২৭শে মার্চ ২০২০

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখার সুযোগ আমার হয়নি।আসলে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও অনেকটা পড়েই এসছিলাম এই পৃথিবীতে; কিভাবে দেখবো?

প্রচন্ড রকমের স্বাধীনচেতা মানুষ আমি। যখন যা ইচ্ছে তাই করি; পরোয়া করি না কাউকেই। আমার বাবা ছিলেন ভীষন রকমের কড়া ও রাগী একজন মানুষ, তার সামনে পান থেকে চুন খসলেই খবর হয়ে যাবে ভয়ে সবসময় চুপষে থাকতে বাধ্য হতাম। তারপরও একবার দু’বার যে বিদ্রোহ করে উঠিনি সেটাও নয়- রক্তে স্বাধীনচেতা বিষয়টা না থাকলে বিষয়টা বোঝা সম্ভব না কারো পক্ষে।

কারো শাসন বা অধীনতা কোন কালে মেনে নিতে পারিনি বিধায়, এবং পারবোও না বলে কোনদিনই চাকুরীও করা হয় নি। ভাগ্য অবশ্য কোনকালেও আমার সংগে আহামরি কোন বিপক্ষে যায়নি; তাছাড়া একবার দু’বার যাও যাবার চেষ্টা করেছে বা কদাচিত গেলেও কৌশল ও বুদ্ধি খাটিয়ে ভাগ্যকেও বাধ্য করেছি আমার স্বপক্ষে পরিচালনা করতে। তাই-ই বা কম কিসে?


কোন কালেও যেহেতু পুলিশী কোন জামেলায় পরিনি বা মামলা বা গ্রেফতার হয়নি, জেল খাটিনি সুতরাং স্বাধীনতায় সেভাবে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়নি কোন কালেও।


প্রায়ই ভাবতাম, যারা জেলে আটকে থাকে বহুবছর তারাও তো কিছুটা একাকী সময় উপভোগ করতে পারে; কিছু ভাবতে পারে নতুন করে, নতুন কিছু গবেষনা করতে পারে।
আমি প্রচুর ভ্রমন করে থাকি, নেশার মতোই। ঢাকা যখন থাকতাম তখনতো বলতে গেলে প্রতি সপ্তাহেই দেশের বা বিদেশের কোথায় না কোথাও যেতামই। যখনই ২ বা ৩ দিনের বেশী সময়ের জন্য ঢাকার বাইরে গিয়ে থাকতাম তখন অনেক মজার মজার ভাবনা আসতো মাথায়। অনেক সময়ই সেসব ভাবনাগুলো আমার ব্যবসায়ের মুলধন হয়ে উঠতো।


বলছিলাম প্রচন্ড স্বাধীনচেতা মানুষ আমি।বিন্দুমাত্র পরাধীনতাও আমি মেনে নিতে পারি না, মেনে নিই না। স্বাধীনভাবে কথা বলবো, স্বাধীনভাবে ভাববো, ভাবনা-কাজে-চিন্তায় স্বকীয়তা বজায় রাখাই আমার নেশা। কেউ আমার স্বাধীনতা বাগড়া দিতে এলে আমি সেটা মেনে নিতে পারি না। কেন পারিনা সেটাও জানি না, জানার চেষ্টাও করি না।


আমেরিকায় আসার পর বুঝলাম আমার বিগত জীবনের ‘স্বাধীনতা’ নামের যেসব চিন্তা-চেতনাগুলো ছিল আসলে সেসব স্বাধীনতা কোন স্বাধীনতাই ছিল না। লোক দেখানো মুলা লুকানো ছিল সেসব স্বাধীনতার ভেতরে। এই দেশের মাটিতে পা দেবার পর আরও বুঝতে পারলাম, শিখলাম, আবিস্কার করলাম প্রকৃত স্বাধীনতা শব্দটিকে।


এই স্বাধীনতার স্বাদই আলাদা। অসীম ক্ষমতাশালী মনে হয় নিজেকে।
এমন স্বাধীনতা না থাকলে একজন মানুষ নিজেকে কখনওই ‘মানুষ’ ভাবতেও শিখে না। স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আমি উপলব্ধি করি আর নিজের লেখায় মাঝে মধ্যেই তা তুলেও ধরি। আমার পাঠকদের অনেকেই অবাক হয়, ‘কৈ এমন কথা তো কোন কালেও শুনিনি!’ বিস্মিত হয়। হবারই তো কথা, আমিও তো এসব কথা আমেরিকা আসার পূর্বে কোথাও জানতে পারিনি, কেউ জানায়নি।


স্বাধীনতার কথা আজ বলতে বসিনি।আজ লিখতে বসেছি স্বাধীনতাহীনতার কথা, কিন্তু লিখতে পারছি না। সত্যি আমি লিখতে পারছি না যে স্বাধীনতাহীনতার কষ্ট কতটা নির্মম। কতটা ভয়াবহতম হতে পারে।


আমেরিকা যোদ্ধাদের দেশ। সে গল্প তো অনেকবারই করেছি। এই দেশের প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে যুদ্ধের ইতিহাস। যেখানেই যাই, যে শহরেই যাই সেখানেই দেখি কতকত যুদ্ধের গল্প কথা। কত কত ফোর্ট, যা ব্যবহৃত হতো যুদ্ধের কালে। বৃটিশদের তৈরী ফোর্ট, স্প্যানিশদের তৈরী, ফরাসীদের তৈরী আর আমেরিকানদের তো এখন তার সবই কিন্তু স্মৃতি মুছে ফেলা হয়নি কোনটারই। নায়াগ্রা ফোর্টে শুধুমাত্র ফোর্টটিকেই অক্ষত রাখা হয়নি, সেই ফোর্টের ভেতরে ঢুকলে ২৫০ বছর আগের বৃটিশ লাইভ সোলজারদেরও বানিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের সংগে ছবি তোলা যায়, তাদের সংগে গল্প করা যায়, সেসব রাইফেল উচিয়ে তোলা যায়, কামানের পেছনে দাঁড়িয়ে একজন বৃটিশ সোলজারকে নিয়েও ছবি তোলা যায়।


এই যোদ্ধা দেশটি কিছু মাস আগে তাদের ‘মহাশূণ্য বাহিনী’ বা স্পেসফোর্সও তৈরী করেছে যারা কাজ করবে এয়ারফোর্স আর নাসার সমন্বয়ে।


এরম একটা যোদ্ধাদের দেশ সারাবছরই নানা যুদ্ধে জড়িয়েই থাকে। এই বিশাল পৃথিবীর প্রায় ২০০টি দেশের মধ্যে ১৫০টিরও বেশী দেশে রয়েছে আমেরিকান সেনারা আর স্থায়ীভাবে ৭০টি দেশে রয়েছে আমেরিকান সেনা ঘাটি। আমেরিকা যুদ্ধ করে বিদেশের মাটিতে। এদের নিজেদের মাটি অনেক শক্ত। এখানে আর কোন যুদ্ধ হয় না। এই মাটিতে কেউ মিসাইল ফেলার সাহস করে না এতটাই শক্ত মাটি এখানে।


এই শক্ত মাটিতে বসেই আমি যখন লিখছি এই আর্টিকেলটি, তখন আমি গৃহবন্দি একজন মানুষ এবং এই আমেরিকার শক্ত মাটিতেই। এই পৃথিবীর ফিনান্সিয়াল হাব, পৃথিবীর রাজধানী হিসাবে পরিচিত নিউ ইয়র্ক শহরটি আজ অবরুদ্ধ।


আজ ৭ দিন হয়ে গেল ঘর থেকে বের হবার ক্ষমতা আমার নেই, সাহস আমার নেই। আমার মেডিকেশনের সব ওষুধ শেষ হয়ে গেছে, সেটা যে আনতে ফার্মাসীতে যাবো- সেই সাহসটুকুও সঞ্চয় করে উঠতে পারছি না। এই পৃথিবীর সবচে শক্তিশালী মাটিতে আজ আমি সবচে অসহায় গৃহবন্দি একজন মানুষ মাত্র।


মাস দুয়েকের খাবারের জন্য বাজার করে রেখেছি, যথেষ্ঠ খাবার ঘরে মওজুদ আছে; ইউএস গভর্ণমেন্ট এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ১২০০ ডলারের চেক পাঠাবে- শুনতেছি বাসা ভাড়াও নাকি দিতে নাও হতে পারে, তারপরও আজ কতটা ‘অসহায়’ আমরা।
সামান্য একটা ‘ভাইরাস’ যাকে খালি চোখে দেখাও যায় না।সেই অতি সামান্য একটি ভাইরাস এই পৃথিবীর সুপারপাওয়ার আমেরিকাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। ৮৫ হাজার মানুষকে আক্রমন করেছে সামান্য মাত্র ২ সপ্তাহ সময়ের ব্যবধানে। আজ সারাদিনেই মারা গেছে ২৫০ জন তরতাজা মানুষ- যাদের এতটা অসময়ে মারা যাবার কথা ছিল না, অন্তত আমেরিকার মাটিতে তো নয়ই। মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে মাত্র। প্রতি ২ দিনে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যাচ্ছে। কাল হয়তো সংখ্যাটা ১১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে, পরশু দিন ১৫০ হাজার হলেও অবাক হবো না। তারপর ৩০০ হাজার, তারপর হ্যাফ এ মিলিয়ন! ওহ মাই গড! ভাবতে পারছি না।


আমি বাসা থেকে বের হচ্ছি না। আমার শহর নিউ ইয়র্ক। ৮.৬ মিলিয়ন মানুষ মাত্র এই শহরটিতে বসবাস করছি আমরা। আজকের হিসাবের আউট অফ ৮৫ হাজার, আমাদের শহরেই আক্রান্ত ৫০ হাজারেরও বেশী।


৮.৬ মিলিয়ন মানুষের জন্য আর কয়টা হসপিটাল লাগে? কতজন ডাক্তার লাগে? কতজন নার্স লাগে? প্রয়োজনের চেয়ে কিছু বেশীই ছিল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ এই শহরটিতে। কিন্তু সেই শহরে যদি একসংগে নিয়মিত রোগীদের পাশাপাশি আরও ৫০ হাজার বাড়তি রোগী হঠাৎই চাপিয়ে দেয়া হয়- তখন কোত্থেকে আসবে বাড়তি ডাক্তার? কোত্থেকে আসবে বাড়তি নার্স?


আর এমন একটি রোগ- যার কোন চিকিৎসাও আবিস্কৃত হয়নি।কতটা অসহায় আজ নিউ ইয়র্ক- চিন্তাও করা অসম্ভব। আর এই অসম্ভব চিন্তার শহরটিতে গৃহবন্দি আমি নিজে। আমার হাতে এখন অগাধ সময়। কোন কাজ নেই, সারাদিন সিএনএন দেখি। প্রতি ঘন্টায় কতজন নতুন মানুষ আক্রান্ত হলো, মৃত্যুর তালিকাটা আনুপাতিক হারে বেড়েই চলছে- শুধু দেখি আর সংখ্যা গুনি। এটাই কাজ।


এমন এক অবসর, কোন ভাবনাই জাগ্রত হয় না নতুন করে।আমারচেও অসহায় মানুষগুলোর আর্ত্মনাদ শুনি। বন্ধু-আত্মীয়দের ফোন পাই, জানতে পারি কেউ মারা গেছে গতকাল; কোথাও পুরো একটা ফ্যামেলীই আক্রান্ত হয়ে বাসায় আটকে আছে; এম্বুলেন্স এসে দেখে গেছে কিন্তু কোথায় নিয়ে যাবে- জায়গা তো নেই! নেই প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নেই নার্স, নেই পর্যাপ্ত বেড, ভেন্টিলেটর। চিকিৎসক মারা যাচ্ছেন, নার্স মারা যাচ্ছেন আক্রান্ত হয়ে।


দু’টো শীপ হসপিটাল পাঠিয়েছে ইউএস নেভী। বিশাল জ্যাকভ জেভিথ সেন্টারকে বানানো হয়েছে হসপিটাল, অনেকগুলি বড়বড় হোটেলকে বানানো হয়েছে অস্থায়ী হসপিটাল; সাজানো হয়েছে বেড দিয়ে, কিন্তু পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স কে দিয়ে যাবে লিমিটেড মানুষের এই দেশটিতে?


‘যদি স্বাসকষ্ট খুব বাড়ে- তাহলে আবারও নাইনওয়ানওয়ান এ কল দিবে, আমরা এসে নিয়ে যাবে’। এম্বুলেন্স কর্মীদের শেষ কথা যেন এটাই; আপাতত বাসাতেই থাকতে হবে।
একাত্তরের যুদ্ধ আমি দেখিনি, প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর্তনাদ আমি শুনিনি, হিটলারের ইহুদী নিধন গল্পের মতো পড়েছি, ইরাকে আফগানিস্তানে আমেরিকার মিজাইল হামলা টিভিতে মুভির মতোই দেখেছি। থানা হাজতে বা জেল খানার কোন অভিজ্ঞতা নিতে পারিনি, কিন্তু আজ যে অভিজ্ঞতার মধ্যে বেঁচে রয়েছি- সেটা যে-কোন যুদ্ধকেও পরাজিত করার জন্য যথেষ্ঠ।


যুদ্ধে তো অস্ত্র থাকে, বিমান থাকে, বর্ম থাকে, ব্যাংকার থাকে, সাইরেন বাজে শত্রুপক্ষের হামলার আগে; প্রস্তত থাকা যায়, মারো না হয় মরো- একটা সাহস থাকে।
কিন্তু এ কেমন যুদ্ধ? শত্রুকে দেখা যায় না, আমার কাছে কোন বর্ম নেই, যুদ্ধাস্ত্র নেই, বিমান, মিজাইল, এটম বোমা সবই আছে কিন্তু হামলা চালানোর ক্ষমতাই আজ নেই।
আজকেই প্রথম আমি যা লিখতে চাচ্ছি তা মাথায় আসছে না, লিখতে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড অসহায় বোধ করছি।


হে আল্লাহ! তোমার কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হবে, তাই করলাম।তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তুমিই করুনাময়।


আমরা তোমার অসহায় বান্দা।আমাদের ক্ষমা করো।

   Send article as PDF