ধর্ষন যেখানে জাতির পিতার স্বপ্ন

সেদিন ইন্টারনেট এর গঠন নিয়ে একটা আর্টিকেলে একটা উদাহরণ দিয়েছিলাম।
 
একাধিক কমপিউটারকে কানেক্ট করে তৈরী হয় একটা নেটওয়ার্ক এবং একাধিক নেটওয়ার্ক এর সমন্বয় হলো ইন্টারনেট।
 
ইন্টারনেটের গঠনের সংগে এফবিসিসিআই এর গঠনের বেশ মিল রয়েছে। একাধিক একই ন্যাচারের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে তৈরী হয়ে থাকে একটা ব্যবসায়িক সমিতি বা এসোশিয়েশন। আর দেশের সকল এসোশিয়েশনগুলির মাদার সংগঠন হলো ব্যবসায়ীদের ফেডারেশন বা এফবিসিসিআই।
 
সুতরাং এফবিসিসিআই এর সদস্য (জেনারেল বডি মেম্বার) হতে হলে প্রথমে আপনাকে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে হবে; এরপর সেইম নেচারের ব্যবসায়ী সংগঠন বা এসোশিয়েশন এর টপ ফাইভ সেন্ট্রাল লিডার নির্বাচিত হতে পারলেই আপনি আপনার এসোশিয়েশন থেকে প্রতিনিধত্ব করে এফবিসিসিআই এর জেনারেল বডি মেম্বার হতে পারবেন- বিষয়টি বেশ জটিল এবং অত্যন্ত প্রতিযোগীতাপূর্ণ।
 
অবশ্য এসোশিয়েশন এর বাইরে দেশের চেম্বারগুলির প্রতিনিধি হয়েও এফবিসিঅাই এর জেনারেল বডি মেম্বার হওয়া যায়।
 
সে যাকগে।
২০০৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত এই অধম এফবিসিসিআই এর জেনারেল বডি মেম্বার ছিলাম। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এফবিসিসিআই আসলে ব্যবসায়ীদের একটা ‘টকিং ক্লাব’। এটার ডাইরেক্টর নির্বাচিত হতে পারলে সরকারের সংগে দরকষাকষি করে নিজের ব্যবসায়িক সুবিধা বাগিয়ে নেয়া বেশ সহজ; মূলত বেশীরভাগ ডাইরেক্টরদের ধান্দাও থাকে তাই।
 
আর নির্বাচিত ডাইরেক্টরদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন এফবিসিসিআই এর প্রেসিডেন্ট। একবার চেম্বার গ্রুপ থেকে অপর বছর এসোশিয়েশন গ্রুপ থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার সুযোগ পান।
 
ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক (আনিস ভাই) এসোশিয়েশন গ্রুপ থেকে নির্বাচন করে এফবিসিসিআই এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ২০০৭ সালে দুই বছরের জন্য। ভদ্রলোক বেশ ভাল ভালো কথা বলতে পারেন। এবং ভালো ভালো কথাগুলি আবার বেশ মিষ্টি করে গুছিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপনও করতে পানে।
 
আমার স্মৃতিশক্তি যদি প্রতারণা না করে থাকে, তাহলে বলতে পারি দিলদার আহমেদ সেলিম আমার পরিচিত। আমরা একই সংগে এফবিসিসিঅাই এর জেনারেল বডি মেম্বার ছিলাম এবং এই ভদ্রলোক প্রতিবছরই ডাইরেক্টর নির্বাচন করতেন এবং খুব সম্ভবত কয়েকবার এফবিসিসিআই এর ডাইরেক্টরও ছিলেন। আমি তাকে ভোট দিয়েছিলাম কি না মনে নেই।
 
দিলদার ভাই আপন জুয়েলার্স এর মালিক।
উনার বেশ কয়েকটা শোরূম ঢাকাতে। পাক্কা স্বর্ণ ব্যবসায়ী। চলাফেরায় বেশ ঝিকঝাক একটা ভাব রয়েছে। মন খুলে সকলের সংগে কথা বলেন।
 
ভদ্রলোককে মনে হতো টাকার উপর দাপিয়ে বেড়ান!
 
এই দিলদার ভাইয়ের ছেলে (নাম টা মনে করতে পারছি না; অবশ্য চাচ্ছিও না মনে থাকুক) নাকি তার সহযোগীদের নিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বা দুইটা মেয়েকে ধর্ষন করেছে।
 
অবশ্য মেয়েদুটি যে ধর্ষিতা হয়েছে সেটা তারা নিজেরা নিশ্চিত হতে পেরেছে ঘটনার ৩৭ দিন পর।
 
শুনেছিলাম গন্ডারের চামড়া নাকি অনেক মোটা থাকে। গন্ডারকে চিমটি কাটলে ৩দিন পর নাকি গন্ডার সেটা টের পায়। অর্থাৎ আপনি যদি গন্ডারকে ‘সুরসুরি’ দেন তাহলে সে তিনদিন পর হেসে দিবে।
 
যেই মেয়ে ৩৭দিন পর ধর্ষন টের পায়ে- সেই মেয়েকে দিলদার ভাইয়ের ছেলে কি করেছে- বোঝাটা বেশ কঠিন বৈকি!
 
আমি অন্তত বুঝি না।
আমার অতটা বুদ্ধিও নেই।
 
বাংলাদেশ কেন্দ্রিক সোসাল মিডিয়ার নিউজ ফিড বেশ কয়েকদিন যাবৎই ‘এই ধর্ষন’ নিয়ে বেশ উত্তেজিত সময় পার করে যাচ্ছে। আমি সাধারণত ধর্ষনের নিউজগুলি এড়িয়ে যাই- বিরক্ত লাগে।
 
কিন্তু এবারের ধর্ষন নিয়ে এতটাই গরম স্ট্যাটাস দেখলাম যে খুব একটা এড়িয়ে থাকতে পারলাম কৈ?
 
এবং, অবশেষে, নিজেও সেই একই গর্তে পা দিলাম।
 
আমি দুই শ্রেণীর মানুষকে ঘৃণা করি। প্রচন্ড ঘৃণা করি। মন থেকে ঘৃণা করি। এদের সংগে কথা বলতে বা এদের মুখের দিকে তাকালে আমার বমি চলে আসে।
 
তারমধ্যে প্রথম শ্রেণীটা হলো যারা মানুষ খুন করে। শেখ হাসিনা, শহিদুল, বেনজির, মনিরুলসহ বর্তমান সময়ের দাগী খুনীদের বিরুদ্ধে আমি নিয়মিত ঘৃণাভড়া আর্টিকেল লিখি।
 
এমনকি যাকে আমি পছন্দ করি না, সেই শেখ মুজিব এর মতো ব্যক্তির খুনীদেরও আমি মন থেকে ঘৃণা করি। মানুষ হত্যার চেয়ে বড় অপরাধ এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। থাকতে পারে না।
 
এমনকি আমি যে-কোন মৃত্যুদন্ডেরও বিরোধী।
একজন মানুষের শরীরে আরেকজন মানুষ হাত তুলবে- আমি এটা মেনে নিতে পারি না।
 
আর দ্বিতীয় যেই গ্রুপটাকে আমি ঘৃণা করি- তারা হলো ধর্ষক। ধর্ষকদেরও আমি প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করি। ওদের আমি মানুষের গোত্রই মনে করি না।
 
খুনী এবং ধর্ষক- এরা পশুর চেয়েও অধম।
 
বর্তমান বাংলাদেশে শেখ মুজিবের স্বপ্নের বাস্তবায়ন চলছে।
শেখ মুজিবর রহমান ধর্ষনময় বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন আর তাই তো তার সোনার ছেলেরা (ছাত্রলীগ) দেশে ধর্ষনের সেঞ্চুরী হাকিয়ে যাচেছ।
 
বাংলাদেশ কোন ইসলামী প্রজাতন্ত্র নয়।
বাংলাদেশ বর্তমানে কোন গণতান্ত্রিক দেশও নয়।
রাজতান্ত্রিক তো নয়ই।
 
তাহলে?
বাংলাদেশটা আসলে কি?
 
কোন নীতি বা আদর্শ নিয়ে চলছে বাংলাদেশ?
আছে কি কোন নীতি বা আদর্শ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের?
 
এই দেশে পুলিশ কাষ্টডিতে ধর্ষিত হয় মহিলা আসামীরা।
অর্থাৎ রাষ্ট্র সরাসরি ধর্ষকের ভূমিকা পালন করে।
 
এদেশে দিনে দুপুরে মানুষ খুন হয়, গুম হয় পুলিশের হাতে। দেশের প্রধান বিচারপতি জানেন কোথায় আছে গুম হওয়া মানুষগুলি। সেই প্রধান বিচারপতি একই সংগে ঘোষনাও দেন কাউকে ২৪ ঘন্টার বেশী আটক রাখা যাবে না- আদালতে সোপর্দ করতে হবে। কিন্তু বিগ্রেডিয়ার আজমী সহ আরও অনেকেই গুম হয়ে রয়েছে এই রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে।
 
এসব কোন বিষয়ই না।
 
তাহলে- দেশের মূলনীতিটা কি?
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শটি কি?
 
শেখ মুজিব সাহেবের আদর্শটা কি ছিল?
শেখ হাসিনা তো শেখ মুজিবের আদর্শই কায়েম করেছে গত ৮-৯ বছরে।
 
এবং সেই আদর্শের অধিনে চলছে দেশ।
ছাত্রলীগ ধর্ষন করছে।
পুলিশ লীগ খুন করছে, গুম করছে।
বিচারপতি লীগ দেদারছে যাকে মন চায় ফাঁসিতে ঝুলাচ্ছে।
 
শেখ মুজিবীয় আদর্শের পথ ধরে চলা এই বাংলাদেশে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তার নিজের ছাত্র লীগের সদস্যরা গাঁজার চাষাবাদ করে, তার আদর্শের এমপি বদিরা দেশে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আমদানী ও সরবরাহ করে দেশকে মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে চলছে আর বন্ধু রাষ্ট্র ভারতীয় ফেনসিডিল তো যুবকদের নিয়মিত খাবারে পরিণত করেছে বর্তমান সরকার। এমন আদর্শে ধর্ষন আর চাঁদাবাজীই বা বাদ থাকবে কেন?
 
সেই দেশে অতি সামান্য দিলদার ভাইয়ের ছেলেরা না হয় একটু আধটু ‘ধর্ষন’ করেই ফেলেছে- যদিও সেই ধর্ষনটিও প্রশ্নবোধক যুক্ত! তাতে মিডিয়ার এতোটা লাফালাফি কেন আমি বুঝি না!
 
এটাই তো হবার কথা বাংলাদেশে!
রাষ্ট্র যেখানে নিজে ধর্ষন করে। সরকার যেখানে ধর্ষণকে পৃষ্ঠপোষক করে- সেখানে তো ধর্ষন হবেই।
 
এই দেশেই সেই শাহবাগে যখন ‘গণকনডম মঞ্চ’ চলছিল- সেখানে কি হয়েছিল? লাকীদের ভাগে টাকার পরিমাণ কম গেলে- শাহবাগ থানাকে কতগুলি ধর্ষন মামলা গ্রহণ করতে হতো সে সময়- সেই হিসাব কি আছে আপনাদের কাছে?
 
যেই মেয়েরা ঘটনার ৩৭দিন পর টের পায় সে ধর্ষিতা হয়েছে- সেই মেয়ের ধর্ষন কাহিনী আমি শুনতে রাজী না।
 
যেই মেয়েরা গভীর রাতে দিলদার ভাইদের মতো পয়সাওয়ালা ছেলেদের সংগে পার্টিতে যায়- তাদের একটাই চাওয়া থাকে আর সেটা হলো ‘টাকা’ যা অতি সহজে পাওয়া যায়।
 
হয়তো বা দিলদার ভাইয়ের ছেলেদের কাছ থেকে আশানুরূপ টাকা পায়নি সেই মেয়েগুলি, দরদাম করতে মাস খানেক সময় নষ্ট হয়েছে, কিন্তু তাতে কে? এই দেশে তো ‘নারী নির্যাতন আইন’ নামের একটা ফালতু আইন রয়েছেও।
 
৩৭দিন কোন ব্যাপার নাকি?
 
টাকা দাওনি- এবার দিলদার ভাইদের সবই যাবে।
 
বাংলাদেশের নারী নির্যাতন আইনটি অত্যন্ত বাজে ও বিরক্তিকর। এই আইনে যে-কোন মেয়ে আপনার বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে যদি বলে আপনি তাকে ‘টিজ’ করেছেন বা ‘ধর্ষন’ করেছেন- তাহলে সর্ব প্রথমে আপনাকে গ্রেফতার করা হবে এবং এই আইনের ধারা জামিনযোগ্য নয়। অর্থাৎ কম করে হলেও আপনাকে এক দুই মাস জেলে থাকতে হবে।
 
তারপর একসময় প্রমাণ হলো যে আপনি ধর্ষন করেননি বা ঐ মেয়েকে চিনেনও না- তো কি হয়েছে। ফ্রি জেল তো খেটেছেন, এটাই বা কম কি?
 
যে দেশে কোন নীতি নেই, যে দেশে কোন আদর্শিক অবস্থান নেই, যে দেশে কোন সুষ্ঠু আইন নেই, আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই, টাকার ভারে আইন অন্ধ হয়ে যেতে পারে, যে দেশে রাষ্ট্র নিজেই ধর্ষক, খুনী, গুমকারী- সেই দেশে ধর্ষন হবে। এবং হবেই।
 
আপনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজেকে সেলিব্রেটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবেন হয়তো, কিন্তু তাতে ধর্ষন বন্ধ হবে না।
 
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি আজ অলমোষ্ট ধ্বংশপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোন আদর্শ নেই। নীতি নেই।
 
নীতি আর আদর্শহীন জনপদে ধর্ষন বন্ধ করা অসম্ভব।
 
একটা সুৎ, সুন্দর আর আদর্শিক রাষ্টই পারে ধর্ষনকে বিলুপ্ত করতে।
 
এই দেশে ৫ বছরের একটা মেয়ে শিশু ধর্ষন হয়।
এই দেশে সামান্য ১০-২০ টাকার জন্য ১০ বছরের শিশু ছেলেকে শুধু হত্যাই করা হয় না সেখানে দর্শকও থাকে, তারা আবার ভিডিও করে, সেই নিশংস দৃশ্য ফেসবুকে আপলোডও করে। তনুরা সেনা ক্যাম্পে ধর্ষন শেষে নিহতও হয়।
 
একটা দেশের সামগ্রিক নীতি, নৈতিকতা কোথায় গেলে, কতটা অাদর্শচুত্য হলে এসব ঘটনা প্রতিদিনের বিরতীহীন সংবাদে পরিণত হয়- সেটাও আমরা বুঝে উঠতে পারি না।
 
আমরা শুধু একটার পর একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনার গরম স্ট্যাটাস দিয়ে সোসাল মিডিয়া মাতিয়ে রাখি।
 
এভাবে ধর্ষন বন্ধ হবে না।
এভাবে হত্যাকান্ড বন্ধ হয় না।
 
দেশটাকে চেঞ্জ করুন।
তখন সবই সম্ভব হবে।
 
নইলে উপভোগই করতে থাকুন।
কি আছে আর জীবনে?
 
 
   Send article as PDF