সভ্যতায় বসবাস!

বিদেশ ভ্রমণ বা অন্য কোন অনেক বিষয়ে-ই উদাহরণ টানলে আমি সাধারণতঃ হংকং প্রসংগ তুলি।
বাস্তবতা হলো, হংকং আমাকে অনেক বিষয়েই চোখ খুলে দিয়েছিল।
হংকং এর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
 
এটাও প্রথম হংকং ভ্রমণেরই কথা।
হংকং ভ্রমণের আগ পর্যন্ত আমি ভারতের দিল্লী, কোলকাতা, গোরাকপুর, নৈনিতাল এবং নেপালের কাঠমান্ডু, সোনেয়ালী আর পশুপতিনাথ ভ্রমণ করেছি। ওহ, সরি- ভারতের শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, সিকিমের গ্যাংটক, নাথুলা চায়নিজ বর্ডারও দেখেছি।
 
বাস্তবতা বলে- ভারত, বাংলাদেশ বা নেপালের আর্থ সামজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আহামরি কোন পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন।
 
সুতরাং বিদেশ ভ্রমেণের ‘সেভাবে’ বললে কোন অভিজ্ঞতা আমার ছিল বলে আমার মনেই হয়নি- হংকং যাবার পর।
 
‘সেই অর্থে’- হংকংই ‘আমার দেখা’ সত্যিকারের ‘প্রথম বিদেশ’।
 
সুবিশাল এয়ারপোর্ট।
একপাশে সাগর আর একপাশে পাহাড়।
 
ভোড়ের আকাশ থেকে নীচে তাকিয়ে সাগরের নীল জলরাশির উপর চলমান সাদা পালের ও ইঞ্জিন চালিত বোটগুলি-ই আমার অবচেতন মনে আমাকেই বলে দিল ‘এ অন্য পৃথিবী’- তোমার চেনা-জানার বাইরের সত্যিকারের বিদেশ!
 
অপরূপ সুন্দর ভোরের সেই আকাশ থেকে নীল সাগরের সংগে মিশে যাওয়া হংকং এয়ারপোর্টটি।
 
কোলকাতায় প্রথম দেখি এসকেলেটর এবং ক্যাপসুল লিফট।
তারও অনেক পর ঢাকার ইষ্টার্ণ প্লাজায় বাংলাদেশের প্রথম এসকেলেটর বসে। কিন্তু ‘চলমান রাস্তা’ আমি প্রথমবার দেখি সেই হংকং এয়ারপোর্টের ভেতরেই।
 
আমি খুব খুশী।
আমি তো সব সময় নতুন কিছুর জন্যই অপেক্ষায় থাকি।
ছোট্ট বাচ্চাদের মতোই অনুভব ছিল আমার। হংকং ভরাই ‘চলমান রাস্তা’।
 
অসংখ্য ফুটপাত দেখেছি চলমান রাস্তা এবং সেই রাস্তা আবার সম্পূর্ণভাবেই শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
 
এসকেলেটর হংকং এর অতি সাধারণ বিষয় যেন!
 
হংকং এ ব্যক্তিগত গাড়ীর সংখ্যা খুবই কম। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এবং সাবওয়ে ট্রেন সার্ভিস অত্যাধুনিক। প্রাইভেট কারের প্রয়োজন কি? এছাড়া রয়েছে সর্বত্র সুবিশাল প্রসস্ত এবং অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ফুটপাত।
ঝকঝকে, তকতকে।
 
আমি হেঁটে বেড়াই।
ভাল লাগাগুলি আমাকে আঁকড়ে রাখে।
 
কিন্তু পরেরদিনই একটা বিষয় হটাৎ আমার দৃষ্টিতে আটকালো।
কেন যেন মনে হলো এসকেলেটর পার হবার সময় ‘অন্যরা’ আমার দিকে যেভাবে তাকায়- তাতে পরিষ্কার ‘আমি তাদের বিরক্তির কারণ’!
 
আমি চিন্তা পরে গেলাম।
কিন্তু আমিতো কখনও কারো বিরক্তির কারণ হতে রাজী নই।
 
আমি কোন আইন অমান্য করছি?
আমি কি এমন কোন পোষাক পরেছি- যা অরুচিকর?
 
নাহ্।
আমি তো কখনওই এমন কিছু করি না।
এসব বিষয়ে আমি সবসময়ই অত্যন্ত সচেতন থাকি।
 
তাহলে?
 
প্রোব্লেমটা কোথায়?
আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে- ‘কেন আমি অন্যের বিরক্তির কারণ হয়ে গেলাম’ এই সুদুর হংকংএ!
 
মাথা ঠান্ডা রাখলাম।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলাম। দ্রুত কারণ অনুসন্ধান করছি।
আমি কারো বিরক্তির কারণ হতে পারবো না! আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে- কি অপরাধ আমার?
 
এবার আবার হাঁটা শুরু করলাম। ওটা ছিল ওয়েন চাই এলাকা। একটা বড় শপিং মল।
এসকেলেটরে উঠতে যাবো- হঠাৎ ‘প্রোব্লেম’টা পেয়ে গেলাম।
 
নিজে নিজে ‘বিজয়ীর হাসি’ হেসে দিলাম।
এরপর আর তো কেউ আমার দিকে বিরক্তির চোখে তাকাচ্ছে না!
 
আসলে খুবই সাধারণ একটা সমস্যা ছিল।
এই সমস্যাটা আমেরিকায় হলে আমি শিখতেই পারতাম না।
 
এসকেলটরে চড়ার নিয়ম জনিত সমস্যা।
আপনি যদি এসকেলটরে দাঁড়িয়ে থাকতে চান- তাহলে আপনাকে ডানদিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
আর যদি আপনার তাড়া থাকে বা দ্রুত যেতে হাঁটতে চান- তো, বাঁ দিক দিয়ে হেঁটে আগে চলে যান-থামবেন না।
 
বিষয়টা আমি পরিষ্কার হয়ে গেলাম। এবং ‘সভ্য’ হয়ে গেলাম।
 
ঐ ভ্রমণ শেষে ঢাকা ফিরবো।
হংকং এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন এর ভেতরে আমি হাঁটছি একা একা!
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, কেউ একজন আমাকে নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। কিছুটা বিস্মিত হলাম।
 
এখানে কে আবার আমাকে ডাকবে?
পেছন দিকে তাকালাম।
 
হ্যাঁ।
মগবাজারের সিয়াম টেলিকম এর মালিক অামার বন্ধু আহাদ। আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকদিন বাদে দেখা। অনেক গল্প।
 
এক পর্যায়ে জানতে চাইলো- ‘প্রথম বার হংকং কি না?’
আমি বললেন, ‘হ্যাঁ, প্রথমবার’।
 
আহাদ উচ্চস্বরে হেঁসে দিল, ‘প্রথমবার হংকং! শালা, তুই প্রথম বার হংকং এসেছিস! শোন, প্রথমবার হংকং ভ্রমণের অর্জন জানিস?’
আমি বললাম, ‘না, কেন!’
আহাদ বলল, ‘প্রথমবার হংকং মানে হলো, ঢাকা ফিরে রাতে বেডে শুয়ে বউ এর নিকট গল্প করা- হংকং অনেক বড় শহর, প্রচুর বড় বড় বিল্ডিং, সাবওয়ে, বিশাল রাস্তা, ১২ আর ৭২ বছরের মেয়ে দেখতে সব একই রকম দেখতে!, এইসব! এরচে বেশী আর কোন অভিজ্ঞতা অর্জন করা কি সম্ভব- বল?’
 
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না।
সব কথার উত্তর দিতে হয় না।
 
ঢাকায় বসুন্ধরা শপিং সেন্টার চালু হলো- প্রচুর এসকেলেটর। আরও অনেক অনেক ভবনে-ই এসকেলেটর বসেছে। কিন্তু, ঢাকার মানুষ কি জানে কিভাবে এসকেলটরে চড়তে হয়?
 
আমি যখনই ঢাকায় এসকেলেটরে চড়তাম- নিজেকে সচেতন রাখতাম, আইন ভংগ করতাম না। কিন্তু কাউকেই দেখিনি তার পরের ১৫ বছরে যে কেউ এই সাধারণ আইনটা জানে। কয়েকবার কয়েকজনকে পার্সোনালী অনুরোধ করতে যেয়ে উল্টো বিব্রত হয়েছি। উৎসাহ হারিয়েছি।
 
অথচ প্রতিদিন হাজার হাজার বাংলাদেশী বিদেশ ভ্রমণে যায়।
চায়না, হংকং, মালয়েশিয়া, দুবাই। কাউকেই দেখিনি- বিষয়টির দিকে খেয়াল দিতে।
 
যে যেভাবে পারে হুরোহুড়ি করি এসকেলেটর পার হতে হবে।
ডান বাম কোন ব্যাপার?
 
আমাকে যেতে হবে- আমি যাবো।
কিসের আইন, কিসের নিয়ম?
 
অপর দিকে আমেরিকার মানুষ অতিরিক্ত পর্যায়ের সভ্য।
এদেশের আপনি কিউই-তে দীর্ঘক্ষন দাঁড়িয়ে রয়েছেন- কেউ একজন সকলকে ওভারটেক করে সামনে চলে গেল- না, এখানে কেউ বিরক্ত হবে না, সামনের জন্য হয়তো একটু মুচকী হাসবে।
 
কেউ ডান বাম না মেনে উল্টা পাল্টা হাটা-চলা করলেও কেউ বিরক্ত হবে না। কিছুই বলবে না- যেন কিছুই হয়নি। তাহলে কিভাবে শিখবেন?
 
মাঝে মধ্যে ‘বিরক্তি’রও প্রয়োজন রয়েছে।
 
না, আজ আমেরিকার কোন কথা বলবো না। শুধুই বাংলাদেশ।
আমরা কোন আইন শিখবো না, সভ্যতা শিখবো না।
এটাই বাংলাদেশীদের ‘পণ’।
 
জেএফকে এয়ারপোর্টে চমৎকার সভ্যতা প্রদর্শনকারী যে বাংলাদেশী সদা সচেতন কেউ বিরক্ত হলো কি না, সেই বাংলাদেশীই ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেই কাকে পেছনে ফেলে কে আগে যাবে- সেই প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়।
 
বাংলাদেশ ভুখন্ডে পা দেবার পর আমরা সকলে অসভ্য হয়ে যাবো- এটাই নিয়ম!
 
অামি যখন ঢাকা থাকতাম, প্রচুর ফোন রিসিভ করতে হতো। আমি হয়তো ভাত খাচ্ছি কিংম্বা মোবাইল বেড রুমে রেখে ড্রয়িং রুমে আছি- এই সময়ে কেউ ফোন করলো। আমি ধরতে পারলাম না। দেখা যায় অনেকেই পরপর ১৫-২০ বার কল দিচ্ছে একটানা!
আরি বাবা, এটা কোন সভ্যতা! একবার ফোন করলেই হয়- আমি যখন ফ্রি হবো মিসড কল দেখে নিশ্চয়ই কল ব্যাক করবো। না, সেটা হবে কেন? অসভ্যতা না করলে কি চলে আমাদের? কার ব্যক্তিগত কোন কাজ রয়েছে কি না, অথবা বাথরুমে রয়েছে কি না- ওসব ভাববার তো কোন প্রয়োজনই নেই।
 
আবার হয়তো দু’একটা ফোন মিসড হয়েছে, বা ১৫ মিনিট পর আবারও কল দিল, ফোন রিসিভ করাতেই ‘আমার ফোন ধরেন না কেন?’
 
আচ্ছা! আমি কি বাথরুমে মোবাইল নিয়ে ঢুকি?
 
বাংলাদেশে এসব অামাদের কমন অসভ্যতা।
 
ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে- অনেকেই আপনার টাইমলাইনে তার নিজের কিছু ট্যাগ করে দিচ্ছে?
কেন?
আমি কেন আপনার টাইমলাইনে ট্যাগ করতে যাবো?
– এটা কোন ধরণের শিক্ষা!
আপনি অনুমতি চাইতে পারেন- আম যদি অনুমতি দিই- তখন করুন!
কিন্তু আপনি অনুমতি চাইবেন কেন?
 
আসলে আমরা সকলেই নিজেকে ‘অনেক ইমপর্টেন্ট’ ভেবে বসে থাকি।
অন্যকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভাবার প্রয়োজনও বোধ করি না। কিংবা, ‘সম্মান’ করতেও রাজী নই।
 
একটা সম্প্রদায় আছে- আরও এক ডিগ্রি এগিয়ে!
এরা কথা নেই, বার্তা নেই; চিনি না জানি না- অনুমতির কোন তোয়াক্কা না করেই হঠাৎ ফেসবুকে কল দিয়ে বসে!
– আরি! এটা আবার কোন ধরণের সভ্যতা!
 
আরেকটা কথা বলি।
অনেকেই দেখি প্রথম পরিচয়ে চট করে আপনি কি করেন? ইনকাম কত? বিয়ে করেননি কেন? সন্তান নেন নি কেন? ঐ টা করলেন না কেন? এটা করতে ভাল হতো! আরও কত কত পরামর্শ এবং প্রশ্ন!
 
ভাইরে, আপনি কে এসব প্রশ্ন করার?
ন্যূনতম সভ্যতা বা শিক্ষা যদি থাকে- ‘অনুমতি চান’, আমার অনুমতি নিয়ে আমাকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেন আমি অখুশী হবো না। ‘অনুমতি’ নিয়ে প্রশ্ন করাটাও একটা সভ্যতা।
 
আবার অপরিচিত অনেককেই এও দেখা যায়, ‘খেজুরে আলাপ’ শুরু করে দেয়।
‘ভাই কেমন আছেন, কি করতেছেন? কোথায় পড়াশোনা করেছেন, কি খেয়েছেন?’
 
আরি বাবা, এসব জেনে আপনি কি করবেন? আমাকে নিয়ে গবেষনা করতে চাচ্ছেন? পিএইচডি করবেন আমার উপর?
করতে চাইলে করেন- আমার আপত্তি নেই; তবে সেটা আমার মৃত্যুর পর না হয় করেন।
 
এতো ব্যস্ত হাবার কিছু নেই।
 
অনেকেই দেখা যাচ্ছে কোন কারণই নেই, শুধুশুধু কেমন আছেন, কোথায় আপনি? কথা বলা যাবে? এসব বাহুল্য কথা! আপনার আমাকে দরকার হতেই পারে। জরুরী কাজ থাকতেই পারে। জরুরী পরামর্শ চাইতেই পারেন।
 
আমার কোন অসুবিধে নেই- আপনি আমার কাছে জরুরী হলে জানতে চান, শেয়ার করেন- কিন্তু অপ্রয়োজনে কেন আমার সময় নষ্ট করবেন? সে অধিকার আপনাকে কে দিল।
 
কাজ নেই, দরকার নেই, শুধু শুধু অযাচিত বিরক্ত করার কি কোন প্রয়োজন রয়েছে?
 
কিন্তু আমি যে ব্যস্ত তা- সেটা অাপনাকে বুঝতে হবে।
আমার ‘ব্যস্ততা’কে আপনার সম্মান জানাতে শিখতে হবে।
 
আমি ইতিমধ্যে অনেককেই ‘ম্যাসেজ ব্লক’ করে রেখেছি। কি করার আছে বলুন?
জাকারবার্গকে কৃতজ্ঞতা, ব্লক অপশনটি দেবার জন্য।
 
আচ্ছা, মনে করেন একটা মেয়েকে আপনার পছন্দ হলো, তাকে আপনি নক করতেই পারেন। সে হয়তো আপনাকে উত্তর দিল বা সুযোগ দিল কথা বলতে।
আপনি প্রথমেই তাকে প্রশ্ন করে বললেন, ‘আপনি কি বিবাহিত?’
 
এটা কিছু হলো?
তারচে আপনি দু’একটা কথা বলে তারপর যদি সুন্দর করে তাকে বলেন, ‘আমি কি আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?’
 
এরপর কিন্তু মেয়েটাও আপনার সুন্দর আচরণে আপনাকে সম্মান জানাবে। এরপর তাকে সীমার মধ্যে থেকে যে কোন প্রশ্ন করেন। সেটা কি একটু বেশী সুন্দর লাগবে না?
 
আপনি কি তা করেন?
সুন্দর করে অনুমতি নিয়ে যে কাউকে অনেক কঠিন প্রশ্নও করা যায়।
 
আসল সত্যটি হলো আমাদের পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা!
আমরা সেখান থেকে ‘সভ্যতা’ শিখিনি। কিভাবে সভ্যতা প্রদর্শন করবো।
 
কিন্তু তাই বলে কি আমরা পরিবেশ থেকেও শিখবো না।
একটু ‘বেশী সভ্য’ হলে কি আমাদের ‘খুব বেশী ক্ষতি’ হয়ে যাবে?
   Send article as PDF