চেষ্টারত।
 
বলছিলাম, হিন্দুস্তান ‘৩৭০ ধারা’র মাধ্যমে বিবাহের ষ্টাইলে ‘জম্মু ও কাশ্মির’কে ভোগ করেছে এতকাল।
 
কিন্তু ‘ডিভোর্স’ ষ্টাইলে একতরফা সেই ‘৩৭০ ধারা’ বাতিল করলে হিসাবমতে ‘জম্মু ও কাশ্মির’ তার পূর্বের হিসাবে অর্থাৎ স্বাধীন (‘মিস’) হয়ে যাবার কথা; ভারত-ভূক্ত হবার কথা নয় কোন যুক্তিতেই।
 
বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষিত গাধা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোনেম যদি ‘সুশিক্ষিত’ হতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ হওয়া চলে কিন্তু ‘স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক এটাকে বলে না; আর যদি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের উদাহরণ টানতেই হয়- তবে, সেটা ছিল ‘ভারত – জম্মু ও কাশ্মির’ এর সম্পর্ক যে সম্পর্কের কাবিননামা হলো ‘৩৭০-ধারা’।
 
কিন্তু এসব সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত-বেকুবদের ‘এসব’ কে বোঝাবে? কার এতটা সময় রয়েছে বা দায় ঠেকেছে!
 
সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিন্দুস্তান ডিভোর্স করেও জোরপূর্বক এখন ‘জম্মু ও কাশ্মির’কে জবরদখল করে রাখতে চাইছে।
 
হিন্দুস্তান রাষ্ট্রটাই এমন।
ওয়েষ্ট বেঙ্গলকে বাংলা ভুলিয়ে দিয়েছে।
সিকিমকে হজম করে বসে রয়েছে।
আসাম থেকে বাঙালীদের ধরে ধরে বের করে দিচ্ছে।
হায়দ্রাবাদকেও হজম করেছে।
পুর্তগীজদের ছেড়ে দেয়া ‘গোয়া’কেও খেয়ে দিয়েছে।
 
এতো এতো অন্যায়-জুলুমকারী হিন্দুস্তান এতটা জটিল ও জবরদখলকরা মানচিত্র নিয়ে আর কতকাল টিকতে পারবে?
 
আমার মনে হয় না ‘হিন্দুস্তান’ টিকে থাকবে আরও বহুকাল।
ভারতবর্ষ ভেংগে কম করে হলেও গোটা ৩০শেক নতুন দেশ তৈরী হোক; হবেই ইনশাল্লাহ।
   Send article as PDF