মাঠা

একটু ভিন্ন টাইপ খাবারের প্রতি আমার দুর্বলতা অনেকেই জানেন।
দামী রেষ্টুরেন্ট খুঁজে খুঁজে রাজকীয় খাবার খাওয়ায় আমার কোন আগ্রহই কখনও-ই কাজ করে না।
 
কিন্তু ঢাকার বাইরে অজোঁ কোন পাড়াগাঁয়ে রাস্তার পাশের ছোট ‘টং রেষ্টুরেন্টে’ বসে তাজা কাচকী মাছ পরম যত্নে তরতাজা ডাটা, বেগুন বা মুলা দিয়ে রান্না করা দেখলে আমি নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। পারতাম না কখনওই।
 
সেই টং রেষ্টুরেন্টটি পঞ্চগড়ে হোক কিংম্বা শেরপুরে, মৌলভীবাজারের মাধবকুন্ডু ঝর্ণার পাশে অথবা ওপারে ইন্ডিয়ার আসামের পানি সাগরে; অথবা হতে পারে ময়মনসিংহ, নিলফামারী, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া অথবা পশ্চিমবংগের বনগাঁ, চাঁদপারা, শিলিগুড়ি, গৌহাটি, আগরতলা বা মেদেনীপুরেই!
 
কিন্তু এই সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশীয় নিজস্ব একটা পানীয় আমাকে সবসময়ই মাতোয়ারা করে রাখতো।
 
সেটা মাঠা বা ঘোল।
গ্রামে থাকতে বাজারে গিয়ে এক গ্লাস মাঠা আমি খেতাম-ই।
 
ঢাকায় থিতু হবার পর একটু বেকাদায় পরে গেলাম।
মাঠা খুঁজে পাই না। কিন্তু একদিন পেয়ে গেলাম সেই বায়তুল মোকাররম মার্কেটের ভেতরে এক ভদ্রলোক নরসিংদী থেকে প্রতিদিন স্পেশাল মাঠা বানিয়ে সংগে আরও কিছু পিঠা নিয়ে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে বসে বিক্রি করে।
 
মনে আছে এক গ্লাস মাঠার দাম নিতেন ২০ টাকা।
সত্যিই অসাধারণ ছিল সেই মাঠা। আমি মতিঝিলে কোন কাজে গেলে যত ব্যস্তই থাকি না কেন- ঐ এক গ্লাস মাঠা খেতে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে যাবোই যাবো।
 
শুক্রবার। বাড়ীতে যাচ্ছি আঁটি বাজার পার হয়ে আমার গাড়ী ছুটে চলছে- হয়তো আমারই চোখে আটকে যাবে পেছনে কাউকে মাঠা বিক্রি করতে দেখেছি সম্ভবত।
 
ড্রাইভারকে তখনই গাড়ী ঘুড়াতে বলতাম।
এক গ্লাস মাঠা আমাকে যে খেতেই হবে, খাবোই।
 
কি-ই জানি! আমার ড্রাইভাররা হয়তো বা আমাকে পাগলই ভাবতো।
অবশ্য কে আমাকে পাগল ভাবলো- তা তো আমি কোনদিনই কেয়ার করিনি।
 
নিজের যা ভালো লাগে- সেটা আমি করি।
সেখানেই আমার আনন্দ।
 
এক গ্লাস মাঠা খাবারের জন্য বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে রাস্তার পাশে কত ছোট ছোট বাজারে যে আমার গাড়ী থেমেছে এই জীবনে- সেটা হিসাব করে বলাও মুশকিল।
 
অবশ্য শীতের দিনের খুব সকালে এক গ্লাস কাঁচা খেজুরের রস পেলে ওই মাঠাকেও ভুলে যেতাম। বিকেলে রাস্তার পাশে এক গ্লাস তাজা রসের চা- সেটাও আমাকে মুগ্ধ করতো।
 
আর সামারের বিকেলে আমি কিন্তু তালের সেই মাতাল হওয়া রসও পান করেছি বহুবার।
 
কুয়ালা লামপুরের পুডুরায়া’র চায়না টাউনে আমার ছিল নিত্য আসা-যাওয়া।
সেই চায়না টাওনে সকালে ও বিকেলে এক চাইনিজ কারিগর বিক্রি করতেন মাঠার মতোই দেখতে খুব সাদা পানীয়। চাইনিজ, মালয়দের দেখতাম লাইন ধরে খেতে সেই মাঠার মতো পানীয়।
 
ওটা ছিল মালয়শিয়ার ওটা ছিল সয়া থেকে তৈরী দুধ।
প্রথম যেদিন দেখলাম, মালয় মাঠা ভেবে এক গ্লাস খেয়ে নিলাম। ওটার স্বাদও ছিল দারুণ। আর পরে তো নিয়মিত খেতাম। সোয়া রিংগিত নিতো তার দাম।
 
এক গ্লাস আমার চাই-ই চাই যখনই যাই কুয়ালা লামপুরের চায়না টাওন।
 
আমেরিকায় বলতে গেলে রাস্তার পাশে বা খোলা বাজারে কোন খাবার বিক্রি হয় না; সবই প্যাকেটজাত। আর এদেশের মানুষ হলো কফি খাওয়া পাবলিক।
 
স্টার বাক বা ডানকিন থেকে এক গ্লাস হট বা কোল্ড কফি ৫/৭ ডলার দিয়ে কিনে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে হেঁটে, সাবওয়ে ট্রেনে বা বাসে কিংম্বা নিজের গাড়ীতে বসে খেতেই থাকবে।
 
আমার ওসব পোষায় না।
 
গেল সামারে একদিন সকালে ক্যাসেল হিল সাবওয়ে ষ্টেশন এ ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় আছি নীচে দেখলাম এক স্প্যানীশ সাদা দুধের মতো কি যেন গ্লাসে করে বিক্রি করছে।
 
কিন্তু আমার তাড়া ছিল- চোখের দৃষ্টি মনের ক্ষুধা বাড়িয়ে দিল।
আর খুঁজে পাইনি সেই স্প্যানীশ দুধওয়ালাকে।
 
এরই মধ্যে একদিন কে যেন বলল, জ্যামাইকা এভিনিউর ভেতরে রিসমন্ড হিলে কোথায় যেন এক সাউথ ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে খাবারের সংগে পানির পরিবর্তে আনলিমিটেড মাঠা দেয়।
 
আমি আর দেরী করিনি। চলে গেলাম একদিন।
খেলাম। কিন্তু ওরা মুল মাঠাকে এতটাই পাতলা করে ফেলে যে সেটা পানি খাচ্ছি না মাঠা খাচ্ছি তা ঠিক মতো বুঝতে পারিনি।
 
নিউ ইয়র্কে সামার যেন আসেই না!
ইদানিং মাঝে মধ্যে শীত একটু কম থাকে। আজও তাই ছিল।
 
ম্যানহ্যাটনের টাইমস স্কোয়ার থেকে আমার অফিস মুভ করে জ্যাকসন হাইটস চলে এসেছি তাও বেশ কয়েক মাস। রুজভেল্ট এভিনিউ এন্ড জ্যাকসন হাইটসের সেভেনটি থার্ড ষ্ট্রিট-টি থার্টি সেভেন এভিনিউ পর্যন্ত বাংলাদেশীদের নিয়ন্ত্রণে। আমার অফিস সেভেনটি সিক্স ষ্ট্রিট এ। অপরদিকে এইটি সেকেন্ড ষ্ট্রিটটিতে আধিপাত্য করছে স্প্যানীশরা।
 
ঐ এইটি সেকেন্ড-এ ই ব্যাংক অব আমেরিকার একটা ব্রাঞ্চ রয়েছে।
কিছু নগদ টাকা তোলার দরকার ছিল, হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম একটু আগে।
 
রুজভেল্ট আর এইটি সেকেন্ড এর মোড়টাতেই দেখি এক স্প্যানীশ মহিলা সেই সাদা পানীয় বিক্রি করছে। ব্যাংকের কাজ শেষ করে ফিরে এলাম এই স্প্যানীশ মহিলার কাছে।
 
এরা ইংলিশ জানে না।
আমিও স্প্যানীশ জানি না।
নাহ, সরি। ভুল করলাম। আমি দু’টি স্প্যানীশ ওয়ার্ড জানি। একটা হলো দেখা হলে বলতে হবে, ‘হোলা হোলা’। আর বিদায় নেবার সময় বলতে হবে ‘আস্তা মাইয়ানা’, মানে আবার দেখা হবে।
 
যাই হোক, আমি স্প্যানীশ মহিলাকে স্প্যানীশ আর বাংলা মিলিয়ে বললাম, ‘হোলা হোলা। আমাকে এক গ্লাস মাঠা দাও তো। দাম কতো?’
 
স্প্যানীশ মহিলা আমার কথা বুঝতে পারলো! বললো, ‘টু ডলার এন্ড থ্রি ডলার’।
 
আমি এক গ্লাস নিয়ে ‘আস্তা মাইয়ানা’ বলে ‘স্প্যানীশ মাঠা’ খেতে খেতে আমার অফিসে চলে আসলাম।
   Send article as PDF