গ্রামীন ফোন

ঢাকাতে যখন ব্যবসা করি- তখন আমার খুব ইচ্ছে হলো একটা ‘সুপার-বিউটিফুল মোবাইল নাম্বার’ ব্যবহার করার। কিন্তু কোথায় পাই?
 
গ্রামীন ফোনের ভাষায় প্লাটিনাম নাম্বার।
মানে ৭টি নাম্বার একই রকম বা সিরিয়ালের।
 
আমার বন্ধু আমানউল্লাহ চৌধুরী একটা অতি চমৎকার নাম্বার ব্যবহার করে- আমার সংগে তার সম্পর্কটা খুবই গভীর ও হৃদ্যতাপূর্ণ।
 
একদিন আমান ভাইকেই আমার শিশুতোষ মনের কথা ব্যক্ত করে রিকোয়েষ্ট করলাম একটা নাম্বার এরেঞ্জ করে দিতে। তিনি আমাকে কথাও দিলেন।
 
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সেটা ছিল ২০০৫ সালের দিকের ঘটনা।
হঠাৎই একদিন আমান ভাই আমাকে কল দিয়ে জানতে চাইলেন আমি অফিসে কি না?
 
হ্যাঁ বলাতে বললেন, তার একটা ছেলে আমাকে একটা প্যাকেট দিয়ে যাবে। আমি যেন প্যাকটটা নিয়ে তাকে কল দিই।
 
কি প্যাকেট দিতে পারে ভাবতে পারছিলাম না।
প্যাকেটটি খুললাম।
এবং একটি গ্রামীন ফোনের সীম কার্ড।
 
আমান ভাইকে ফোন দিলাম।
ওনি বললেন আমার মোবাইলে সীমাকার্ডটি ঢুকিয়ে যেন তাকে ফোন দিই।
 
আমি সীমকার্ডটি আমার মোবাইলে ঢুকিয়ে দেখতে পেলাম একটি সুপার বিউটিফুল নাম্বার ০১৭২-৪৫৬৭৮৯০!
আমান ভাইকে ঐ নাম্বার থেকে কল দিয়ে ধন্যবাদ দিলাম- মনে রাখার জন্য গিফট দেবার জন্য।
 
কিন্তু যেহেতু নাম্বারটি আমার নিজের নামে না- সেহেতু একটু বিব্রত ছিলাম এই নাম্বারটি ব্যবহার করা ঠিক হবে কি না? আমি একটি স্থায়ী নাম্বারে বিশ্বাসী। নাম্বার পরিবর্তন করা আমার পছন্দ না।
 
আমান ভাই একদিন জানতে চাইলেন- কেন নাম্বারটি ব্যবহার করছি না?
আমার বিব্রত বোধের কারণটি বলাতে ওনি আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বললেন।
 
আমি প্রায়ইটি নাম্বারটি ফোনে ঢুকিয়ে কাছের বন্ধুদের ফোন দিই, কথা বলি- সকলেই নাম্বার দেখে চমকে উঠে! আমি অানন্দ পাই। সে এক দারুণ আনন্দ।
 
বেশ কয়েক মাস পর আবার আমান ভাই আমাকে কল দিলেন, বললেন- ‘আপনি আপনার জাতীয় পরিচয় পত্র ও দুই কপি ছবি নিয়ে ফার্মগেট গ্রামীন ফোন সেন্টারে চলে যান- নাম্বারটি আপনার নিজের নামে ট্রান্সফার করে নিবেন। আমার একটা ছেলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে।
 
আমি মুহুর্তেই চলে গেলাম এবং ঐ ‘বিখ্যাত’ নাম্বারটি নিজ নামে রেজিষ্ট্রেশন করিয়ে নিলাম। এবার মনটা শান্ত হল। পুরাতন নাম্বারটি বের করে নতুন নাম্বারটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং সকলকে পার্সোনালী টেক্সট করে নতুন নাম্বার জানিয়ে দিলাম।
 
নতুন ভিজিটিং কার্ডে নাম্বারটি প্রিন্ট করে ফেললাম এবং বেশ ভালই লাগছিল।
 
এরপর এলো ২০১০ সাল। অর্থাৎ প্রায় বছর পাঁচেক পর।
 
গ্রামীন ফোনের ১২১ থেকে একটা কল আসলো।
আমাকে বলা হলো, ‘এটা একটা প্লাটিনাম নাম্বার। আপনি এই নাম্বারটি ব্যবহার করতে পারবেন না। নাম্বারটি আগামীকাল বন্ধ হয়ে যাবে’।
 
আমার মাথায় আকাশ ভেংগে পড়লো যেন! ব্যাটা বলে কি? আমার নাম্বার বন্ধ করবে!
 
এবং পরদিন, বুধবার ঠিকই দুপুর দু’টার পর আমার মোবাইলে আর নেটওয়ার্ক দেখতে পেলাম না। মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। অফিসের ল্যান্ড ফোন থেকে আমার নাম্বারে ফোন করলাম।
 
রিং হচ্ছে। একটা ছেলে ফোন ধরলো।
জানতে চাইলাম, ‘ভাই নাম্বারটি কোথায় পেলেন?’
উনি জানালেন, ‘গ্রামীন ফোন থেকে কিনেছি।’
তাকে বিস্তারিত বললাম এবং অনুরোধ করলাম যে আপনাকে নাম্বারটি দিয়েছে তাকে বলে যেন আমার নাম্বারটি ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু সে দেখলাম আরও এক ডিগ্রী উপরে! আমাকে মনে হলো ধমক-ধামক-হুমকী ইত্যাদিও দিল।
 
কিন্তু সমস্যা হলো- আমি তো থেমে যাবার মতো মানুষ নই।
যে-কোন কিছুরই শেষ পর্যন্ত দেখা মানুষ।
 
আমার রেজিষ্ট্রেশন পেপার, এনআইডি এবং কিছু ব্যবসায়ীক নথি নিয়ে মতিঝিলের সিটি সেন্টারে গেলাম।
 
ওখানে সব ‘ভদ্রলোক’রা বসবাস করে।
একই সংগে ওনারা তোতাপাখিও।
 
আমার অভিযোগ শুনলেন। আমাকে বললেন ঠিক আছে আপনি সপ্তাহ খানেক ওয়েট করেন- দেখেন ঠিক হয়ে যাবে।
 
আমি ওদের উত্তরে বিরক্ত হলাম।
কড়া ভাষায় বললাম, আমার লিখিত কমপ্লেইন নিবেন, আমাকে কপি দিবেন। এবং স্পেসিফিক জানাবে কবে সমস্যাটির সমাধান করবেন।
 
ছেলেটা বুঝতে পারলো- আমাকে হাল্কা কথায় উড়িয়ে দিতে পারবে না।
সে বাধ্য হলো তার বসকে ডাকতে এবং আমার লিখিত কমপ্লেইন নিল তার নিজের নাম, পদবীসহ স্বাক্ষর করে।
 
আর কি কি করা যায় ভাবছি।
মন ভাল না। আমাকে কেউ কল করে পাচ্ছে না।
 
আরও বেশী বিরক্ত কারণ ঐ নাম্বারে যে-ই কল দিচ্ছে ওপান্ত থেকে বলা হচ্ছে ‘উনি তো আমার কাছে এই নাম্বারটি বিক্রি করে দিয়েছেন’। মানে আমি টাকার অভাবে পরে নিজের মোবাইল নাম্বার বিক্রি করে দিয়েছি! কি ডেঞ্জারাস কথা!
 
মনে মনে একা পণ করলাম।
যে-কোন মূল্যে এই নাম্বারটি আমাকে ফেরত নিতেই হবে।
গ্রামীন ফোনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম মনে মনে- যা থাকে কপালে।
 
আমি হেরে যাবার মানুষ নই।
প্রয়োজনে সব কাজ বাদ দিয়ে হলেও এই নাম্বারটিই আমাকে ফেরত পেতে হবে।
 
আমার একটা ‘বদমাইশ’ এডভোকেট ফ্রেন্ড আছে।
ওকে ফোন করলাম অফিসের নাম্বার দিয়ে। বিস্তারিত জানালাম। এডভোকেট সাহেব বললেন সন্ধ্যা অবধি অফিসে থাকতে- সে আসবে আমার অফিসে।
 
এবং তিনি আসলেন।
বিস্তারিত শুনলেন শুরু থেকে আজ অবধি।
 
অতপর উনি বললেন, ‘আমাকে ৩০ দিনের মধ্যেই আমার নাম্বার ফেরত দেবার বাবস্থা করে দেবেন।’
 
আমার কেন যেন খুব বিশ্বাস হলো- সে কাজটা করতে পারবে।
 
আমার কাছ থেকে আমার মোবাইল এর রেজিষ্ট্রেশন কপিটি নিল এবং আমার কিছু ব্যবসায়িক কাগজপত্র ও এফবিসিসিআই এর কিছু ডকুমেন্ট নিল। ৫০০০ টাকা নিয়ে চলে গেল।
 
দু’দিন পর সে আমার অফিসে আবার আসলো।
আমাকে তার তৈরী করা একটা ‘উকিল নোটিশ’ দেখালো। সে নোটিশ করেছে সংগে মামলা করার হুমকী দিয়ে গ্রামীন ফোনের ৪জনকে।
 
ফার্মগেইট গ্রামীন ফোন সেন্টারের যে এক্সিকিউটিভ আমাকে রেজিষ্ট্রেশন পেপারটি স্বাক্ষর করে দিয়েছিল সে চার নাম্বার।
মতিঝিল সিটি সেন্টারের যে এক্সিকিউটিভ আমার কমপ্লেইনটি স্বাক্ষর করে রেখেছিল- সে তিন নাম্বার।
গ্রামীন ফোনের জেনারেল ম্যানেজার তিন নাম্বার এবং গ্রামীন ফোনের সিইও কে করেছে প্রথম নোটিশ গ্রহিতা।
 
আমাকে এডভোকেট সাহেব জানালো, দু’সপ্তাহের নোটিশ দিচ্ছে এবং ঠিক দু’সপ্তাহ পর কোর্টে এই চারজনের নামে মামলা করা হবে। এবং এই চারজনকে কোর্টে শশরীরে গিয়ে জামিন নিতে হবে।
 
এবং, গ্রামীন ফোনের জিএম এবং সিইও ঢাকার কোর্টে গিয়ে জামিন নিবে- সেটা ঘটার আগেই না কি আমি আমার নাম্বারটি ফেরত পাবো।
 
আমি জানতে চাইলাম, নিরীহ এক্সিকিউটিভ ছেলে দু’টিকে জড়ানোর কি দরকার ছিল?
তার উত্তর, এরা নোটিশ পেয়ে ভয়ে আঁতকে উঠবে এবং তাদের অফিসে হুলুস্থল পরে যাবে এবং বিষয়টি উপরে মহল জানতে পারবে- ওদিকে উপর মহল নিজেরাই রয়েছে এই অতি সামান্য একটি বিষয় নিয়ে বিপদে!
 
সুতরাং, এডভোকেট সাহেবের মতে- বিজয় আমার সুনিশ্চিত।
 
ঠিক ২ সপ্তাহ পর হঠাৎ গ্রামীন ফোন থেকে আমার অফিসের ল্যান্ডফোন নাম্বারে কল আসলো। একজন নিজে তার পরিচয় দিলেন এবং আমাকে অনুরোধ করলেন গ্রামীন ফোন এর গুলশান অফিসে গিয়ে দেখা করতে। আমার সমস্যাটি সমাধান করা হবে। আমাকে অন্য একটা প্লাটিনাম নাম্বার দেয়া হবে- তবুও আমি যেন আমার উকিল নোটিশ প্রত্যাহার করে নিই।
 
আমি স্পষ্টতঃ জানিয়ে দিলাম, আমার নিজের নাম্বার ছাড়া অন্য কোন নাম্বার আমি নেবো না।
 
পরের দিন আবারও ফোন পেলাম গ্রামীন ফোন থেকে।
তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাকে আমার নাম্বারটিই ফেরত দিবে। আমি যেন গুলশানে যাই ওদের অফিসে।
 
আমি জানিয়ে দিলাম, আমি গ্রামীন ফোনের অফিসে যাবো না। এবং তাদেরকে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে হবে এই কৃত অপরাধের জন্য এবং আমার অফিসে এসে আমার নাম্বারটি দিয়ে যেতে হবে।
 
গ্রামীন ফোন আমাকে আমার কথা মতো নতুন একটা রেজিষ্ট্রেশন ডকুমেন্ট তৈরী করে দিল এবং মৌখিকভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলো।
 
আমি ক্ষমা করে দিলাম।
এবং উকিল নোটিশ প্রত্যাহার করে নিলাম।
   Send article as PDF