হিন্দুস্থানকে শ্রদ্ধা

বাংলাদেশে আমার’চে বেশী মনে হয় না অন্য কেউ ভারতকে অপছন্দ করে।
কিন্তু তারপরও আমি মাঝে মধ্যেই আমার কিছু কিছু লেখায় ভারতের উদাহারণ টেনে আনি। এটা অনেকেই পছন্দ করে উঠতে পারেন না।
 
আসলে আমি কোনদিনও কাউকে ‘খুশী” করার জন্য একটি লাইনও লিখিনি, লিখবোও না। বাট আমার লেখায় খুশী হওয়া মানুষদের সংখ্যা যথেষ্ঠ। আলহামদুলিল্লাহ।
 
আমার প্রতিটি লেখার জন্য আমি শুধুই আমার কাছে জবাবদিহি করি।
অন্য কারো কাছে নয়।
 
সম্প্রতি আমি আমার দু’টো লেখাতে ভারতবর্ষের কয়েকটা বিষয়ের উপর প্রশংসা করায় আমার কিছু ফেসবুক ফ্রেন্ড তাদের জোরালো দ্বিমত প্রকাশ করেছেন।
 
অবশ্য যদিও আমার বক্তব্যের পজেটিভ মন্তব্যই আমি বেশী পেয়েছি। কিন্তু তারপরও অনেকেই বিরোধীতা করেছেন।
 
কয়েকজন যুক্তি দেবারও চেষ্টা করেছেন। যারা যুক্তি দেবার চেষ্টা করেছেন- তাদেরটা ভুল যুক্তি হতে পারে- তবুও তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
 
কিন্তু, আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড বা ফলোয়ার নন এমন একজন আমাকে ‘শাহবাগী’ বলতেও দ্বিধা করেননি।
 
কাউকে কাউকে দেখেছি যাষ্ট আমার একটা লেখা পড়েই- আমাকে ‘জামাত’ ট্যাগ লাগিয়ে দিতে। পুলিশ লীগের ডিআইজি ইতিমধ্যেই আমাকে ‘বিশেষ গোত্রের’ বলে ফেলেছে।
 
এতো মেধাবী আমরা?
একটা লাইন পড়েই আমরা মানুষ চিনে ফেলি। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই!
 
বাংলাদেশ ভর্তি তো দেখি শুধু মেধা আর মেধা। সব ‘জিপিএ পাইপ’!
 
আসলে আমি আমার নিজস্ব কিছু তত্ত্ব মেনে চলি; তার মধ্যে অন্যতম একটা হলো- কারো বিরোধীতা করতে চাইলে তার সম্পর্কে আগে যথেষ্ঠ পরিমাণ স্ট্যাডী করতে হবে। আমার এই তত্ত্বটা মেনে চলা খুবই কষ্টকর। এমনকি সময়সাপেক্ষও বটে।
 
তারপরও আমি এটা করি।
কারো সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে- তার বিরুদ্ধে কোন কুটুক্তি করা- আমার চিন্তারও বাইরে।
 
আমার বিরুদ্ধে মন্তব্য করা ভদ্রলোক আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না, উনি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড নন এমনকি ফলোয়ারও নন। হয়তো আমার শুধুমাত্র গতকালের লেখাটিই উনি পড়েছেন। সামান্য ওই দু’টি লাইন পড়েই তিনি আমাকে ‘শাহবাগী’ অপবাদ দিয়ে দিলেন।
 
না, আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি কিন্তু অতটা হীনমন্যতায় এখনও ভুগছি না যে তার লেখার জবাব দিতে এই আর্টিক্যালটি লিখছি অথবা ওনার মন্তব্যে আমি কষ্ট পেয়েছি। আসলে আমি ভিন্ন কিছু কথা বলতে চাচ্ছি। আমাকে পেছন থেকে আমার সম্পর্কে না জেনে কে কি বলল- সেটা নিয়ে ভেবে আমি কোনদিন এক ন্যানো সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করিনি।
 
আজ থেকে অনেক বছর আগে, সম্ভবত সিএনএন টিভিতে তসলিমা নাসরিন এর একটা ইন্টারভিও দেখেছিলাম।
 
এক হাতে পবিত্র কোরান শরীফ অত্যন্ত তাচ্ছিলের সাথে ধরে এবং অন্য হাতে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কথা বলছিলেন সেই তসলিমা নাসরিন।আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, তসলিমা নাসরিন জীবনেও কোনদিন কোরান শরীফের একটা আয়াতও পড়ে দেখেননি।
যদি পড়তেনই- তাহলে তিনি ঐভাবে পবিত্র কোরাণ শরীফ ধরতে পারতেন না। পারা সম্ভব নয়।
 
ডা. মরসি বুকাইলীর (Maurice Bucaille) কথা মনে আছে। ফরাসী এই ভদ্রলোক পবিত্র এই কোরাণ শরীফকে কিভাবে দেখেছেন? তসলিমা নাসরিন কি ডা. মরিস বুকাইলির বাম পায়ের কানি আঙ্গুলের খোচায় উড়ে যাওয়া ধুলির সমান যোগ্যতা রাখেন?
 
ডা. মরিস বুকইলির যাষ্ট দু’টো বক্তব্য দেখুন:
The Quran is in agreement with scientific facts, while the Bible is not.
Science and religion have always been “twin sisters”.
 
ডা. মরিস বুকইলি পবিত্র কোরাণ পড়েছিলেন- কোরানকে ভুল বা বাতিল প্রমাণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে। কাউকে অপমান করতে হলে- তাকে স্ট্যাডী করতে হয় প্রপারলী। ডা. মরিস বুকাইলির মতো করে।
 
আমি কিন্তু ঢাকায় বসে চোখ বন্ধ করে আর দু’একজন বন্ধুর কাছে গল্প শুনে কোন কিছু লিখি না- ওটা আমার স্বভাব বহির্ভুত।
 
আমি প্রায় দুই শতাধিকবার ভারত-বর্ষ ভ্রমণ করেছি ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ এই আঠারো বছরে।
 
ভারতের সাউথ ব্লক-কে আমি ঘৃণা করি মন-প্রাণ দিয়ে। নতুন দিল্লীর সচিবালয়ের ‘সাউথ ব্লক’ নিয়ন্ত্রণ করে সাউথ এশিয়ার রাজনীতির গতিপথ। ঐ সাউথ ব্লক এর নেতৃত্বেই হাসিনার অবৈধ সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন।
 
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জন্মের পর থেকেই ভারত চেয়েছে ‘বাংলাদেশ’কে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে- কিন্তু বরাবরই বার্থ হয়েছিল বলতে হবে। সত্যি বলতে ২০০৬ এর আগে কোনদিন ভারত- বাংলাদেশে তার প্রভুত্ব ফলাতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি ঠিকই কিন্তু সফলতা সেভাবে পায়নি। কিন্তু ২০০৬ সালের পর শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাবার জন্য বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ সমভাবে ভারতের তাবেদারী করেছে, সহায়তা চেয়েছে। আওয়ামী লীগ সফল হয়েছে- বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে।
 
বিএনপির ব্যারিষ্টার মওদূদ আহমেদকে ভারত একসময় ভারত বিরোধীতার জন্য ‘ইন্ডিয়ান টুরিষ্ট ভিসা’ও দিত না। সেই মওদূদ গতবছর দিল্লী যেয়ে করুণা ভিক্ষা করে আসলেন বিএনপির জন্য।এখন ব্যারিষ্টার মওদূদও ভিসা পান।
 
আপনি যদি কাউকে সুযোগ দেন- সে তো সুযোগ নিবেই।
 
কে সুযোগ নিতে না চায়?
 
আওয়ামী লীগ ভারতকে বেশী ম্যানেজ করতে পেরেছে বলে ‘ভারত’ খারাপ!
বিএনপি কি ভারত কে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে না?
ভারত বিএনপি কে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই ভারত ভালো হয়ে যাবে?
 
হাফিজ ভাইয়ের টাইম লাইনে মন্তব্য করা মুহাম্মেদ মাছরুর আর তসলিমা নাসরিন এই দু’জনের ‘চিন্তা করার কৌশল’ এর কি আদৌ কোন পাথ্যর্ক রয়েছে? অথবা বাংলাদেশের চেতনাজীবিদের মধ্যে?
 
তর্ক করা খুবই ভালো- যদি সেটা যুক্তির তর্ক হয়।
কিন্তু মানুষ যখন যুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়- তখন গালাগালি প্রয়োগ করে।
 
তারেক রহমান লন্ডনে বসে যখন জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষনা দিলেন- তখন তোফায়েল আহমেদদের দেখতে পেয়েছিলাম তার বিপক্ষে কোন-রকম যুক্তি না দিয়ে ষ্ট্রেইট গালা-গালি শুরু করে দিলেন।
 
কেন?
আমরা যুক্তিতেও যাবো না, উল্টো গালাগালি করবো- কোন যুক্তিতে?
 
যুক্তির প্রয়োগ করতে হলে আপনাকে জানতে হবে বেশী বেশী, ঘুরতে হবে বিশ্বময়।
 
ঘড় থেকে চলুন বের হই।
একটু ঘুরে আসি।
 
এই ধরুন চিটাগাং, রাঙামাটি, মৌলভী বাজার। চলুন দেখে আসি।
এরপর আবার চলুন কোলকাতা, আগরতলা, গৌহাটি।
 
মৌলভী বাজারের ঠিক অপর পারে ভারতের আসামের একটা গ্রাম পানি সাগর।
চলুন পানি সাগরই যাই।
 
পানি সাগরে গেলে দেখতে পাবেন ওরাও ছোট্ট গ্রামীন রেষ্টুরেন্টে মৌলভী বাজারের মতোই ‘লবন ছাড়া খিচুরী’ খাচ্ছে, হাই ভলিউমে মমতাজের গান শুনছে।সীমানা বাউন্ডারী ঠিকই হয়েছে কিন্তু মানুষগুলি সব একই আছে।
 
এই পৃথিবীটা অনেক বড়।
পশ্চিমে একটা প্রবাদ চালূ আছে, যে পুরো ভারত বর্ষ ঘুড়ে দেখেছে তার আর বাকী বিশ্ব দেখার কোনও প্রয়োজন নেই।
 
জয়পুর যান, পুনে যান, উদয়পুর, আগ্রা, লখনৌ যান।
নৈনিতাল যান। সিমলা যান। সেখানেও দেখবেন স্নো পরে- আমেরিকা-ইওরোপের মতোই। জম্মু-কাশ্মিরও যেতে পারেন।
স্নোর সংগে ছবি তুলুন। এই শীতেই যান।
 
ওখানকার মানুষদের সভ্যতা দেখে আসুন। হিন্দুস্থানীরা বিদেশীদের সংগে কেমন ব্যবহার করে শিখে আসুন।
কোলকাতা গিয়ে পুরো ভারত-বর্ষ বুঝে ফেললে তো অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে- সেটা বুঝেন?
 
করাচী, ইসলামাবাদ যেতে বলতাম কিন্তু পাকিস্তান তো আপনাকে ভিসাই দেবে না।
তারচে না হয় মালে, কলম্বো, কাঠমান্ডু, ব্যাংকক ঘুরুন।
 
ঢাকায় বসে দূরবীন লাগিয়ে আর তসলিমা নাসরিনের মতো শিক্ষা নিয়ে উদ্ভট সব কথা বলা সম্ভব- সেগুলি দিয়ে জার্মানী সুইডেন-এ শেল্টারও পাওয়া যাবে- কিন্তু তারপর? সেই থালা-বাটিই মাঝতে হবে বাকী জীবন ঐ বিদেশ বিভূঁয়ে।
 
কয়েকজনকে লক্ষ্য করলাম দিল্লীকে বলছে ‘ধর্ষনের রাজধানী’।
তা বেশ ভালোই তো। আপনারা ঢাকায় বসে রয়েছেন কেন? আপনারাতো ধর্ষন করতে পারেন না শুধু ইভ টিজিং করেন- গাড়ীতে, মার্কেটে, স্কুলের সামনে অথবা রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে। তারচে বরং ভালো একটু দিল্লী চলে যান- গিয়ে গণহারে কিছুদিন ধর্ষন করে আসুন।
 
তবে খেয়াল রাখবেন- ওখানে গিয়ে মেয়েদের দিকে তাকানোর সময় আপনার চোখ ঠিক থাকে কি না।
নিজের পাছার ময়লা পরিষ্কার না করে, ঢাকায় বসে কয়েকটা পেপারে দু’চারটা নিউজ পড়েই নিজেকে সর্বজান্তা ভাবনাটা কিন্তু সুন্দর না।
 
বিশাল ভারতবর্ষ আর তার সাউথ ব্লক এক কথা না।
 
ভারত কে অপছন্দ করি ঠিকই তবে, ভারতকে আমি শ্রদ্ধা করি তারচেও অনেক গুন বেশী।
 
শ্রদ্ধা পাবার মতো যোগ্যতা ভারত ইতিমধ্যেই অর্জনও করেছে।
 
শেষটায় ভারতকে কেন আমি শ্রদ্ধা করি তার স্বপক্ষে আরেকটু বিশদ সংযুক্ত করলাম।
প্রথমেই যেটা বলা দরকার, ভারতকে আমি তুলনায় নিয়েছে সার্কভুক্তি দেশগুলির সংগে; অবশ্যই ইওরোপ-আমেরিকার সংগে নয়। এমনকি চায়নার থেকে ভারত শত বৎসর পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু তারপরও ভারতের কিছু ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে- যেটাই আমি বোঝাতে চেয়েছি। এবং সেক্ষেত্রে ভারতকে আমি অবশ্যই শ্রদ্ধা করি।
 
ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা শুধুমাত্র ভারতবর্ষই নয় পুরো এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যেই গর্ব করার মতো। আমি সিংগাপুর বা মধ্যপ্রাচ্যের রাজেদের তেল-বেচা দেশের সংগে তুলনায় নিবো না। কিন্তু আপনি হয়তো জেনে অবাক হবেন পুরো মধ্য এশিয়ার রোগীরা চিকিৎসার জন্য প্রথম পছন্দ হিসাবে বেছে নেয় ভারতকে। তারপর তুরষ্ক এবং রাশিয়াকে। অথচ রাশানদের দুর্ণাম রয়েছে যে ওরা রাশান ছাড়া অন্যদের চিকিৎসায়ও ‘বর্ণবাদী’ আচরণ করে- যেটা ভারত করে না। তুরষ্কর চিকিৎসা ব্যয়বহুল।
ভারতের চিকিৎসা সেবা বিশ্বমানের এবং খুবই অল্প খরচে সেখানে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসর জন্য প্রথম পছন্দ ভারতবর্ষ, দ্বিতীয় থাইল্যান্ড। ভারতের সরকারী হসপিটালগুলিতে বিদেশীদের নামমাত্র মূল্যে (১ রুপি) এডমিশন দেয়া হয়ে থাকে।
 
বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা এখনও সেই কবিরাজী বা ওঝা পর্যায়কালই অতিক্রম করে উঠতে পারেনি।
 
ভারতবর্ষ না থাকলে বাংলাদেশের মানুষকে যে কি পরিমাণ বিপদে পরতে হতো- চিকিৎসার জন্য, সেটা ভাবাও যায় না। এমনকি ভারতীয় রেল কতৃপক্ষ বাংলাদেশের ক্যান্সার রোগীদের কাছ থেকে ভারতবর্ষের যে-কোথাও ভ্রমনের ক্ষেত্রে কোন টিকিট মূল্য রাখে না।
 
ভারতীয় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিশ্বমানের কিন্তু অত্যন্ত চিফ। ভারতীয় প্রশাসন বাংলাদেশ বা মালয়েশিয়ার মতো ঘুষখোর বা করাপ্টেড নয়। পুলিশ বাহিনী বা বিচার বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর পকটে থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় না।
 
ভারতীয়দের জিডিপি তাদের স্বচ্ছল ও সৎ জীবন যাপনে সহায়তা করছে। মানুষ ব্যবসা করে সুখে রয়েছে। চাাঁদাবাজী নেই। সরকার, পরিবেশ ব্যবসায়ীদের প্রচুর সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে।
 
ভারতীয় আরো অনেক বিষয়ই আমি জানি- যা লিখলে আরেকটা বড় আর্টিকেল তৈরী হয়ে যাবে।
 
আমি শুধু আপনাকে অনুরোধ করবো- পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সংগে ভারতবর্ষকে তুলনা করুন।
 
তারপর চোখ বন্ধ করে ভাবুন ‘শ্রদ্ধা’ আসে কি না?
   Send article as PDF