বাংলাদেশের সবচে বড় সৌন্দর্য্য

একটা প্রশ্ন করি।
বলুন তো বাংলাদেশের সবচে সৌন্দর্য্যমন্ডিত বিষয়টা কি?
 
অনেকেই আমাকে অভিযোগ করেন আমি নাকি বাংলাদেশের নেগেটিভ বিষয়গুলিই বেশী লিখি। খালি বাংলাদেশের বদনাম করি। দেশকে একদমই ভালবাসি না। আজ শুধুই দেশ নিয়ে লিখবো।
 
ঠিক আছে। উত্তরটা একটু পরে দিই।
অন্য একটা বিষয় বলি।
 
সাপ চিনেন তো। বিষধর সাপ।
আপনি যদি একটা বিষধর সাপের গলাটা কেটে ফেলে দেন- তাহলে কিন্তু সাপটা মারা যাবে। এটা সব প্রাণীর ক্ষেত্রেই হয়। স্বাভাবিক একটা বিষয়।
 
কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয়টা কি জানেন?
ঐ মারা যাওয়ার সাপটার মাথাটা; বেশ কয়েক দিন পরও যদি ঐ মারা যাওয়া সাপটার মাথাটার মুখের কাছে আপনার হাত বা পা নেন- তখনও কিন্তু ঐ মারা যাওয়া সাপটা আপনাকে কামড়ে দেবে।
 
এবং আপনি মারা যাবেন।
একটা মারা যাওয়া সাপের মাথা অনেক সময় ৩দিন পরও একজন মানুষকে কামড়ে মেরে ফেলতে পারে।
 
কারণটা খুবই সাধারণ।
সাপের শরীরটা অটোমেটিক কাজ করে- শরীরটা তৈরীই করা হয়েছে ওভাবেই। শরীরের কাছে কিছু থাকলে সে পেচিয়ে ফেলবে লতার মতো। মুখের কাছে কিছু গেলে কামড়ে দেবে। এমন কি মারা যাবার পরও কয়েকদিন পর্যন্ত।
 
কাজটা সাপ-কে নিজ থেকে না করলেও চলে; অটোমেকিটলি-ই তা হয়ে যায়। সাপ এই বৈশিষ্ট্যটা প্রকৃতি থেকেই পেয়েছে।
 
বিষয়টা বেশ মজার না!
আমি কিন্তু এরচেও একটা মজার বিষয় বলতে পারি।
 
মানুষের ভেতরেও কিন্তু এই ‘অটোমেটিক; কাজ করার বিষয়টা রয়েছে।
বিশ্বাস হচ্ছে না। তাই তো?
 
সহজ করে দিই।
সবাই বলে না ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’। মানুষ যা কিছু অনুশীল করবে- তাই-ই এক সময় তার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়ে যাবে। অনেকটা ঐ সাপের প্রকৃতি থেকে পাওয়া বৈশিষ্ট্যের মতোই। আর মানুষের উচিৎ সর্বাবস্থায় ভাল বিষয়গুলি অভ্যাসে পরিণত করা।
 
এবার মূল বিষয়টা বলি।
অনেকেই আমার কাছে ভ্রমণ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। অনেকেরই প্রচন্ড কৌতুহল থাকে- কিভাবে আমি এতটা ভ্রমণ করি। বা করেছি। আমার মনে আছে ২০১৩ সালে আমি প্রায় সাড়ে তিন লাখ কিলোমিটার বিমান ভ্রমণ করেছিলাম। এতো টাকাই বা কোথায় পাই?
 
এবং, অনেকেই জানতে চায় কিভাবে ভ্রমণ করা সম্ভব? আমাদের বাংলাদেশের মানুষের আয় অনেক কম। অল্প আয়ে বলতে গেলে প্রায় সকলেরই দিন আনতে পান্তা পুরোয় অবস্থা। তারপর আবার ভ্রমণ?
 
অনেক টাকার বিষয়। সময় প্রয়োজন। সংগতি প্রয়োজন। কার সংগে যাবে? কোথায় যাবে? কোথায় উঠবে? কি খাবে? কোন ভাষায় কথা বলবে? ভিসা? পাসপোর্ট? টিকেট?
 
কত্ত কত্ত ঝামেলা!
এসব কি করা সম্ভব?
 
আসলে এসব ভাবতে ভাবতেই দেখা যায় সংসারে ঢুকে গেছে। তারপর আর হয়ে উঠে না।
 
সত্যি বলতে কি আমি সেই ১৯৯৪ সাল থেকে ভ্রমণ শুরু করি।
 
ভ্রমণের প্রতি আমার প্রচন্ড আগ্রহ। ভয়াবহ আগ্রহ সেই পিচ্চি বেলা থেকেই। কিন্তু আমার তো সেই সুযোগ ছিল না যে ভ্রমণ করতে পারবো। পেপার ম্যাগাজিন পড়ে, ওয়ার্ল্ড ম্যাপ মুখস্থ করে আর ভ্রমণ কাহিনী দেখেই শখ মেটাতে হতো।
 
স্কুলে যখন পড়ানো হতো ‘এইম ইন লাইফ’ তখনই প্রথম আমার মাথায় ভর করে ‘আমার ভবিষ্যৎ-টা কি?’ কি হওয়া যায়? কি করলে ভাল লাগবে? কি করলে জীবনটাকে আনন্দময় করে উপভোগ করা যাবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
 
কোনই কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আমি গতানুগতিকা চড়ান্তভাবে অপছন্দ করি। ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, উকিল এসবে তো আমার পোষাবে না!
 
তাহলে?
বিস্তর চিন্তার বিষয়।
কোনই কুল কিনারা পচ্ছিলাম না।
 
আমার এলাকার একজন ‘গুপ্ত জোতিষী’ একবার আমার হাত দেখে বললেন, ‘তোমার তো দেখছি বহুমুখী প্রতিভা। তুমি সব কিছুই ভাল জানো। কিন্তু সমস্যা হলো- যে সবকিছুই জানে সে মুলত কিছুই জানে না। কাজেই তোমাকে তোমার প্রতিভা একমূখী করে ফেলতে হবে। তুমি একটা একমুখী এইম ইন লাইফ তৈরী করে ফেল। নইলে সমস্যা হয়ে যাবে।’
 
ভদ্রলোকের কথাটা আমার খুবই মনে ধরলো।
চিন্তা করতে লাগলাম আমার ঠিক কি করতে ভালো লাগে?
 
এবং পেলামও।
 
প্রথমতঃ আমার অনেক টাকা ইনকাম করতে হবে।
এবং দ্বিতীয়তঃ এই পৃথিবীর পুরোটা আমাকে ঘুড়ে দেখতে হবে।
 
টাকা’র ইনকাম বিষয়টা আমি একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করলাম। লিমিটেড টাকা হলে হবে না। আনলিমিটেড টাকা আয় করতে হবে। আর আনলিমিটেড টাকা আয় করতে হলে ব্যবসা ছাড়া বিকল্প নেই। সংগে যদি এমন একটা ব্যবসায় নিজেকে জড়িত করে যেটাতে ভ্রমণও হয়ে যাবে- তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
 
আমি ঐ সময়টাতে ‘কোয়ান্টাম মেথড’ এর কোর্সটা করলাম।
তারপর জানলাম, মানুষ যা ইচ্ছে তাই-ই করতে পারে।
 
সুতরাং আমার তো মাত্র দু’টি চাওয়া। এদুটো সামান্য চাওয়া তো পূরণ হবেই।
আমি অনুশীলন শুরু করে দিলাম।
 
একটা ‘জীবন্ত স্বপ্ন’ তৈরী করলাম।
প্রতিদিন ধ্যান মগ্ন হওয়া শুরু করে দিলাম। সকালে আর সন্ধ্যায় মনের গভীরে অবচেতন মনে চলে যেতাম ঘন্টা খানেক করে সময় নিয়ে। তারপর আমার সম্পূর্ণ নিজের তৈরী করা স্বপ্নটি একটানা প্রতিদিন দেখে যেতে লাগলাম।
 
খুব আনন্দ পেতাম স্বপ্নটা দেখে। এভাবে একটানা প্রায় ৫ বছর দেখেছি ওই স্বপ্নটা।
নিজের তৈরী স্বপ্ন বলে কথা। স্বপ্নটা দেখতে দেখতে এমন হলো যে আমি বিশ্বাস করে ফেললাম- ‘আমি তো এমনই’। মানে, মনে হতো- ওই স্বপ্নটাই আমি।
 
জীবন্ত একটা স্বপ্ন।
 
ততদিনে আমি কিন্তু আমার ব্যবসাও শুরু করে দিয়েছি। প্রথম বছর ব্যবসায় কিছুই হচ্ছিল না। কিন্তু আমি আমার নিজেকে প্রচন্ড বিশ্বাস করা শুরু করে দিয়েছি। আমি জানতাম আমি যে স্বপ্ন শুরু করেছি সেটাই বাস্তব। শুধু সময়ের ব্যাপার।
 
তারপর একটা বছর পার হলো।
আমিও ঘুরে দাড়াতে শুরু করলাম।
 
তখন আমি মনে প্রাণে একজন পুরোপুরি পর্যটক।
তখনও ইনকাম ততটা বেশী না। খুবই লিমিটেড। তবে আমার বিশ্বাস ছিল ওটা শিগগিরই আনলিমিটেড হয়ে যাবে। কারণ আমার স্বপ্ন তো মিথ্যা হতে পারে না।
 
আমার ভ্রমণ শুরু করে দিলাম।
ভ্রমণ করতে আসলে আহামরি টাকা লাগে না।
 
শুধু মানসিকতা লাগে। এবং আগ্রহ থাকতে হয় যে আমি ভ্রমণে বের হয়েছি।
আনুষ্ঠানিক প্রথম ভ্রমণে বের হলাম- এক ঢিলে ৩টি পাখি মারবো।
 
চট্রগ্রাম যাবো ফসেজ লেক দেখবো।
ওখান থেকে রাঙামাটি যাবো। তখন আমি পত্র-মিতালী করতাম একটা পাহাড়ী মেয়ের সংগে। ওর নাম লক্ষী চাকমা। ও দেখা করার জন্য খুব তাড়া দিচ্ছিল- ওর সংগে দেখা করবো। এবং জীবনে প্রথমবার বিমানে ভ্রমণ করবো- যাবো চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজার বিমানে উড়ে।
 
আমার বাজেট কত ছিল শুনবেন?
ওটা সম্ভবত ১৯৯৪ বা ৯৫ সালে। সব মিলিয়ে আমার হাতে টাকা ছিল ১৬০০।
 
গেলাম।
এবং সবটাই জয় করে ফিরলাম।
 
এরপর ১৯৯৭ সালের মধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলাম পুরো দেশটাই ভ্রমণ শেষ করবো। বাংলাদেশটা খুবই ছোট। আমি প্রতি মাসেই একটা-দুইটা করে ট্যুর দিতাম। একে এক কুয়াকাটা, খুলনা, সুন্দরবন। আবার হয়তো বগুড়া, রাজশাহী। অন্য ট্যুরে দিনাজপুর নিলফামরী পঞ্চগড়। ওদিকে নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর।
 
আসলেই ভ্রমণে টাকা লাগে না।
আমি বাজে কোন খরচ করতাম না।
আমি সিগারেট খাই না। মদ খাই না। মেয়ে মানুষে লোভ নেই। সস্তা হোটেলে উঠতাম।
 
এবং রাস্তার পাশে টং রেষ্টুরেন্টে তাজা মাছের ঝোল আর সবজী আমার অতি প্রিয় খাবার।
 
বাংলাদেশটা চষে বেড়ালাম। প্রায় সোয়া চারশত উপজেলা আমার দেখা হয়ে গেল।
১৯৯৮ সালেই বাংলাদেশটা দেখা শেষ করলাম।
 
কিন্তু সত্যি আমার মন ভরলেও প্রাণ ভরলো না।
তারপরও দেখা জায়গাগুলিতেও আবার যেতাম। আবারও। আবারও। বহুবার।
 
আমার এই জীবনে আমি কতবার করে যে বগুড়া, রাঙামাটি, মৌলভীবাজার ভ্রমণ করেছি তার কোন হিসাব নেই আমার কাছে। ময়মনসিংহ, শেরপুরও আমার ভালো লাগার তালিকায় ছিল।
 
হাতে ১টা দিন সময় পেলেই চলে যেতাম শ্রীমঙ্গল এর সবুজ চা-বাগানে। সেটা অবশ্য পার্সোনাল ট্রান্সপোর্ট নেবার পর।
 
যারা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেন ‘কিভাবে ভ্রমণে যাবো?’ তাদের জন্য আমার একটাই সাজেশন, ‘মন ঠিক করুন। সিদ্ধান্ত নিন আপনি ভ্রমণ করবেন। বাকীটা এমনিতেই হয়ে যাবে। কিন্তু আপনার মন ঠিক করাটা ঠিকমতো হতে হবে।’
 
আর একটা পরামর্শ। ভ্রমণে দেখবেন বেশী। বাহুল্য খরচ করবেন না। খাবেন অতি সাধারণ খাবার। ফাইভ ষ্টার হোটেলে থাকা-খাওয়ার সুযোগ জীবনে বহু পাবেন। কিন্তু ঘুড়ে বেড়াবার সুযোগ কিন্তু খুব একটা নাও আসতে পারে।
 
আমি অসংখ্য হোয়াইট মানুষদের কোলকাতা বা দিল্লী ও কাঠমান্ডু শহরের অতি সস্তা হোটেলে মাথা গুজতে দেখেছি।
 
ভ্রমণের প্রকৃত আনন্দ কিন্তু ওখানেই।
 
একটা শক্তিশালী ও জীবন্ত স্বপ্ন তৈরী করুন।
এরপর ঐ স্বপ্নটি নিয়ে-ই সারাদিন পরে থাকুন।
 
নিজের স্বপ্নগুলিকে ‘ঐ’ সাপের চরিত্রে পরিণত করুন। তখন ঐ সাপের চরিত্রই আপনার ভ্রমণের কাজটা করে দেবে।
 
এরপর স্বপ্ন-ই আপনাকে পথ দেখাবে।
 
নিজেকে পরবর্তীতে ইন্টারন্যাশনাল ব্যবসায় জড়িয়ে ফেললাম।
তারপরের গল্পতো আমি নিজেই।
 
আমার সেদিনের সেই স্বপ্ন এখনও আমাকে ঘুমুতে দেয় না।
 
যাক।
শুরুতে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, ‘বলুন তো বাংলাদেশের সবচে সৌন্দর্য্যমন্ডিত বিষয়টা কি?’
 
উত্তরটা দিয়ে দিই।
আমি এই জীবনে অনেক ভ্রমণ করেছি। গোটা পঁচিশেক সমুদ্র সৈকত দেখেছি। নীল সমুদ্র আমার অতি প্রিয়। সংগে যদি সবুজ পাহাড় থাকে তো আরো সুন্দর।
 
বাংলাদেশের সুন্দর জায়গা গুলির মধ্যে আমার চোখ ও মন জুড়িয়েছে রাউজান এর পাহাড়ী নদীর দু’পাড়, শ্রীমঙ্গল এর সবুজ চা-বাগান আর একেবেকে চলে যাওয়া কালো রাস্তা। জাফলং এর ছোট্ট নদীটা পাড় হয়ে ওপারে গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটা। রাজশাহীর পদ্মার পাড় এর বিকেলে সময়টুকু। ঝিনাইগাতি, কর্ণঝরা, কাপ্তাই লেক, দশ মাইল টেকনাফ, তেতঁলিয়া। রাজীবপুর থেকে রৌমারীর সেই মেঠো পথ- পাশ দিয়ে ছোট নদী আর ওপাড়ে ইন্ডিয়ার তুরা পাহাড়। কোনটা বাদ দিবো- আমি জানি না।
 
কিন্তু এসব কিছু ছাড়িয়েও আরও একটা বিষয় আমার সবচে প্রিয়।
অতি প্রিয়। খুব মিস করি।
 
আর তা হলো ‘বাংলাদেশের অতি গরীব নিরীহ মানুষগুলি’ যারা তাদের সারাটা দিন ব্যয় করে নদীতে মাছ ধরে, জমিতে সবুজ ফসল ফলায়, হাতের বৈঠা ঠেলে নৌকা নিয়ে যায় গন্তব্যে, যে শ্রমিকরা সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত ঘামঝরা শরীরে দুপুর বেলা গাছের ছায়ায় বসে মুক্ত খোলা বাতাসে বসে ‘পান্তা ভাত খায় সংগে একটা পেঁয়াজ আর কাচা মরিচ সংগে লবন’!
 
এই মানুষগুলিকে এই ২০ হাজার কিলোমিটার দূরে বসে খুব মিস করি।
ঐ মানুষগুলি-ই বাংলাদেশের সবচে বড় সৌন্দর্য্য, অকৃত্রিম সৌন্দর্য্য!
 
ওদের আমি খুব বেশী মিস করি।
ওদের আমি খুব বেশী ভালবাসি।
 
একবার যদি এই কৃত্রিমতায় ভড়া আধুনিক জীবন ফেলে ছুটে যেয়ে ঐ কৃষক আর ঘামে ভেজা শ্রমিকদের সংগে একটা প্লেট নিয়ে দু’টো পান্তা ভাত আর কাচা পেয়াজ দিয়ে এক মুঠো খাবার শেয়ার করে খেতে পারতাম!
 
কোনদিন আসবে কি সেই সময়?
   Send article as PDF