ঐক্যবদ্ধতার অভাব

জাপানে রমজানের প্রথম রোজা’র অর্ধেকটা পার হয়েছে- আর ঘন্টা কয়েক পরই সেখানকার রোজাদারগণ তাদের ইফতার করবেন।
 
আমেরিকায়, আমার এখানে আর কিছুক্ষন পরই সেহারীর সময় শেষ হয়ে প্রথম রোজা শুরু হবে।
 
জাপান এই পৃথিবীর সর্ব পুবের দেশ অার আমেরিকা হচ্ছে সর্ব পশ্চিমের দেশ।
 
এই পূর্ব-পশ্চিমের ঠিক মাঝ বরাবর দেশগুলিকে বলা হয় ‘মধ্যপ্রাচ্য’। ওখানে সৌদী আরাবিয়াসহ অন্যান্য আরাবিয়ান দেশগুলি অবস্থিত। তারাও আজ থেকে রমজান মাস গননা করছে। মুলত মধ্যপ্রাচ্যের আরাবিয়ান দেশগুলির সংগে হিসাব মিলিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবেই পূর্ব-পশ্চিমের দেশগুলোও তা অনুসরণ করে থাকে।
 
সে যাই-ই হোক, পূর্ব পশ্চিম আর মধ্যপ্রাচ্য সবগুলি দেশ একযোগে রমজান শুরু করলেও মধ্যিখান থেকে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মতো দেশগুলি তাদের ‘নিজস্ব ভূখন্ডে চাঁদ দেখে’ তারপরই রমজান শুরু করে থাকে।
 
এই কয়েকটা দেশ বাদ দিলে পুরো পৃথিবীতে একক ক্যালেন্ডারেই আরবী-মাস গণনা হয়ে থাকে।
 
এই বিষয়টা নিয়ে আমার একটা পুর্ণাঙ্গ আর্টিকেল রয়েছে যেটা গেল বছর রোজার ঈদের আগের দিন প্রকাশ করেছিলাম, আমার ওয়েব সাইটে গেলে যে কেউ পড়তে পারবেন। (http://taufiqulpius.com/archives/950)
 
এই বিষয়টা নিয়ে নয়- অন্য একটা বিষয় সামনে আনতে চাচ্ছি।
আজ ‘নষ্ট হয়ে যাওয়া লেখিকা’ তসলিমা নাসরিন একটা টুইট করে প্রশ্ন তুলেছেন যে, ‘রোজা সুর্যোদ্বয় ও সুর্যস্থ দেখে পালিত হয়; মুসলিমরা যখন আর্কটিক অঞ্চলে বসবাস করে তখন তারা কিভাবে রোজা পালন করে?’ এরপরই সে তাচ্ছিল্যভরে এড করেছে, ‘যে-ই রমজানের আইন তৈরী করেছে তার ভৌগলিক পৃথিবী নিয়ে কিছু বেসিক জ্ঞান থাকা দরকার ছিল’।
 
এই সেই তসলিমা নাসরিন যে কি না কিছুদিন পূর্বে ‘শিব লিংগ পুজা’ করে নিজেই আবার তার প্রশংসা করে সেটার ছবিও প্রচার করেছে। সে-সহ তার তার পিতা-মাতা-ভাইবোনরা শুনেছি মুসলিম বংশোদ্ভুত।
 
ড্যান গিবসন এর ডকুমেন্টরীটি যারা দেখেছেন তারা জানেন তিনি তত্ব, তথ্য, ভৌগলিক অবস্থান, যুক্তি ও গণিত দিয়ে হিসাবে করে ইসলামের কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করে দেখাবার চেষ্টা করেছেন রাসুল মুহম্মদ (সা) এর জন্মস্থান ‘মক্কা’ নয় বরং সেটা না কি ‘পেট্টা’য়।
 
আমি যুক্তির মানুষ।
কয়েক মাস পূর্বে আমি এক লাইনের একটা স্ট্যাটাস দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম ‘মক্কা নগরীতে কোন কোন এবং সর্বমোট কতজন সাহাবী’র কবর রয়েছে?’।
 
আমি খুবই দুঃখের সংগে জানাচ্ছি যে- কেউ তার উত্তর দিতে পারেননি। কেউ ‘মাত্র একজন’ সাহাবীর নামও জানাতে পারেননি- যিনি কিনা মক্কায় শায়িত রয়েছেন; অথচ হাজার হাজার সাহাবী ইসলামী ইতিহাসমতে মক্কায় বসবাস করেছেন, মারা গেছেন। তাহলে?
 
কথিত রয়েছে খাদিজা (রা) সহ আরও কয়েকজনের নাকি কবর মক্কায় ছিল কিন্তু কোন এক সৌদী রাজা নাকি সেসব কবর ধ্বংশ করে ফেলেছে! কিন্তু কেন?
 
খুবই সামান্য একটা বিষয় উপস্থাপন করি।
ড্যান গিবসন প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠাকালিন ১০০ বছর পর্যন্ত এই পৃথিবীতে যতগুলি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সবগুলির ‘কেবলা’ দিক ছিল পেট্টায় মুখ করে।
 
১০০ থেকে ১৫০ বছর পর্যন্ত কিছু মসজিদ মক্কায় এবং কিছু মসজিদ পেট্টার দিকে ছিল। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠিত সবগুলি মসজিদের কেবলা দিক তৈরী হতে থাকে মক্কার দিকে।
 
ড্যান গিবসন দেখিয়েছেন এজন্য মুসলিমদের ‘একতাবদ্ধ’ না থাকতে পারাটাই দায়ী।
 
এই পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকেরও বেশী একটা দীর্ঘ সময় ধরে মুসলিমরা শাসন করেছে। কিন্তু দুঃখজনক সত্যটি হলো সেই অর্ধেকটা বিশ্বের শাসক মুসলিমরা হলেও তারা শুরু থেকেই দু’টো ভাগে বিভক্ত ছিল; উমাইয়া ও আব্বাছিয়া। এই দুই দল নিজেদের ক্ষমতায় রাখতে পেট্টা ও মক্কা নিয়ে রাজনীতি করেছে।
 
আবার দেখা গেছে মুসলিম শাসন আমলেই তৎকালিন অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইসলামী বই-পত্র যার পরিমাণ লাখ লাখ কপি- তার সবগুলি বই মুসলিম শাসকের নির্দেশে আগুন দিয়ে পুরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
 
ড্যান গিবসন দেখিয়েছেন দীর্ঘকাল উমাইয়ারা (মুসলিম শাসক) ইউরোপের স্পেন শাসন করেছে এবং স্পেনে অনেক মসজিদ নির্মান করেছে। মজার বিষয়টা হচ্ছে তারা যেসব মসজিদ নির্মাণ করেছে সেগুলির কেবলা ‘মক্কা’র দিকে মুখ করে নেই। সেগুলি পেট্টার দিকেও মুখ করে নেই; রয়েছে অনেকটা দক্ষিন দিকে। গিবসন চমৎকার ভৌগলিক গণিত দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে মসজিদগুলি আসলে ‘পেট্টা ও মক্কা’র প্যারালাল একটা সরল-রেখায় মুখ করে রয়েছে।
 
এসব করে ড্যান গিবসন প্রমাণ দিতে চেয়েছেন যে, রাসুল মুহাম্মদ (সা) এর জন্মস্থান ও ইসলামের পবিত্র নগরী আসলে ‘মক্কা’ নয় বরং সেটা জর্ডানের ‘পেট্টা’য়।
 
এমনকি ড্যান গিবসন তার যুক্তির তালিকায় এটা প্রকাশের স্পর্ধা দেখিয়েছেন যে আব্বাছিয় শাসকরা পবিত্র কোরানে বাক্কার ‘বা’ কে একটু মাথা তুলে দিয়ে ‘মীম’ এ রূপান্তর করে ‘মক্কা’য় পরিণত করেছে।
 
চায়নার গুয়াংজু নগরীতে আমি অনেকবার ভ্রমণ করেছি। সেখানে অসংখ্য মুসলিম বসবাস করেন এবং গুয়াংজুতে একটা অতি প্রাচীন মসজিদও রয়েছে- বলা হয়ে থাকে রাসুল মুহাম্মদ (সা) এর জীবিত অবস্থায় তার এক চাচা গুয়াংজুতে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং ঐ মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ড্যান গিবসন হিসাব করে দেখিয়েছেন যে ওই মসজিদের কেবলাটা মক্কার দিকে নয় বরং পেট্টার দিকে মুখ করে স্থাপিত রয়েছে।
 
ড্যান গিবসন তার ডকুমেন্টারীটি প্রকাশ করার পর অনেক আবেগী মুসলিমকে দেখলাম তারাও তার প্রতিবাদে বেশ কিছু ভিডিও তৈরী করেছে গিবসনের কথার উত্তর দিতে। কিন্তু আমি যতগুলি ভিডিও দেখেছি- সবগুলিতে ড্যান গিবসনকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে, তাকে ইসলাম বিরোধী ইহুদী নাছারা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যুক্তি বাস্তবতার পক্ষে তারা একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। আমি আশাহত হয়েছি।
 
অথচ মুসলিমরা আজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে চায়নার গুয়াংজু বা স্পেন এ গিয়ে সেখানকার মসজিদগুলির কেবলা আসলেই কোন দিকে মুখ করা এবং কেন- সেই সত্যটুকু গবেষনা করে ড্যান গিবসনকে একটা যুৎসই উত্তর দেয়া সম্ভব ছিল। আজ আর উমাইয়া বা আব্বাছিয়াদের কেউই টিকে নেই। সুতরাং মুসলিমদের হারানোর কিন্তু কিছুই নেই।
 
স্পেনে অনেক মুসলিম বসবাস করছেন এখনও।
স্মার্ট ফোনের মক্কার দিক নির্দেশকারী অনেক এপস রয়েছে- তারাও কিন্তু ড্যান গিবসনের কথা সত্য না মিথ্যা সেটা চাইলেই নিমিষের মধ্যে প্রমাণ করে দিতে পারে।
 
সত্য ও বাস্তবতাকে প্রমাণ করা এবং স্বীকার করে নেয়া তো ইসলামেরই মতবাদ।
আজ আমেরিকা, ইউরোপ বা অষ্ট্রেলিয়া-কানাডায় গেলে আপনি দেখবেন সেসব দেশগুলিতে পরিপূর্ণ ‘ইসলামী আইন’ পালিত হচ্ছে। এসব দেশে গণমানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে, প্রতিটি মানুষকে সম্মান করার নিশ্চয়তা রয়েছে, মহিলাদের সম্মান দেয়া হচ্ছে। শ্রমিকের কাজের মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করা হয়েছে।
 
কিন্তু আপনি যদি আরাবিয়ান দেশগুলিতে যান তাহলে দেখবেন সবকিছুতেই রয়েছে শ্রেণীবাদ। বিভেদ সৃষ্টি হয়ে রয়েছে একদল মানুষকে ‘মিসকিন’ উপাধী দিয়ে। ইসলামী শাসনের বিন্দুমাত্র সেখানকার ইসলামী দেশগুলিতে খুঁজে পাওয়া কস্টকর শুধুমাত্র ‘ইসলাম’ নামটা ছাড়া। সৌদী আরব আজ অবৈধ ইহুদী ইসরেল এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র; সংগে কথিত মুসলিম আরব আমিরাতও।
 
আপনি দেখবেন বিশেষতঃ সাদারা তাদের নিজেদের কতটা ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে।
আজ এই পৃথিবীর কোন একটা সাদা দেশে কেউ হাত তোলার স্পর্ধা করে না। কারণ সকলেই জানে যে-কোন সাদা একটা দেশে বিপদে পরলে তার জন্য সর্বপ্রথম সামনে গিয়ে দাঁড়াবে আমেরিকা।
 
আর আপনি একটু গিয়ে ঘুরে আসুন ইরাক, আফগানিস্থান, সিরিয়া, লিবিয়া! একটু কস্ট করে উপলব্ধী করে আসুন কাশ্মির, ফিলিস্তিন; দেখতে পারেন এই বাংলাদেশও!
 
টানা ছয় মাস দিন, ছয় মাস রাত অঞ্চলে কিভাবে রোজা নামাজ আদায় করতে হবে সেটার ব্যাখ্যা অবশ্যই ইসলামী পন্ডিতগণদের উচিৎ বহুল প্রচার করে তসলিমা নাসরিনদের মতো নষ্টদের উপযুক্ত জবাব দিয়ে দেয়ার। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব পালন করছে কি?
 
তেল সম্পদে সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলি ইসলামী স্কলারদের নিয়ে একটা কমিটি তৈরী করে ড্যান গিবসনের ডকুমেন্টারীর উপযুক্ত জবাব অতি সহজেই দিয়ে দিতে পারে- কিন্তু তারাও নিরব।
 
পুবের জাপান বা অষ্ট্রেলিয়া, পশ্চিমের আমেরিকাস, মধ্যের আরবে একসংগে রোজা, ঈদ পালিত হয় কিন্তু এরই মাঝের কিছু দেশে কোত্থেকে একদিন পর রোজা বা ঈদ পালন করে সেটার ব্যাখ্যা দাবী করে তসলিমা নাসরিনরা যে ‘ট্রল’ করে না কেন- সেজন্য তাকে বরং ধন্যবাদই দেয়া যায়।
 
পারস্পারিক কনসিডারেশন না থাকা এবং ঐক্যবদ্ধ না হতে পারাটাই দেশে দেশে মুসলিমদের অধপতনজনিত সমস্যার একমাত্র কারণ।
   Send article as PDF