হাঁটা চলা

চলুন হাঁটি।
কতদূর হাঁটতে পারেন আপনি?

যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুর চিড়িয়াখানায় হেঁটে যেতে পারবেন?
অথবা, সদরঘাট থেকে সোজা হেঁটে হেঁটে টংগী? মতিঝিল থেকে ফার্মগেইট কখনও গিয়েছেন হাঁটতে হাঁটতে?

নাহ! কেন কেন? যাননি কেন?
তাহলে জীবনে আর কি-ই-বা দেখলেন?

আমি হাঁটতে ভালোবাসি। প্রচুর হাঁটি। এখনও।
যখন পিচ্চি বয়সে স্কুলে পড়তাম, আমার বাড়ী থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিল ১ মাইল। শীতকালের সময়টাতে হেঁটেই যেতাম। মে মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নদীতে পানি থাকতো এবং সেই সময়টা লঞ্চে করে আসা যাওয়া করতাম। কিন্তু বাদবাকী সময়টাতে পায়ে হেঁটে যাবার কোন বিকল্প ছিল না।

স্কুল ছুটি হতো ৩.৪০মিনিটে।
ঠিক ২০ মিনিটে দৌড়ের গতিতে হেঁটে বাসায় পৌছে যেতাম। কোন তাড়া ছিল না, কোন কাজেও নেই। কিন্তু তারপরও কত দ্রুত বাড়ীতে পৌছতে পারি- সেটাতেই ছিল আনন্দ।

ব্যবসা শুরু করার প্রথম দিককার দিনগুলোতে কাজের চাপ খুবই কম থাকতো। আমার এক বোনের বাসা ছিল যাত্রাবাড়ী অন্যজন মিরপুরে। আমি বেশ কয়েকবার যাত্রাবাড়ী থেকে পায়ে হেঁটে মিরপুর ১০ নাম্বার চলে গেছে। ঘন্টা তিনেক সময় লাগতো। যাত্রাবাড়ী থেকে টংগীতে মামার বাসায়ও একদিন গিয়েছিলাম হরতালের মধ্যে হেঁটে হেঁটে।

হাঁটায় কিন্তু অনেক আনন্দ।
ফুটপাতের বিভিন্ন খাবার দেখা যায়, বিভিন্ন হকার, অনেককিছুই। যার সংগে হয়তো আমার কোন কালেও পরিচয় হবে না। হবার সুযোগ নেই। কিন্তু আমার হয়েছে। ঢাকা শহরের বেশকিছু ফুটপাতে বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল এর সামনে বা গ্রীনরোড, নিউ মার্কেটের সামনে ছোট ছোট মিষ্টি ‘দানাদার’ (ছোট বালুশা বা অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নাম) বিক্রি হয়। খেয়ে দেখবেন, অসাধারণ। ঢাকার কোন মিষ্টির দোকানেও আপনি এই অমৃত্য খুঁজে পাবেন না। পথে হাঁটতে হাঁটতে বরফ শীতল লেবুর শরবত বা তাজা কচকচে পেয়ারা কিনে খান। এসব কোথায় পাবেন বলুন তো?

নিয়মিত হাঁটলে অবশ্য আরও বেশী বেশী আনন্দ যোগ হতে পারতো, কিন্তু তা আর পেরে উঠলাম না তো। যতটুকু হেঁটেছি- তাও অনেক। সেসব স্মৃতি কি ভোলা সম্ভব?

ওহ, আর একবার- বন্ধু মাহাবুব কে নিয়ে গিয়েছি কক্সেসবাজার, জীবনের প্রথমবার। হিমছড়ি গেলাম জীপে করে। ঘুড়লাম, বেড়ালাম, দেখলাম, হাবিজাবি কি যেন খেলামও। তারপর যখন ফিরবো- জীপে উঠার আগ মুহূর্তে মাহাবুবকে বললাম, ‘চল হেঁটে হেঁটে ফিরবো; জীপে যাবো না। জীপে গেলে তো আসল সৌন্দর্য্য আবিস্কারের সুযোগ পাবো না।’

ব্যস, মাহাবুব তো আমার সব কথাতেই রাজী। হাঁটা শুরু করলাম দু’বন্ধু। বঙ্গপোসাগরের তীর ঘেসে হেঁটে চলছি কক্সেসবাজারের দিকে- রাস্তা তো আর শেষ হয় না। অসাধারণ সুন্দর আমাদের দু’পাশ। অদ্ভুত এক উত্তেজনা। এমন সুযোগ কজনের জীবনে আসে?

কিন্তু কিছুক্ষন পরই হাঁটার রাস্তাও যেন তলিয়ে যাচ্ছে সাগরের উঁচু উঁচু ঢেওয়ে। জোয়ার। আগে তো বুঝিনি যে ওই সময়টাতে জোয়ার আসে। খুব সাবধানে সেই উঁচু জোয়ারের ঢেউ এর সংগে মিতালী গড়ে কক্সেসবাজারে ফিরতে ফিরতে প্রায় আধো সন্ধ্যা।

দেশের বাইরে যখন যেতাম, হোটেলে ঢুকে ফ্রেস হয়ে, হালকা কিছু খেয়ে নিতাম। তারপর আর ক্লান্তির কাছে পরাজিত হয়ে ঘুমিয়ে ঠান্ডা হতে চাইনি কখনও। রিসিপ্টশন ডেক্স থেকে হোটেলের ১টি নেইম-কার্ড নিয়ে যে দিকে দু-চোখ যায় হাঁটা শুরু করে দিতাম।

টানা ১ থেকে দেড় ঘন্টা হাঁটতেই থাকতাম, হাঁটতেই থাকতাম; কখনও বা আরও বেশী।

তারপর এক সময় হারিয়ে যেতাম। যখন বুঝতাম হারিয়ে গেছি এবং বড় বেশী ক্লান্ত আমি। তখন একটি ট্যাক্সি বা রিক্সা নিয়ে হোটেলে ফিরে আসতাম। আর হাঁটার সময় স্থানীয় খাবারগুলো যে কি তৃপ্তি দেয়- তা প্রকাশ করার মতো ভাষা আমি সত্যিই জানি না।

বেইজিং এর ফুটপাতে সন্ধ্যায় হাঁটছিলাম।
সাইকেলে করে কিছু ছেলে মেয়ে সামনে এসে থামে। ওরা তো ইংলিশ জানে না, আর আমি জানি না চাইনিজ। সুতরাং ওরা আমার সংগে চাইনিজে প্রশ্ন করে আর আমি বাংলায় উত্তর দিই। ওরা ইশারা ভাষাও বুঝে না। তাছাড়া ওরা যেহেতু ইংলিশও বুঝে না বাংলাও বুঝে না সেহেতু আমিই বা কোন দুঃখে বাংলা বাদ দিয়ে ইংলিশ বলতে যাবো- সবই তো এক।

কিন্তু মজার বিষয় হলো আমি ওদর বুঝে ফেলতাম, ওরাও আমাকে।
ওরা এডাল্ট সিডি বিক্রি করে। চায়নাতে এসব অবৈধ। আমি ওদের সংগে মজা করতাম।

গুয়াংঝুতে (ক্যান্টনে) একবার হাঁটছি। সানি আলী থেকে হাঁটা শুরু করে কোথায় গিয়েছি জানি না। দু’টো মেয়ে আমার কাছে এসে ভিক্ষা চাচ্ছে। তাদের দাবী তারা কিছু খেতে পারছে না, প্রচন্ড ক্ষুধার্থ তাদের ৫ আরএমবি সাহায্য চাই।

মজার বিষয় ছিল মেয়ে দুটোর বয়স ছিল ১৫ বা ষোল। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আরি- এরা আমার সংগে চমৎকার ইংলিশে কথা বলছে! আমি হতবাক। চায়নাতে তো চাইনিজরা ইংলিশ জানেও না বলেও না। এই বাচ্চা মেয়েদুটো ইংলিশ বলছে কিভাবে? আবার ইংলিশে ভিক্ষাও করছে।

আমি ওদের কাছে ডাকালাম। বললাম, ‘তুমি এতো সুন্দর ইংলিশ জানো অথচ ভিক্ষা করছো কেন? তুমি তো যে-কোন অফিসে গেলেই ভালো বেতনে চাকুরী পেয়ে যাবে; তোমার আসল সমস্যাটা কি- বলো তো শুনি। মিথ্যে বলবে না, পুলিশ ডাকবো কিন্তু।’

যাষ্ট এতটুকু শুনেই ওর মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলো, ৫ আরএমবি দিতে চেয়েছিলাম- কিন্তু সেটাও না নিয়েই পালালো। কিছুই বুঝলাম না।

গুয়াংঝুতে প্রচুর মুসলিমের বসবাস।
অনেক জায়গাতেই ফুটপাতে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। ভালোই লাগতো দেখতে।

কুনমিং এ-ও প্রচুর হেঁটেছি। ফুলে ফুলে সাজানো শহরটিতে হাঁটার মজাই আলাদা। ফুটপাতে চাইনিজ ষ্ট্রিট আর্টিষ্টরা ৫ আরএমবির বিনিময়ে আপনার ছবি একে দিবে। এমনটা নিউ ইয়র্কে সেন্ট্রাল পার্কেও দেখা মিলে- এখানেও ইমিগ্রান্ট চাইনিজরা। তবে, ঐ ৫ আরএমবির জায়গায় টাকাটা হয়ে যায় ৫ ডলারের বিল।

সুকুমভিত থেকে চায়না টাওন হেঁটে যেতেও কমচেকম ১ ঘন্টা লেগে গেলো।

প্রচুর ফল বিক্রি হয়ে ওখানটাতে। রাতে দিনে- দু’দিন হেঁটেছি; রাতের এবং দিনের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। অসাধারণ ছিল সেই হাঁটাহাঁটি।

মসজিদ জামেক থেকে কতকত বার যে প্লাজা রাকায়েত, বুকিত বিনতাং, সেন্ট্রাল, পুডারায়া আর টিটিওয়াংসা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করেছি- তার কোন ইয়েত্তাই তো নেই। ফুটপাতে ছোট প্লাস্টিক এ কেটে রাখা ফলগুলো খেতেও দারুন। ১.২৫ রিংগিত নিতো, এখন কত নেয় জানি না।

কলিকাতা, লক্ষ্ণৌ, দিল্লীকে আমার সবসময় নিজের শহর মনে হতো। ঢাকায় যেভাবে হাঁটাতাম, এই তিন শহরেও সেভাবেই হাঁটতাম। হেঁটেছি। ফুটপাতের খাবারগুলো আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো যেন। তবে, প্রচুর ডাস্টের কারনে তেমন কিছু খেতাম না।

তখন আমি ডালাস থাকি।
ডালাস মানে প্রকৃত ডালাস না; আমার সিটির নাম আর্লিংটন।

আমেরিকায় তখনও আমি নতুন; মাত্র ৮ মাস হলো- কোন কাজ কর্ম করছি না; কি করা যায় তাই-ই শুধু হিসাব মিলাচ্ছিলাম তখন। আমার তেমন কোন কাজকর্ম নেই। বাইরে তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠে। ডালাসের গরমের তীব্রতা বর্ণনা করাও কষ্টকর। সৌদী আরবের মরুভূমির চেয়েও কঠিন গরম এখাটাতে। সূর্যের আগুনটা যেন সরাসরি শরীরের স্কিনটা পুড়ে দিয়ে যায়। তখন আমি আমেরিকায় নতুন, ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই গাড়ীও নেই। অভিজ্ঞ পা দু’টোই একমাত্র সম্বল। ওই শহরে বাস বা ট্রেন যোগযোগ ব্যবস্থাও সীমিত। আমার বাসা থেকে সবচে কাছের মুদি দোকান (ছোট ওয়ার্লমার্ট) এর দূরত্ব প্রায় আড়াই মাইল- হেঁটে আসা যাওয়া তা ৫ মাইল হয়ে যেত।

যাই হোক, আমার জন্য ওসব কোন সমস্যাই না।
একদিন একটা কাজে যাবো- জায়গাটার নাম ম্যান্সফিল্ড, জিপিএস ধরে দেখি- দূরত্ব প্রায় ১১ মাইল। হেঁটে গেলে সময় লাগবে প্রায় ৪ ঘন্টা। অর্থাৎ আসা যাওয়ায় ৮ ঘন্টা আর দূরত্ব পরবে ২২ মাইল।

২২ মাইল আর এমন কি দূরত্ব। কিলোমিটারে দাঁড়ায় মাত্র ৩৫ কিলোমিটার।

সিদ্ধান্ত নিলাম হাঁটি। একটা ছাতা নিলাম। তারপর ঠিক সকাল ৯টায় বাসা থেকে বের হলাম। আমেরিকায় মানুষ জগিং করে, কিন্তু এভাবে কেউ হাঁটে না। সকলেরই গাড়ী আছে- শুধুমাত্র আমার নেই। তাই হাঁটছি।

রাস্তায় ফুটপাত (সাইডওয়াক) নেই, আমি রাস্তার পাড় ঘেঁসে হাঁটছি।
মজাই লাগছে। অনেকট দূর পরপর শপিং মল দেখা যায়। টেক্সাস এমনিতেই জনবিরল অঞ্চল। আমি হাঁটছি। কোন দিকেই আমার কোন খেয়াল নেই।

যাই হোক, পৌনে ৪ ঘন্টায় আমি আমার জায়গা মতো পৌছে গেলাম, সেখানে মাত্র ১০ মিনিটের কাজ ছিল। হয়ে গেল। এতক্ষনে কোন পানি খাইনি। একটা দোকান থেকে ৩ বোতল ঠান্ডা পানি এবং ২ বোতল ম্যাংগ জুস কিনে নিলাম। ২ বোতল পানি এবং ১ বোতল জুস খেয়ে ফেললাম তখনই। আবারও আরও ৩ বোতল পানি এবং ২ বোতল জুস নিলাম।

তারপর হাঁটা শুরু করলাম বাসার পথে।
এবার যেন আর পারছিলাম না। শরীরে আর কত কুলাবে। মাথার উপর সুর্য আমার সংগে মসকরা করছিল যেন। সে তার নিজের গতিতে ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট (৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) আগুন দিয়ে আমাকে পোড়াচ্ছিল। কিন্তু আমি যে হার না মানা মানুষ। পেরে উঠছিল না ঠিকঠাক- আমাকে দমাতে।

মেফিল্ড এলাকায় কি যেন ছোট একটা পার্ক আছে।
ওই পার্কটির একটা বড় গাছের ছায়ায় আমি বসে পরলাম। তারপর আর মনে নেই।

ঘুমিয়ে পরেছিলাম না জ্ঞান হারিয়েছিলাম সেটা আজও জানি না। প্রায় তখন ৫টা বাজে যখন জেগে উঠলাম। তাড়াতাড়ি ২ বোতল পানি খেলাম। তখনও প্রচন্ড গরম। তবে, শরীরটা এবার বেশ লাগছিলো। আরও প্রায় মিনিট ৩০ বসে থাকলাম গাছের ছায়ায়। আমেরিকায় এই একটা মজার বিষয়, এখানে ভ্যাপসা গরম নেই। যত গরমই হোক, কোন গাছের বা ভবনের ছায়ায় দাঁড়াতে পারলে আর গরম লাগে না।

এরপর আবার হাঁটা শুরু করলাম। বাসায় ফিরলাম সাড়ে ৬টায়।
এখনও হাঁটি। সুযোগ পেলেই হাঁটি। আর প্রতিদিনের আমার রুটিন হাঁটা কমপক্ষে ১৫,০০০ ষ্টেপস; সমস্যা হয়ে যায় শীতের মাসগুলোতে।

হাঁটবেন- আমার সাথে?
চলুন।

   Send article as PDF