বেগম জিয়ার যত ভুল

একটু ভুল সিদ্ধান্ত সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে যায় শুধুমাত্র একটি ভুল পদক্ষেপ।
 
এই যেমন বেগম খালেদা জিয়া। ওনি ভুল করেছিলেন। তাই আজ ওনাকে পস্তাতে হচ্ছে মারাত্মক ভাবে; তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো প্রয়াত; বড় ছেলে এক সময়ের দুর্দান্ত প্রতাতশালী তারেক রহমান পিনো লন্ডনে নির্বাসনে; ‘আরেক ছেলে’ মামুন দীর্ঘদিন কারাগারে ডিভিশনবিহীন কয়েদি।
সবাই যার যার মতো করে পরাজিত খালেদা জিয়া’র কার্যক্রমের ব্যবচ্ছেদ করে যাচ্ছে। তার ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনে অংশ না নেয়াটা ভুল, জামায়াতের সাথে জোট বাধাটা ভুল, ইত্যাদি।
 
আমার বিশ্লেষণটা অবশ্য একটু আলাদা।
না, ৫ই জানুয়ারীর তথাকথিত ফেক ইলেকশনে অংশগ্রহণ না করার ওনার সিদ্ধান্তটি শতভাগ সঠিক এমনকি জামায়াতের সাথেও জোট-বাঁধাটায় ভুলের কিছু ছিল না।
আমি একটু আগে ফিরে যাই।
 
খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসেন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে। ওনি প্রথম যে ভুলটা করলেন তা হল ১৯৯৬ সালে বিরোধীদের দাবীকৃত (আওয়ামী লীগ – জামায়াত জোট) তত্বাবধায়ক সরকারকে প্রথমে অপছন্দ করে; সর্বশক্তি দিয়ে ১৫ই ফেব্রুয়ারী একটি তথাকথিত (৫ই জানুয়ারীর অনুরুপ) নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেন এবং ব্যর্থ হন; বাধ্য হয়ে তত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতা আসেন। শেখ হাসিনা তার প্রথম ক্ষমতায়নের সময় (১৯৯৬-২০০১) অত্যন্ত সৎ ও সুন্দর নেতৃত্ব দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। এবং তিনি কোন দুরভিসন্ধির আশ্রয় নেননি (২/১ টা ভুল ছাড়া), সুন্দরভাবে কোন চতুরতা ছাড়াই ২০০১ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এবং নির্বাচনে পরাজিত হন।
 
খালেদা জিয়ার ভুলটা ছিল ২০০৬ সাথে ক্ষমতা ছাড়তে না চাওয়াটা; বিভিন্নভাবে তত্ববধায়ক সরকারের পরবর্তী প্রধানকে বিতর্কিত করার চেষ্টা (বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো), অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিনের মতো ‘একজন মেরুদন্ডহীন, দুষ্ট ও নাবালক’কে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেয়া এবং পাগলা আজিজের মতো আরেকজন দুষ্ট ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করা ইত্যাদি। ইয়াজউদ্দিনের সরকারকে ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা এবং ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে একটি নীল-নকসার নির্বাচনের চেষ্টা করা।
 
বেগম খালেদা জিয়া এই ভুলটাই করেছিলেন; তার অন্য কোন ভুল ছিল না। টানা ৫ বছর দেশটাকে লুটেপুটে খেয়ে খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান বুঝতে পেরেছিলেন- তারা নিরপেক্ষ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারবেন না; এবং এজন্যই চতুরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন।
যা-ই হোক, সুন্দর একটি নির্বাচন হল ২০০৯ এ এবং আমি সহ দেশের অধিকাংশ ভোটারই বিএনপি-জামায়াতের উপর বিরক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের নৌকায় ভোট প্রদান করে। অাওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়।
 
ঘটনাটা এখানে শেষ হতে পারতো। কিন্তু ততদিনে বিষয়টা সত্যি সত্যিই বেগম খালেদা জিয়ার ভুলে তিক্ততায় রূপ নেয়। এবং শেখ হাসিনা তার প্রথম টার্মে একটা চমৎকার সরকার উপহার দিলেও এই টার্মে তার মাথায়ও খালেদা জিয়ার বদমায়েশীর পোকাগুলি ঢুকে পরে।
সে সতর্ক হয়ে যায়। তত্ববধায়ক সরকার তাকে দেশে আসতে বাধা দেয়, তাকে জেল খাটানো হয়, বাট, শেখ হাসিনা কিন্তু জেল খাটার মতো কোন অপরাধ করেননি তার প্রথম টার্মে বা বিরোধী দল হিসাবে। তাই তার জেদ চেপে বসে। বেগম খালেদা জিয়ার দেখানো পথে হাঁটা শুরু করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বুঝতে পারে- ১৯৯৬-২০০১ টার্মে ভাল থেকে তো কোন লাভ হল না; কাজেই আর ভাল থেকে লাভ কি? তিনি ১৮০ডিগ্রি ইউটার্ণ নেন। সংগে যোগ হয় কিছু চরম হটকারী লোকজনের পরামর্শ (হাসানুল হক ইনু ইত্যাদি)।
 
শেখ হাসিনা- খালেদা জিয়ার বুদ্ধিগুলি এবং তার হটকারী চরমপন্থিদের পরামর্শ নিয়ে এগুতে থাকেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য ভয়ংকর পরিকল্পনা নেন; খুন, গুম, ক্রসফায়ার, ফাসি ইত্যাদি ‘অপরাধগুলি’ তিনি নির্দিধায় চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের নেতাদের নগদ কাচা পয়সা পাইয়ে দিচ্ছেন; দেশের বারোটা বাজুক কিছু এসে যায় না তার। মোদ্দকথা শেখ হাসিনা তার স্বরুপে আত্মপ্রকাশ ঘটান। এদেশের মানুষ তার পিতার মৃত্যুতে আনন্দ পেয়েছিল; সেই ক্ষোভ তো রয়েছেই। বিশ্ব ব্যাংকের টাকা আত্মস্মাতে ব্যর্থ হয়ে নিজস্ব অর্থের নামে বার হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু ২৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে বানিয়ে নিচ্ছেন, দেশের ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির, এক হাজারের উপর গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ। রিয়েল ইষ্টেট ব্যবসায়ীদের অবস্থা আরও খারাপ, দেশে নতুন কর্মসংস্থান নেই। শুধু যারা আওয়ামী লীগ করবে তারাই ভাল থাকবে, আনিসুল হকের মতো বড় মাপের ব্যবসায়ী এখন আওয়ামী লীগের মেয়র।
 
শেখ হাসিনা স্পষ্টই বুঝেছেন, তিনি ভদ্রভাবে দেশ চালালে ক্ষমতায় আসতে পারবেন না; এখন যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়- আবার মন্দের ভাল হিসাবে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। এবং সে যেভাবে জামায়াত-বিএনপিকে কচুকাটা করে চলছে- তাকেও ঠিক সেভাবেই কচুকাটা করা হবে। কাজেই কেন তিনি সেই ‘ভুল’ করবেন? তার পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই তিনি লিখে নিয়েছেন ইতিমধ্যে।
 
মোদ্দকথা হল হাসিনা-খালেদা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কোন পার্থক্য নেই এই দুই মহিলার। একটি মেধাহীন, অলস, অসচেতন জাতি’র জন্য তো হাসিনা-খালেদা’র মতো শাসকই তৈরী হবে।
 
হাসিনা-খালেদা’রা খুব ভাল করেই বুঝে বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র চালাতে নিজস্ব মেধা, দুরদর্শিতার কোন প্রয়োজন নেই, দেশ দেশের গতি্ই চলবে; আর সেই সুযোগ টা নেয় অদক্ষ, দুর্নীতিবাজ আমলা, চরিত্রহীন বিচারক, সন্ত্রাসী পুলিশসহ সকল সরকারী প্রতিষ্ঠান। কায়েম হয় ঘুষের রাজ্য। ক্ষমতার দাপট।
আর এদেশের মানুষরা পরিশ্রম করতে রাজী নয়। সবাই চায় খুব তাড়াতাড়ি ‘বড়লোক’ হতে- কোন পরিশ্রম ছাড়া।
এভাবেই কি চলবে বাংলাদশে? আর কত দিন? মানুষ কবে জাগবে?
   Send article as PDF