পারসিভেরেন্স রোভার

প্লানেট মঙ্গলে পাঠানো পারসিভেরেন্স রোভার নিয়ে এতোটা হৈচৈ কেন বিজ্ঞান-মহলে?

নাসা তো এর আগেও আরও ৪-টি সাকসেসফুল রোবটিক মিশন মঙ্গলে পাঠিয়েছে যেগুলি যথাক্রমে সোজার্নার ( Sojourner), অপুর্চুনিটি (Opportunity), স্পিরিট (Spirit), কিউরিওসিটি (Curiosity)। রোভারগুলি সাফল্যের সংগে চষে বেড়িয়েছে মঙ্গলের মাটি। পাঠিয়েছে এই পৃথিবীতে নানা ছবি, তথ্যাদি।

তখন তো এতটা হৈচৈ দেখিনি? তাহলে কেন এতোটা আগ্রহ, এতোটা কৌতুহল এবারের এই পার্সিভেরান্স (Perseverance) নিয়ে?

কারণ, উত্তরটাও বেশ আশাব্যঞ্জক।
আমেরিকার জোর চিন্তা ভাবনা চলছে মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর। নাসার দায়িত্ব সেই চিন্তাকে বাস্তব রুপ দান করা।

আজ থেকে অর্ধশতবছর আগেই নাসা জয় করেছে চাঁদ, ৬-ছয় বার (১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে (Apollos 11, 12, 14, 15, 16, and 17)) চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে আমেরিকা। প্রতিটি মানুষই চাঁদ গিয়ে আবার আমাদের পৃথিবীতে ফেরত এসেছেন। সর্বমোট ১২-জন এসট্রোনাটস চাঁদে পদার্পন করেছেন। আমেরিকার জন্য সে এক বিরাট সাফল্য। পৃথিবীর অন্য কোন দেশ চাদের মাটিতে মানুষ পাঠানোর সাফল্য অর্জন করতে পারেনি অদ্যাবধি।

চাঁদে বার বার মানুষ পাঠানো বিপুল খরচের ব্যাপার এবং সেখান থেকে পাবার কিছু নেই বিধায় আমেরিকার গত ৫০ বছরে নতুন করে আর কোন ম্যান মিশন চাঁদে পাঠায়নি। তবে, ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২ এর মতো আগ্রাসী মিশন এখনও অব্যহত আছে। আমরা জানি ভয়েজারস এখন আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মাইল দূরে ছুটে চলছে, দূর থেকে আরও দূরে। নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে পৃথিবীর সংগে। আমার দৃষ্টিতে ভয়েজার্স মুন মিশনের চেয়েও বেশী সফলতা দেখাতে পারছে।

শনি গ্রহের চাঁদ টাইটানের মাটি স্পর্শ করেছে আমেরিকার হাইজিন্স রোভার – দেখেছে মিথেনের নদী, মিথেনের বৃষ্টি, ঝড়। সেও এক চমকপ্রদ আবিস্কার, সাফল্য। ৩ কোটি মাইল দূরবর্তী গ্রহানুর পিঠ থেকে চিলের মতো ছৌ মেরে তুলে এনেছে গ্রহানুর মাটি।

নাসা এই পর্যন্ত ২০০’র উপর মহাকাশ মিশন পরিচালনা করেছে এবং তার মধ্যে সম্পূর্ণ সাকসেসফুল মিশন ছিলো ১৩৫টি। নাসা এই পর্যন্ত ২০০+ নভোচারীবাহী মহাকাশ মিশন মহাশূন্যে পাঠিয়েছে নাসা এবং তার মধ্যে থেকে মাত্র ২-টি মিশন (চ্যালেঞ্জার ও কলম্বিয়ায় ৭ জন করে) ব্যর্থ হয়ে মারা গেছে ১৪-জন এসট্রোনটস।

যাই হোক, নাসা এখন অনেক অভিজ্ঞ।
বিশাল অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত বিধায় মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর বিষয়ে চিন্তা থাকলেও সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হচ্ছিল। অবশেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ক্ষমতাকালে নতুন করে আবারও চাঁদে ও মঙ্গলে নভোচারী পাঠানোর সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনী বাজেট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছিলেন। তৈরী করেছে বিশ্বের প্রথম ‘ইউএস স্পেস-ফোর্স’।

ওদিকে বেসরকারী মহাকাশ গবেষক ইলন মাস্ক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তিনি মঙ্গলে একটি শহর তৈরী করবেন যেখানে মানুষ বসবাস করবে; এছাড়া তিনি আগামী ২০৩০’র মধ্যেই মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। অবশ্য নাসার চিন্তা ২০৪০ নাগাদ। দেখা যাক কে আগে সফল হয়? নাসা না স্পেস-এক্স?

তো, মুলত মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসাবেই এবার নাসা মঙ্গলে পাঠিয়েছে পার্সিভেরান্স রোভরকে।

রোভারটিতে বেশ কিছু টুলস দিয়ে সজ্জিত করা রয়েছে।
তার মধ্যে সবচে মজার টুলসটি হলো মোক্সিফ (MOXIF)। আমরা জানি মঙ্গলে খুবই পাতলা বায়ুমন্ডল রয়েছে। মঙ্গলের বায়ুমন্ডল আমাদের পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের তুলনায় ১০০ ভাগের ১ ভাগ পাতলা। এবং সেই বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইড এর পরিমাণ ৯৬%।

মোক্সিফ এর কাজ হচ্ছে সেই মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডলের কার্বন-ডাইঅক্সাইডকে ৮০০ সেলসিয়াস উচ্চতাপমাত্রায় ভেংগে তা থেকে অক্সিজেন বের করে নেয়া। যদি মোক্সিফ এতে সফল হয়, তাহলে নাসা শিগগিরই পর্যাপ্ত অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য মঙ্গলে আর বড় বড় মিশন পরিচালনা শুরু করবে। এবং সেই তৈরীকৃত অক্সিজেন ব্যবহার করা হবে মঙ্গলের মহাকাশযান (স্পেসক্রাফট) এর জ্বালানী হিসাবে। মিলিয়ন মিলিয়ন টনস অক্সিজেন তৈরী করা হবে মঙ্গল গ্রহে। মানুষ যখন মঙ্গলে যাবে- মানুষকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করা হবে সেখান থেকেই। খুবই দূরদর্শি চিন্তা-ভাবনা এটি।

এবং সেই উৎপাদিত অক্সিজেন আবার মঙ্গলের পরিবেশে উম্মুক্ত করে দেয়া হবে- বায়ুমন্ডল পরিবর্তন করে দেবার লক্ষ্যে।

মোক্সিফ এবার পরীক্ষামূলকভাবে ১০ গ্রাম অক্সিজেন উৎপন্ন করে দেখবে- আমাদের চিন্তা সঠিক পথে এগুচ্ছে কি না। আমরা শিগগিরই তার ফলাফল জানতে পারবো।

এছাড়া রোভারটি যেখানে অবতরণ করা হয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে যে সেখানে একসময় বড় একটি লেক ছিল যা পানিতে পরিপূর্ণ ছিল। রোভার এই ধারণাটি সত্য কি না সেটাও যাচাই করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (টুলস) সংগে করে নিয়ে গেছে। অপেক্ষা শুধুই পরীক্ষার।

বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, মঙ্গলের মাটির নীচে এখনও বরফে জমাটবদ্ধ পানির অস্তিত্ব রয়েছে। সেটাও যাচাই করে দেখা হবে। আর দেখা হবে সেই মাটিতে কোটি কোটি বছর আগে সত্যিই কোন প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো কি না। বা এখনও কোন এককোষী প্রাণ রয়েছে কি না মঙ্গলে?

এছাড়া রোভারটি এবার মঙ্গলের মাটি খুঁড়ে মঙ্গল-মাটির বেশ কিছু স্যাম্পল (৩৮-টি টিউবে করে) সংগ্রহ করে রোভারে স্থাপিত নিজস্ব রকেট দিয়ে সেই স্যাম্পল পৃথিবীতে পাঠাবে আরও বিস্তারিত গবেষনার জন্য।

অপুর্চুনিটি নামের যে রোভারটি মঙ্গলে পাঠানো হয়েছিল- আমরা জানি সেটা মঙ্গলের উপর্যুপুরি ডাষ্ট (ধুলা ঝড় হওয়ায়) এ নির্ধারিত সময়ের আগেই পৃথিবীর সংগে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল।

সেই ডাষ্ট মঙ্গলের জন্য এক মহাসমস্যা। সেখানে প্রায়ই ডাষ্ট-স্ট্রোম হয়। আর সেজন্যই এবার মেডা (MEDA) নামের একটি ইলেকট্রনিক সেন্সর সংযুক্ত করা হয়েছে পারসিভেরান্স রোভারের মধ্যে। মেডার কাজ হবে পরীক্ষা করে দেখা যে কতটা ডাষ্ট রয়েছে মঙ্গলের আবহাওয়ায়, কিভাবে এটি তৈরী হয় এবং এথেকে মুক্তির উপায় কি হতে পারে? আগামীতে যখন মানুষ পাঠানো হবে মঙ্গলে তখন যেন এই ডাস্ট থেমে মানুষ রক্ষা পায় সেটা নিয়ে গবেষনা করা।

এছাড়াও পারসিভেরান্সে রয়েছে ইনজিউনিটি নামের ১.৮ কেজি ওজনের একটি হেলিকপ্টার (মার্সকপ্টার)। কয়েক দিন বাদেই ঐ মার্সকপ্টারটিকে উড়ানো হবে। হেলিকপ্টারটির ব্লেড প্রতি মিনিটে ২৫০০ বার ঘুড়বে। আগেই বলেছি মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পৃথিবীর তুলনায় ১০০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। সে কারণে সেখানে হেলিকপ্টার উড়ানো একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমাদের পৃথিবীর বাইরে এই প্রথম মঙ্গলের আকাশে উড়ানো হবে হেলিকপ্টার।

হেলিকপ্টারটি যদি সাফল্যজনকভাবে উড়ানো যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে মঙ্গলের জন্য এরিয়াল মার্স মিশন (Aerial Mars Mission) শুরু হবে। তৈরী করা হবে কমপক্ষে ১ মাইল উড়ে যাওয়া সম্ভব এমন বিমান বা হেলিকপ্টার- উড়বে মঙ্গলের আকাশে। ভবিষ্যতের নভোচারীরা সেই হেলিকপ্টারে বা বিমানে উড়ে বেড়াবে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে।

অর্থাৎ মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনার জন্য এটি একটি সূদুর প্রসারী এবং দূরদর্শি মার্স মিশন।

আগামী এক দশকের মধ্যে পৃথিবীর মানুষ নতুন প্লানেটে নতুন ঠিকানা খুঁজে পাবে এমনটাই আশাবাদী আমি।

আমরা জানি ১৪৯২ সালের ১২ই অক্টোবর ক্রিষ্টোফার কলম্বাস ইওরোপ (স্পেন) থেকে পশ্চিম দিকে সমুদ্রপথে যাত্রা করে ইন্ডিয়া আবিস্কার করতে গিয়ে আবিস্কার করে ফেলেন দু’টি বিশাল মহাদেশ; যেটাকে বলা হতো ‘নতুন পৃথিবী’।

ক্রিষ্টোফার কলম্বাস তার যাত্রা শুরু করেছিলেন ১৪৯২ সালের ৩রা আগষ্ট।

ভাবুন তো ঠিক সেই সময় স্পেনের রানী তথা স্পেনবাসীর মনের কেমন অবস্থা ছিল যখন সত্যি সত্যিই ভয়ংকর আটলানটিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে নতুন কিছু আবিস্কারের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন কলম্বাস?

বিষয়টা কি অনেকটা ঠিক তেমন নয়?
১৪৯২ সালে আমি এই পৃথিবীতে ছিলাম না। কিন্তু ২০২১ (সাড়ে ছয়শত বছর পর) সালের এই আমি নতুন পৃথিবী দেখার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

শুধুমাত্র ১৩০ মিলিয়ন মাইল দূরত্বের, ৬ মাসের যাত্রাপথের মঙ্গলের মাটি নয়; আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি ৫৮৭ আলোকবর্ষ (লাইটইয়ার) দূরের কেপলার (Kepler-22b) গ্রহে মানুষের অবতরণ দেখতে।

   Send article as PDF