আমেরিকা চায়না ও গণতন্ত্র

আমেরিকা হলো এই পৃথিবীর সবচে চমৎকার একটা গণতান্ত্রিক দেশ। আমেরিকার গণতন্ত্র সম্পর্কে আমি মোটামুটি বুঝে ফেলেছি। আসলে আমেরিকা না আসলে- গণতন্ত্র যে কি বিষয় তা বুঝতেই পারতাম না কোনদিন।
একজন ‘মানুষ’ যে আসলেই ‘একজন মানুষ’ আমেরিকায় এসেই তা শিখলাম। আর, এই একজন মানুষ যে কতটা স্বাধীন, শক্তিমান, সাহসী এবং উদ্যোগী তার সংঘাও জানতে পেরেছি। আমেরিকায় বসবাস না করলে ‘মানুষ’ হয়ে বাচার যে কোন স্বার্থকতা নেই সেই ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত।
এখানে যা খুশি তাই করা যায়, যা খুশী তা বলা যায়। এখানে কোন ঝামেলা হলে মুহুর্তে পুলিশ এসে উপস্থিত এবং তাদের প্রধান কাজ হলো ঘটনাটা সেখানেই শেষ করে দেয়া- যাতে কাউকে থানা বা কোর্টে যেতে না হয়; বাড়তি কোন বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়, টাকা-পয়সা এবং সময় নষ্ট করতে না হয়।
পুলিশ সাধারণ জনগণকে স্যার সম্মোধন করে সেটা অনেকেই জানেন, কিনতু সেদিন দেখলাম একজন জাজও তার আসামীকে ‘হাই স্যার, হাউ আর ইউ ডুইং টুডে’ বলে সম্মধোন করে তারপর সাথে করে তার কোর্ট রুমে নিয়ে গেল বিচার করার জন্য।
অর্থাৎ আমি নিজে একজন মানুষকে ঠিক যে-ভাবে চিন্তা করি; আমেরিকায় এসে ঠিক সেভাবেই আবিষ্কার করলাম নিজেকে।
ভারত এই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। ভ্রমন, চিকিৎসা ও ব্যবসায়ের কারণে আমি প্রায় দুই শতাধিক বার ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে গিয়েছি, স্থানীয় লোকদের সাথে মিসেছি, গল্প করেছি, স্থানীয় পেপার পড়েছি। একথা অনস্বিকার্য যে ভারতের গণতন্ত্র অবশ্যই অত্যন্ত সমৃদ্ধ অন্তত বাংলাদেশের তুলনায়; সেখানকার সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি অনেক বেশী সুসংগঠিত। আমলা শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান; প্রশাসন যথেষ্ঠ শক্তিশালী্ পুলিশ মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত। তারপরও সেখানকার গণতন্ত্র অনগ্রসর। ভারতের মানুষরা এখনও গরুদের পরের অবস্থানে রয়েছে; মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি।
তবে, সবচে চমৎকার যে বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত আকর্ষীক মনে হয়েছে- তা হলো চায়নার সরকার ব্যবস্থা। সেখানে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান। ব্যবসা ও ভ্রমনের জন্য আমি প্রায় ৩৫ বার চায়নার বিভিন্ন প্রভিন্স ভ্রমণ করেছি। চেংদু, কুনমিং, বাওডিং, বেইজিং, জেনান, চিনতাও, সাংহাই, ইউ, ঝেজিয়াং, গুয়াংজু, সেনজিন সহ আরও অনেক অনেক শহর-গ্রামের মানুষের সাথে মিশার সুযোগ পেয়েছি। সাংহাইতে আমার অনেক বড় একটা ফ্রেন্ড সার্কেল রয়েছে যারা আমাকে মজা করে ‘ওল্ড চাইনিজ ক্লাবম্যান’ নামে অবিহিত করে থাকে; আমিও খুব মজা পাই।
চায়নাতে উচ্চুস্বরে কথা বলাটাও একটা অপরাধ। দেশটিতে কোন মিশিল, মিটিং, সমাবেশ, পোষ্টার, দেয়ালে লিখন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সরকারীভাবেই চায়নাতে অনলাইনের সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলি বন্ধ করা আছে।
অপরদিকে চায়নাতেও মোবাইলের সীমকার্ড কিনতে কোন ডকুমেন্ট লাগে না। চায়নাতে আমি উল্লেখযোগ্য কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দেখিনি বা শুনিনি। চায়নাতে রাত ৩টার সময় ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে আপনি অনায়াসে রাস্তায় চলাচল করতে পারবেন। কোন ট্যাক্সিকে হাত ইসারা করলেই সে এসে দরজা খুলে আপনাকে বসতে বলে- গেট লক করে দেবে এবং তারপর ‘নি-হাও’ সম্মোধন করে জানতে চাবে কোথায় যাবেন। এবং সেখানে আপনাকে পৌছে দেবে, একটি ইউয়ানও আমার কাছে বেশী দাবী করবে না বা নেবে না।
কমিউনিষ্ট পার্টি অব চায়না দীর্ঘদিন যাবৎ ক্ষমতায়। কোন উপদল নেই সেটাতে। অন্য কোন দল নিষিদ্ধ। অামি চায়নার অনেকগুলি প্রভিন্সের কমিউনিষ্ট পার্টির টপ লিডারদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। অত্যন্ত সভ্য এবং চমৎকার আচরণ তাদের।
চায়নার সিসুয়ান প্রভিন্সের রাজধানী চেংদুতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে- ‘সিচুয়ান নরমাল ইউনির্ভাসিটি’ যেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার এবং ফ্যাকাল্টি মেম্বার প্রায় ২৩ হাজার। ৮টি নিজস্ব ক্যাম্পাস ইউনির্ভাসিটিতে।আমরা সবচে বৃহত্তম এবং সবচে সুন্দর এই দু’টি ক্যাম্পাসে ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। একটি সিম্পোজিয়ামেও অংশ্রগ্রহন করি সেখানে। প্রধান বক্তা ছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি, মেয়েটির বয়স সবোচ্চ কুড়ি বা একুশ হবে, সে আমানউল্লাহ আমানের মতো বৃদ্ধ বয়সে (চার পাঁচটা সন্তানের পিতা হবার পর ডাকসু ভিপি) হয় নাই।
এক দলীয় রাষ্ট্র চায়নার অনেক সমালোচনা আমেরিকা করে থাকে। আমি বিষয়টিতে একমত না হলেও বিশ্বাস করি আমেরিকার সে যোগ্যতা আছে সারা বিশ্বে মানবতার পক্ষে কথা বলার, নিজ ভুখন্ডের সব মানুষকে প্রকৃত মানবাধিকার দিয়ে সেই যোগ্যতা আমেরিকা অর্জন করেছে।
কিন্তু আমার যেটা মনে হয়, চায়নার মতো দেশের জন্য ‘একদলীয়’ ব্যবস্থাই অনেক বেশী উপযোগী। আমেরিকার জন্য ‘গণতন্ত্র’ আর বাংলাদেশের জন্য ‘একনায়কতন্ত্র’ ব্যবস্থাই সর্বাধিক উপযোগী শাসন ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র বুঝে না, তারা গণতন্ত্র পাবার যোগ্যতাও রাখে না। যে জাতি ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র অর্জন করে- সেই গণতন্ত্র হাসিনা-খালেদার মতো দুই অসভ্য ও মুর্খ মহিলার হাতে তুলে দিতে পারে তারা মানুষ হবার যোগ্যতাও রাখে না।
 
এবং যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ সভ্যতা অর্জন না করবে এবং তোষামদী মানসিকতা ত্যাগ না করবে ততদিন পর্যন্ত একজন সৎ ডিক্টেটরই বাংলাদেশে দরকার। জিয়াউর রহমানের মতো ‘সততা’ এবং এরশাদ বা আইয়ূব খানের মতো ‘কর্মী’ একজন শাসক বাংলাদে্শের জন্য দরকার।
   Send article as PDF