এক কাপ স্পেশাল চায়ে

সৌরভ আমাকে দেখে চমকে উঠলো! অবশ্য, চমকানোরই কথা।
‘তুমি? আজ? সিরিয়াস কিছু?’ খুব দ্রুত কথাগুলি বলল আমাকে উদ্দেশ্য করে।
‘হ্যাঁ, সিরিয়াস তো অবশ্যই নইলে কি আমাকে এখানে আজ দেখার কথা?’
‘তোমার রোগী কেমন এখন? কেবিন-এ দিয়েছো? তুমি লক্ষ্নৌ এসেছো কবে? ঈদ কি এখানেই করেছো?’
‘হ্যা, রোগীর অবস্থা বেশী খারাপ হয়ে যাওয়ায় গতকাল আর্জেন্ট আসতে হয়েছে।’
‘ওহ মাই গড! তাহলে তুমি তো কোরবানীর মাংসই খাওনি। আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়ীতে তোমাকে আসতে হবে। এড্রেস নাও, সিভাজি পুরাম আমার বাড়ী। তুমি ক্রান্তি নগর এর বিকে কনভেন্ট ইন্টার কলেজ এর গেটে পৌছে আমাকে আমাকে কল দিবে, আমি পিক করবো তোমাকে।’ সৌরভ ওর বাড়ীর এড্রেস লিখে আমার হাতে কাজে ধরিয়ে দিল।
 
সৌরভ লক্ষ্নৌ’র ছেলে।
কিং জর্জ মেডিকেল এর ক্যাম্পাসে ওর একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। সকালের দিকে ও বসে এছাড়া ওর আরও দু’জন কর্মচারী রয়েছে। ওর দোকানে ‘টি মেকিং মেসিন’ এ দুধ চা তৈরী করে বিক্রি করা হয়। চা বানানোর কৌশলটাও সুন্দর। এবং দ্রুত।
 
সৌরভকে আমি ঐ চায়ের দোকানের মালিক হিসাবেই জানি। চা ছাড়াও ওর দোকানে প্যাসিট, স্যান্ডউইচ আর সিংগারা পাওয়া যায়। ঐ দোকানের পনির-ভেজিটেবল স্যান্ডউইচটা মূলত ভেজ’দের খাবার। ওটাই আমার বেশী পছন্দ। সৌরভ আর ওর কর্মচারী সবাই জানে আমি ঐ দোকনে একটা পনির সেন্ডউইচ আর এক কাপ দুধের স্পেশাল চা খেতেই যাই।
 
সৌরভের সংগে এরচে বেশী কোন পরিচয় আমার নেই।
ওহ হ্যা, সৌরভ মুসলিম এটা ও নিজেই বলেছে এবং ওর মোবাইল নাম্বারটা নিজ থেকেই আমাকে দিয়ে রেখেছে। ব্যস এটুকুই।
 
ওর আন্তরিকতায় সিদ্ধান্ত নিলাম, কোরবানীর মাংস খেতে ওর বাসায় যাবো।
 
লক্ষ্নৌতে আমি থাকি সাধারণত নাকা চৌরাহা’র আমিনাবাদ হোটেলে। সন্ধ্যায় অটো নিয়ে ক্রান্তি নগর পৌছেই সৌরভকে মোবাইলে ফোন দিলাম। আমাকে ৫ মিনিট অপেক্ষা করতে বলর এবং ঠিক ৫ মিনিটেই ও চলে আসলো।
 
অটো ছেড়ে দিয়ে ওর মোটর বাইকে বসলাম।
বিশাল একটা অট্রালিকার সামনে মোটর বাইক থামলো আমাকে নিয়ে। বাড়ীর একপাশে নীচ তলায় একটা ‘টি শো-রুম’। শো-রুমটি যথেষ্ঠ বড়। আমাকে ঐ শো-রুমের ভেতরের অফিস রুমে নিয়ে বসতে দিল।
 
বয়স্ক একজন ভদ্রলোক। আমি সালাম দিলাম।
ভদ্রলোক নিজের নাম বলে আমার সঙগে কোলাকুলি শেষে নিজের পরিচয় দিলেন। উনি সৌরভের বাবা।
 
সৌরভ আমাকে অফিসে রেখে ভেতরে চলে গেল। ওর বাবার সংগেই আমি কথা বলছি।
ওনার মূল ব্যবস্থা এই ‘চা’। চা সম্পর্কে ভদ্রলোক আমাকে প্রায় ২০ মিনিটের একটা লেকচার দিলেন- আমি অনুগত ছাত্রের মতো ওনার মনোমুগ্ধকর লেকচার শুনলাম।
 
চায়েরও যে একটা বিশাল জগত রয়েছে- আমি অবাক হলাম।
কোন চা’র কিরকম স্বাদ, কোনটা দিয়ে দুধ চা আর কোনটা দিয়ে রং চা খেতে হবে- সেটাও আমাকে জানালেন, শিখালেন। কেনই বা দুধ ও রং চায়ের জন্য আলাদা আলাদা রকমফের সেটাও জানলাম।
 
সৌরভ পিঠা, কোরবাীনর গরু ও ছাগলের মাংসের মশালা এবং বিরিয়ানী রেডী করে আমাকে ভেতরে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেল।
 
খাবার শেষ করে আবারও সেই ভদ্রলোকের রুমে এসে বসলাম।
এবার তিনি চা কোথায় কোথায় উৎপন্ন হয় এবং আসামের চা কেন শ্রেষ্ঠ তারও ব্যাখ্যা দিলেন। সেই সংগে দার্জিলিংসহ সাউথ ইন্ডিয়া, সিলেট (বাংলাদেশ), পাকিস্তান অঞ্চলের চা-ই যে বিশ্বের সবচে ভালো চা সেটাও বুঝালেন।
 
ওনি বছরে প্রায় ২০ কোটি রুপির চা বিদেশে এক্সপোর্ট করে থাকেন।
এছাড়া পুরো ভারতবর্ষে তো তার নিজস্ব কোম্পানীর মার্কেট আছেই।
 
আমার কৌতুহল বেশী। প্রশ্ন করতে গেলাম- কিং জর্জ মেডিকেল এ ঐ ছোট চা’র দোকানটি কেন? কিন্তু তার আগেই তিনি উত্তর দিয়ে দিলেন।
 
কিং জর্জ মেডিকেল এবং রাজধানী নয়া দিল্লীর পার্লামেন্টভবন সহ উত্তর প্রদেশ, দিল্লী, হরিয়ানাতে ওনার সর্বমোট এরকম ৮টি চায়ের দোকান রয়েছে। এই দোকানগুলি মুলতঃ ওনার মার্কেটিং এ কাজে লাগে।
 
আমি সত্যিই ওনার মার্কেটিং প্লানে অবাক হলাম। দূরদর্শি চিন্তা।
 
যাই হোক, এবার ওনি ওনার অন্যান্য বিজনেস সম্পর্কে বলা শুরু করলেন।
ওনার প্রতিষ্ঠিত একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে ইন্দ্রা নগরে। সেই সংগে ওনার সাম্প্রতিক সংযোজন গাড়ীর টায়ার ইন্ডাষ্ট্রিজ। টায়ার থেকে উনি খুব ভালো ব্যবসায় আশা করতেছেন। সেই সংগে উনার একটা গাড়ীর শো-রুমও রয়েছে গোমতী নগর।
 
ফেরার সময় ভদ্রলোক আমাকে বিভিন্ন চায়ের গন্ধ, কার্যকারিত ও মূল্য সম্পর্কে জ্ঞান দিলেন।
 
ন্যূনতম ৬০ রুপি কেজি থেকে শুরু করে ৪৫০০ রুপি কেজি মূল্যের হরেক রকমের চা রয়েছে ওনার শো-রুমে।
 
আমাকে ৩০০ রুপি কেজি মূল্যের এক কেজি চা দিলেন- শুধু রং চা করে খাবার জন্য।
এবং ৬০০ রুপি কেজি মূল্যের এক কেজি চা দিলেন- দুধ চা হিসাবে খাবার জন্য।
 
ঢাকায় ফিরে ঐ চা খাবার পর বাংলাদেশের আর কোন চা খেয়ে সত্যিই আমি মজা পেতাম না।
 
শুধু চায়ের একটু তৃপ্তির জন্য একবার চলে গেলাম মৌলভীবাজার এর শ্রীমংগল।
অনেক খুঁজে একটা চা পেলাম যেটা ওখানে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। আমি বেশ কয়েকবার শ্রীমংগল থেকে ঐ চা কিনে এনেছি। ওটাও দারুণ ছিল।
 
আসলে এই আর্টিকেলটি লেখার একটা উদ্দেশ্য রয়েছে।
অনেকেই আমার কাছে ব্যবসায়ের আইডিয়া চায়- ইনবক্সে বা বিভিন্ন ভাবে।
 
আমি এমনিতেই একজন দুর্দান্ত আইডিয়া-বাজ।
আমার মাথায় সারাক্ষনই বিভিন্ন আইডয়া টগবগ করতে থাকে।
 
এটা একটা ফ্রি আইডিয়া শেয়ার করলাম।
 
বাংলাদেশে চা’র জন্য অনেকগুলি কোম্পানী রয়েছে- লিপটন, তাজা, ফিনলে ইত্যাদি।
কিন্তু লজ্জাজনক বিষয় হলো- এই কোম্পনী গুলি শুধু মাত্র ‘চা’ বিক্রি করে।
মানেটা হলো, চা মানে চা।
এর কোন রকম ফের নেই।
 
খন্দকার টি’র মালিক রুহুল আমিন ভাই আমার বন্ধু। ওনার অফিসে গেলে- ওনি সবসময় নিজ হাতে বড় একমগ চা তৈরী করে আপ্যায়ন করেন। ওনার পরিবেশনাটা অত্যন্ত আন্তরিক, আধুনিক এবং পেশাদারিত্বে পূর্ণ। কিন্তু রং চা আমি সবসময় পছন্দ করি না।
 
চা যদি খাই-ই, তাহলে বেশী করে দুধ চিনি দিয়েই খাবো। সংগে কিছু মশলা থাকলে তো কথাই নেই।
 
চায়নাতে প্রতিটি অফিস, রেষ্টুরেন্ট বা বাড়ীতে সর্বপ্রথম চা দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। অফিসগুলিতে চায়ের পরিবেশনা অসাধারণ। চায়ের জন্য আলাদা আকষর্ণীয় কেতলী, বক্স আরো কিসব রয়েছে। চমৎকার আভিজাত্য সেখানে এক চা কে কেন্দ্র করে।
 
ভারত ও পাকিস্তানের ফুটপাতে এক কাপ ‘স্পেশাল চায়ে’- তুলনাহীন।
 
এই নিউ ইয়র্কে এসেও আমি মজাদার এক কাপ চা খেতে ভারতীয় বা পাকিস্তানী রেষ্টুরেন্ট খুঁজি।
 
যাই হোক, এখন আপনি যদি আপাপতঃ দুই রকমের প্যাকেটে দুই রকম চা তৈরী করে দুধের সংগে খেতে হলে ‘দুধ চা’ এবং শুধু চা’র জন্য ‘রং চা’ ও সেই সংগে ‘গ্রীনটি’ আইডিয়া নিয়ে মার্কেটে আসেন- বাজিমাত করতে পারবেন নিশ্চিত।
 
মনে রাখবেন, বাংলাদেশে যে কোন নতুন আইডিয়ার নিয়ে দ্রুত নেমে পরতে হবে। নতুন কেউ বুঝে উঠার অাগেই আপনাকে পুরো মার্কেট ধরে ফেলতে হবে প্রচুর বিজ্ঞাপন এবং সহজ সরবরাহের মাধ্যমে।
 
একবার এগিয়ে যেতে পারলে আর কেউ আপনাকে থামাতে পারবে না।
 
বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ চায়ের দোকান রয়েছে, রং চা, দুধ চা দুটোই বিক্রি হয়; অথচ কোথাও গ্রীন টি বা দুধের সংগে মসলা চা পাওয়া যায় না।
 
সবকিছুতেই আমাদের বৈচিত্র’র এতো অভাব কেন- আমি বুঝি না।
   Send article as PDF