টাং হাও

সিড়িগুলি বাংলাদেশের ৩টি’র সমান এককেটা উচুঁ।
ছোট বেলা থেকেই আমি খুব ভালো হাঁটতে পারি এবং হেঁটে এক ধরণের আনন্দ পাই; এবং এখনও। সেই হিসাবেও যদি ধরি- তারপরও ৩টির সমান মাপের একটি সিড়ি নিঃসন্দেহে অনেক বড়। তবুও আমি উঠছি। উঠেই যাচ্ছি। ঘেমে অবস্থা সত্যিই খারাপ। জোরে জোরে লম্বা করে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি। আমি জানি জোরে দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস ক্লান্তি কমায় এবং শরীরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করে। ঘড়ি ধরে প্রায় ঘন্টা দেড়েক হেঁটে বিশাল বিশাল সিড়ি ভেংগে উপরে উঠেই যাচ্ছি। শেষ আর হয় না।
উঠেই যাচ্ছি। টি-শার্টটি খুলে ফেললাম। কোমড়ে বেধে নিলাম- স্কুলের পিচ্চি মেয়েরা যেভাবে হালকা শীরে বাসায় ফেরার সময় গাঁয়ের সোয়েটারটা কোমরে বেঁধে নয়; ঠিক সেভাবেই। কোমড়ে কিছু শক্ত করে বাধা থাকলে মানুষ কাজের শক্তি পায় বলেও জানি। শরীরও জুড়াবে- শক্তিও পাবো।
 
আরও হাঁটছি। আমার সংগে রইসও Rais Hasan পেছন পেছন আসছে। এই রইসটা হলো বর্তমানে মালয়েশিয়া কুয়ালা লামপুরের বাংলাদেশ হাই কমিশনের বড়কর্তা রাইস হাসান সরওয়ার, ততদিনে আমার ভালো বন্ধু হিসাবে পরিণত হয়েছে।
কিছুদুর উপরে উঠার পর একটু ছোট উম্মুক্ত কিন্তু ছাদওয়ালা বিশ্রামের মতো স্থান রয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন রোদের তাপ থেকে বাঁচা যায় এবং রেষ্ট নিয়ে শক্তিও সঞ্চয় করা যায়। আমিও তাই-ই করে করে উপরে উঠে যাচ্ছি।
 
একটু রেষ্টের জন্য এবারের বিশ্রামের স্থানে পৌছে দেখি ৩টি চায়নিজ মেয়েও দাড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমাকে দেখেই একজন বলে উঠলো ‘নি-হাও’। আমিও ‘নি-হাও’ বলে সাড়া দিলার ওর কথার। সংগে যোগ করালাম ‘ডু ইও আন্ডারষ্ট্যান্ড ইংলিশ?’ মেয়েগুলি না-সূচক মাথা ঝাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘নো-নো-নো ইংগলিশ’। আমি হেসে দিলাম। এদের সবচে সুন্দরী মেয়েটার গায়ে একটা সাদা টি-শার্ট এবং ঠিক বুকের উপল লাল কালিতে লেখা ‘সি বাট ডন্ট টাস’। আমি হেঁসে দিলাম একটু জোরেই। ওই মেয়েটিও হেসে দিল আমার চেয়েও উচ্চস্বরে। আমার দিকে হাত বাড়েয়ে দিল আমি হ্যান্ডসেক করলাম; বাকী দু’টির সাথেও। সেই মেয়েটিই আমাকে প্রশ্নসূচক স্বরে বলল ‘মাঞ্জালামা?’। আমিও মাথা ঝাকালাম হ্যাঁ সূচক ভংগেতে ‘মাঞ্জালা’। মানেটা হলো- হ্যাাঁ আমি বাংলাদেশী।
 
আমি সত্যিই জানি না- ঠিক কি কারণে চায়নিজ মেয়েরা বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানী ছেলেদের অসম্ভব পছন্দ করে। আমি যতবার চায়নায় গিয়েছি ততবারই অসংখ্য মেয়েকে আমার পেছনে ছুটতে দেখেছি। অনেক মেয়ের কিঞ্চিত ইভ-টিজিং (শব্দটা প্রযোজ্য কিনা জানি না!) এর আনন্দও পেয়েছি! আমার অনেক বন্ধু চায়নিজ মেয়েকে বিয়ে করে সেদেশে স্থায়ী হয়েছে এবং অনেক সুখে আছে।
 
চায়নিজ মেয়েরা স্ত্রী হিসাবে অত্যন্ত সৎ এবং ভাল হয়ে থাকে। একটা প্রবাদ রয়েছে- ‘তুমি যদি আমেরিকান ডলারে বেতন পাও, লন্ডন শহরে তোমার একটা বাড়ী থাকে, চায়নিজ কোন মেয়ে যদি তোমার স্ত্রী হয় এবং তিন বেলা তুমি যদি সিচুয়ান ফুড খেতে পারো- তাহলে তুমি এই পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষ’। জাপানী মেয়েরাও একইরকম বলে জানি। আর সিচুয়ান ফুড আমি খেয়েছি- সত্যিই অসাধারণ। সিচুয়ান হলো চায়নার একটা প্রফিন্সের নাম যার রাজধানী চেংদু। চেংদুতে আমি ৩দিন ভ্রমণ করেছি এবং সেখানকার খাবারই হলো বিখ্যাত সিচুয়ান ফুড। ঢাকা শহরেও কিছু তথাকথিত চায়নিজ রেষ্টুরেন্টে ভুল বানানে ‘সিচুয়ান’ কথাটি লেখা দেখা যায়।
 
মুল কথা থেকে দূরে সরে গেছি। ফিরে আসি।
যাই হোক আরও প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পর যখন ভাবলাম আর না। ঠিক তখনই দেখতে পেলাম খালিদ স্যার (যুব মন্ত্রণালয়ের তৎকালিন যুগ্ন-সচিব) আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনিও খালি গায়ে। আর আমার আরও পেছনে দেখতে পেলাম রাইসও খালি গায়ে উঠছে।
আমরা তিনজন অনেক অনেক উপরে পৌছে গেলাম।
 
খালিদ স্যার একটা অতি চমৎকার ঘটনা শেয়ার করলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সম্ভবত ১৯৮০ সালের দিকে চায়না সফর করেছিলেন। তিনি এসেছিলেন এই গ্রেট ওয়াল দেখতে। সেসময় প্রেসিডেন্ট জিয়া তার এসকর্টকে পেছনে ফেলে অনেক উপরে উঠে দিয়েছিলেন। এসকর্টরা নাকি রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন- প্রেসিডেন্ট কোথায় হারিয়ে গেলেন! খালিদ স্যারের ধারণা প্রেসিডেন্ট জিয়া হয়তো আমাদের মতোই এখানে চলে এসেছিলেন। কি জানি হতেও পারে।
 
হ্যাঁ, এটা সেই বিখ্যাত চীনের প্রাচীরের কথা বলছি। দ্য গ্রেট ওয়াল। এর কিছুটা অংশ সিড়ি আবার কিছুটা অংশ সমতল এবং পাশে প্রায় ১১ ফুট। আজ থেকে ২৫০০ বছর আগের সর্বমোট ২১,১৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ চীনের প্রাচীর তৈরী শুরু হয়ে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত কাজ চলে। এটা মূলত একটা বিশাল প্রাচীর যার উপর দিয়ে যাতায়াত করা যায় এবং পাহাড়া দেয়ার কাজ চলতো। মঙ্গোলীয়ান দস্যুদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতেই এই প্রাচীর তৈরী হয়েছিল। চাঁদ থেকে এই পৃথিবীর এক মাত্র মানুষ নির্মিত এই চীনের কীর্তিটিই দৃশ্যমান।
 
রাজধানী বেইজিং থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরেই মূলত পর্যটকরা কয়েকটি পয়েন্টে গ্রেট ওয়াল পরিদর্শনের সুযোগ পায়। আমি ২০০৫ এবং ২০০৮ সালে দু’দিকের দু’টি পয়েন্টে গ্রেট ওয়াল পরিদর্শন করার সুযোগ পেয়েছি। অসাধারন।
 
চায়না বাংলাদেশকে স্বাধীন হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালে। তো, ২০০৫ সালে এসে এই স্বীকৃতি’র ৩০তম দিবস উপলক্ষে চাইনিজ গভর্ণমেন্ট ‘সিনো-বাংলা রিলেশনশীপ’ এর একটি অংশ হিসাবে বাংলাদেশ থেকে ২০জন ‘যুব কর্মী’কে রাষ্ট্রিয়ভাবে আমন্ত্রণ জানায়।
এই অধম সেই ২০ জনের একজন হিসাবে সেই বিশ জনের একজন হিসাবে চায়নায় রাষ্ট্রিয়ভাবে ভ্রমনের সুযোগ করি।
 
চায়নার যুব মন্ত্রণালয় (যেটা ‘অল চায়না ইয়ূথ ফেডারেশন’ নামেই পরিচিত) ভ্রমনের যাবতীয় খরচ বহন সহ সফরটি তত্বাবধান করে। ন্যাশনাল ইয়ূ্থ কাউন্সিল অব বাংলাদেশ এর তৎকালিন প্রেসিডেন্ট জাকির ভাই Zakir Hossain (যিনি বাংলাদেশর শ্রেষ্ট যুব সংগঠক হিসাবে দু’দুবার রাষ্ট্রিয় পদক প্রাপ্ত ব্যক্তি- আরও মজার বিষয় হলো একবার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে তিনি পুরুস্কার গ্রহন করেন) সহ যুব মন্ত্রণালয়ের তৎকালিন যুগ্ন-সচিব খালেদ ভাই (যদ্দুর জানি খালিদ স্যার এখন পল্লী উন্নয়ন ফেডারেশন এর ডিজি) এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তরুণ অফিসার রইস এবং সারাদেশ থেকে আরও ১৬জন সহ মোট ২০জন মিলে যাত্রা শুরু করি। আমাদের শুধুমাত্র ঢাকা-কুনমিং-ঢাকা’র হাফ বিমান ভাড়া (১৫,০০০ টাকার মত) প্রদান করতে হয়ছিল। সে আরেক গল্প; বলবো এক সময়।
 
সেদিনের সেই ভ্রমণের কিরণ Mohammed Bhuiyan ভাই, সিরাজগঞ্জের রঞ্জ, রংপুরের রিকো, গেন্ডারিয়ার মীম Mim Ansary, মিষ্টার এন্ড মিসেস শেহজাদ, ইসলাম ব্রাদার্সসহ অনেকের সাথেই দীর্ঘদিন দেখা স্বাক্ষাৎ নেই; সকলকেই খুব মিস করি।
 
আর সবচে বেশী মিস করি আমাদের ঐ ১০ দিনের চমৎকার ভ্রমণের ইন্টারপ্রেটর বেইজিংএর ‘টাং হাও’কে। অনেক কিছু শিখেছি আমরা টাং এর কাছ থেকে।
 
 
   Send article as PDF