এবং তিন

তখন সম্ভবত ক্লাস সিক্স বা সেভেন এ পড়ছি।
কোন এক রমজান মাসের প্রথম দিন।
 
আমাদের মসজিদের ইমাম ছিলেন মাওলানা দলিলুর রহমান। ওনি এমএম (মোহাদ্দেশ), বিএ এবং পরবর্তীতে সম্ভবত এমএ-টাও কমপ্লিট করেছিলেন। কোরান-হাদিস এবং বিশেষতঃ মাসালা-মালায়েল এর উপর অসম্ভভ দখল। ভদ্রলোক সেদিন আছরের আজানের পর নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাচ্ছিলেন, পথে আমাকেও ডাকলেন; আমি গেলাম পেছন পেছন (হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতোই)। আছরের নামাজ শেষে তিনি সকলকে বসতে বললেন। আমিও বসলাম।
 
বললেন, আমি তোমাদের সকলকে আগামীকাল থেকে মাত্র ৭ দিনের মধ্যে পবিত্র কোরান শরীফ পড়া শেখাবো। প্রতিদিন বাদ যোহর এক ঘন্টা করে ক্লাস করাবো। সবাই উপস্থিত থাকবে।
 
আমি খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলাম। আরাবিক আলফাবেট আগে থেকেই আমার মোটামোটি মুখস্থ ছিল। প্রথম দিনই তিনি খুবই সহজবোধ্যভাবে আলফাবেটগুলি ভালভাবে (লজিক দিয়ে- অনেকটা কমপিউটারের কী-বোর্ডের টাইপিং স্টাইলে) মুখস্ত করতে বললেন। পরিষ্কার মনে আছে তিনি আমাদের আলিফ, বে, তে ছে … এসবের পরিবর্তে হামজা (আলিফ), বা, তা, ছা … এভাবে শিখিয়েছিলেন।
 
২দিন পর থেকে গ্রামার এবং বানান করা শিখিয়ে দিলেন। আমি পঞ্চম দিনেই পরিস্কার আরবী পড়া শিখে ফেললাম। খুব একটা কঠিন কোন বিষয় না।
 
কিনতু সমস্যাটা হলো, পড়তে পারলাম ঠিকই বাট কিছুই বুঝলে পারলাম না ঠিক কি পড়ছি, এসবের কি অর্থ!
 
সত্যি বলতে কি আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। পাঠ্য-পুস্তক পড়ার অবসরে নতুন করে অন্য আরেকটি ভাষা শেখার ইচ্ছেও হলো না; এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা।
 
আসল বিষয়টা হলো, আমি বাঙলা আর ইংলিশ এর বাইরে অন্য কোন ভাষায় কোন আগ্রহ পাই না। আমি প্রায় দুইশতাধিকবার ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেছি কিনতু হিন্দি ভাষায় আমার কোন আগ্রহ নেই; ইন্ডিয়াতে কেউ আমার সাথে হিন্দিতে কথা বলতে চাইলে আমি ষ্টেইট তাকে ইংলিশ বলতে বলি সবসময়, এখনও। ‘নি হাও’ আর ‘শিয়ে শিয়ে’ ছাড়া চাইনিজদের আর কিছুই জানতে ইচ্ছে করেনি কোন দিনও।
 
আমি সব সময় মনে করি এবং বিশ্বাসও করি যে বাঙলা আর ইংলিশের বাইরে আমার আর কোন ভাষা জানার কোন প্রয়োজনীয়তা বা আবশ্যিকতা নেই। কোরানের অনুবাদগুলি এখন বাঙলার চাইতে ইংলিশেই বেশী আনন্দময় হয় আমার কাছে।
 
মূল কথায় ফিরে আসি। মাওলানা দলিলুর রহমানের সাথে আস্তে আস্তে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। আমি মসজিদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। সত্যি বলতে কি যতটা না মসজিদের প্রতি আগ্রহ তারচে অনেক বেশী কৌতুহলী হয়ে পড়ি ইসলামের অনেক অনেক অজানা কথা, মাসালা, মাসায়েল, ঘটনাবলী জানার জন্য। মাওলানা দলিলুর রহমানের জ্ঞানের গভীরতায় আমি মুগ্ধ। ইসলামের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক আমি তখনই জানতে পারি।
 
প্রফেট মোহাম্মদ (সা.) কে আমি আবিষ্কার করি আরবের একজন শাসক বা রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান হিসাবে। উনার রাষ্ট্র পরিচালনা তথা প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং বিচারিক প্রজ্ঞায় আমি মুগ্ধ হয়ে পরি।
 
তখন থেকেই আমার একমাত্র আদর্শ মানুষ হিসাবে আমি মোহাম্মদ (সা.) এর বাইরে অন্য কাউকে বসাতে পারিনি। পরবর্তীতে ড. মরিস বুকাইলি, মাইকেল এইচ হার্ট সহ আরো অনেক পশ্চিমা লেখকদের বিভিন্ন লেখনী থেকে আরও অনেক কিছুই জানতে শুরু করি- আমার এই অতি প্রিয় মানুষটি সম্পর্কে। তাঁর দূরদর্শীতা, মেধা, প্রজ্ঞা সবকিছুই আমাকে অনুপ্রাণিত করে সবসময়, কাছে টানে। তাঁর ধারে-কাছে অন্য কারো কথা চিন্তাও করতে পারি না।
 
আমার অনেক জটিল কৌতহলী প্রশ্নের সহজ সমাধান দিতেন মাওলানা দলিলুর রহমান। উনার কাছ থেকে জানা তিন’টি বিষয় আজ শেয়ার করতে খুব লোভ হচ্ছে।
 
এক
মোহাম্মদ (সা.) একদিন তাঁর কয়েকজন সাহাবীদের নিয়ে আলোচনা করছেন।
 
ইসলাম প্রচারের প্রথম দিককার কথা। হঠাৎ মোহাম্মদ (সা.) বললেন, তোমরা একটু বসো, আমাকে উঠতে হবে, কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে আসছি। বলে তিনি চলে গেলেন।
 
হযরত ওমর (রা.), হযরত ওসমান (রা.) সহ আরোও অনেকেই সেখানে ছিলেন। বাট অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেলও হযরত মোহাম্মদ (সা.) ফিরছেন না দেখে সকলেই কিছুটা চিন্তিত হয়ে উঠলেন।
 
কিছুক্ষন পর হযরত ওসমান (রা.) বললেন, তোমরা সকলে বসো- আমি দেখে আসি হুজুর কোথায়। কোন বিপদও তো হতে পারে। বলে তিনি উঠে হাঁটা শুরু করলেন হযরত মোহাম্মদ (সা.) যে পথে গিয়েছিলেন সে পথ ধরে।
 
বেশ কিছুটা দূরত্ব পার হবার পর তিনি মোহাম্মদ (সা.) এর কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন এবং অনুভব করলেন তাঁর সাথে কেউ একজন কথা বলছেন। হযরত ওসমান (রা.) ওয়েট করতে থাকলেন মোহাম্মদ (সা.) এর দৃষ্টি আকর্ষণ এর জন্য।
 
ঐ ভদ্রলোক চলে গেলেন, মোহাম্মদ (সা.) ওসমান (রা.) কে ডেকে বললেন, ‘ওসমান, শোন- একটা দারুণ সুখবর আছে। এইমাত্র হযরত জীবরাঈল (আ.) এসছিলেন। তিনি আমাকে সুখবরটি দিলেন; খবরটি হলো- “যে ব্যক্তি জীবনে একবার হলেও কলেমা তাইয়েবা ‘লা-ই-লাহা ইল্লাল লাহু মোহাম্মাদুর রাসুরুল্লাহ’ পড়বে সে জান্নাতে যাবেই।”
 
হযরত ওসমান (রা.) কথাটা শুনে খুশীতে অনেকটা আহ্লাদিত হয়ে বিষয়টি সবার আগে সকলকে জানানোর উদ্দেশ্যে দৌড় দিলেন।
 
ওদিকে ওসমান (রা.) এর-ও ফিরতে দেরী দেখে হযরত ওমর (রা.) খুবই চিন্তিত হয়ে উঠলেন। অসম্ভব বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন হযরত ওপর (রা.)। তিনি সকলকে আরেকটু ওয়েট করতে বলে নিজেই মোহাম্মদ (রা.) ও ওসমান (রা.) এর খোজে হাঁটা শুরু করলেন।
 
আর এই দিকে হযরত ওসমান (রা.) খুশীর খবরটি নিয়ে ফিরে আসছিলেন এবং ওমর (রা.) কে দেখে দৌড়ে কাছে এসে হাফাতে হাফাতে এই খুশীর খবরটি শোনালেন এবং বললেন ‘যাই, সকলকে এই খুশীর খবরটি জানিয়ে আসি’। বলেই ওসমান (রা.) দৌড় দিতে উদ্দত হতেই শক্তিশালি ওমর (রা.) তাঁকে থামানোর জন্য ধাক্কা দিয়ে (অথবা চর দিয়ে) মাটিতে ফেলে দিলেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় ওসমান (রা.) বিব্রত ও বিরক্ত। তিনি উঠে দাড়িয়ে ওমর (রা.) কে অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে কৈফিয়ৎ চাইলেন- ‘আমাকে ধাক্কা দিলেন কি অপরাধে?’
 
ওদিকে ততক্ষেণে স্বয়ং হযরত মোহাম্মদ (সা.) ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত। ওসমান (রা.) অত্যন্ত রাগত এবং অভিমানের স্বরে মোহাম্মদ (সা.) কে বিষয়টি বললেন এবং এর বিচার চাইলেন।
 
কিনতু, মোহাম্মদ (সা.) কিছু বলার আগেই হযরত ওমর (রা.) মোহাম্মদ (সা.) উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হুজুর, প্লিজ বিষয়টি যেন আর কেউ না জানে’।
 
সংগে সংগে মোহাম্মদ (সা.) ওমরের পক্ষ নিলেন এবং ওসমান (রা.) কে স্বান্তনা দিয়ে বললেন বিষয়টি অন্য কারো সাথে শেয়ার না করার জন্য।
 
যাই হোক, বিষয়টি শুধুমাত্র উক্ত তিন জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
 
কিনতু, বিদায় হজ্বের সময় হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকলের উদ্দেশে একটা বাণী দিয়ে গেলেন যে, ‘তাঁর কাছ থেকে যে- যা যা শুনেছে তা যেন অন্য সকলকে জানিয়ে দিয়ে যায় নই-লে তাঁর অনেক কথাই স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে।’
 
মোহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পর হযরত ওমর (রা.) এবং ওসমান (রা.) বিষয়টি সকলকে জানিয়ে দেন।
 
দুই
আরেকদিন হযরত মোহাম্মদ (সা.), ওমর (রা.), ওসমান (রা.), আলী (রা.) সহ অনেকে বসে আলোচনা করছিলেন এবং খেজুর খাচ্ছিলেন।
 
খেজুর খাবার সময় সকলে খেজুরের খোসা ও বিচিগুলি হযরত আলী (রা.) এর সামনে এক জায়গায় জরো করছিলেন পরবর্তীতে খাওয়া শেষে সহজে যেন ফেলে দেয়া যায়।
 
যাই হোক, কথার ফাকে হযরত মোহাম্মদ (সা.) হঠাৎ মুচকী হেসে বলে বসলেন- ‘আমাদের মধ্যে কে সবচে বেশী খেজুর খাচ্ছে সে-টা কিনতু কার সামনে সবচে বেশী খেজুরের খোসা ও বিচি জমা হয়েছে সেটা দেখে অনায়াসের বলে দেয়া যায়।’
 
সকলে নির্ভেজাল কৌতুকটিতে নির্মল আনন্দ পেয়ে হেসে উঠলেন।
 
কিনতু, হযরত আলী (রা.) ও কম যা না। তিনিও হেসে দিয়ে বললেন, ‘জ্বি হুজুর আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে এটাও কিনতু পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে- কে কে খেজুরের বিচি সহ খেয়েছে আর কে কে বিচি ছাড়া খেয়েছে!’
 
এবং তিন
আমি একদিন মাওলানা দলিলুর রহমানের কাছে জানতে চাইলাম ‘শিয়া’, ‘সুন্নি’ এবং ‘মাজহাব-সমূহ’ সম্পর্কে। তিনি অত্যন্ত স্বাবলীল ভাষায় আমার সাথে বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করলেন এবং বেশ কয়েকটি বইও পড়তে দিলেন। আমি তখন প্রচুর বই পড়তাম।
 
বেশ কয়েক মাস পর, আমি একদিন মাওলানা দলিলুর রহমানকে একটা জটিল প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা- ধরুন আমি কোন মাজহাবই মানি না- শিয়া সুন্নিও বুঝি না, আমি আমার মতো করেই হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে জানতে চাই- তার ধর্ম পালন করতে চাই; তাহলে আমার কি হবে? আমি কি অমুসলিম হয়ে যাবে!’
 
মাওলানা দলিল অনেকক্ষন চুপচাপ থাকলেন। তারপর ওনি যে উত্তরটা আমাকে দিয়েছিলেন আজও আমার তা পরিষ্কার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি আজ যে কথাটা আমাকে বল্লে- এভাবে যদি কেউ কথা বলতে পারে; তাহলে অবশ্যই তার অধিকার রয়েছে নিজের মতো করে ধর্মকে আবিষ্কার করার; এতে কোন দোষ আছে- তা আমি মাওলানা দলিলুর রহমান বিশ্বাস করি না। তবে, অন্য কেউ বললে আমি অবশ্যই অন্যরকম উত্তর দিবো।’
 
ইসলাম ধর্মটা অনেক বেশী আনন্দময়, যুক্তযুক্ত, বিজ্ঞানসম্মত, রুচিকর এবং আধুনিক।
 
তারপরও আমি খুব বড় মাপের কোন আস্তিক নই।
 
তবে, আমি ‘বাংলাদেশী নাস্তিক’দের খুবই ঘৃণা করি। অবশ্য এর পেছনে যুক্তিও রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের কাজকর্ম কম; অপরের সমালোচনাতেই এরা জীবনের অনেক বেশী সময় নষ্ট করে আর বাকীটা জ্যাম-জটে আটকে থেকে। এবং সকলেই মহা-পন্ডিত ব্যক্তিত্ব; আমরা কেউ কারো চেয়ে কম যাই না। আর তারই রেজাল্ট হলো আমাদের ‘বাংলাদেশের বর্তমান হাল’।
 
আমাদের নাস্তিকরা আল্লাহ’কে মানেন না, তাকে স্বীকারও করেন না। সুতরাং তাদের কোন স্রষ্টা নেই। অর্থাৎ তারা ভাবেন তারা নিজেরাই এক এক জন স্রষ্টাসম। কারো কাছে কোন কৈফিয়ত দেবারও প্রয়োজন তারা কোনদিন অনুভব করেন না। সুতরাং তারা যা-মন-চায় তা-ই করেন বা বলেন। এতে কারো কোন ক্ষতি না লাভ হলো তাতে এদের কিছুই যায়-আসে না; তাদের কোন দায়িত্ব-বোধ নেই। আর বাংলাদেশে যেহেতু কোন সুন্দর আইন নেই বা থাকলেও প্রয়োগ নেই সেহেতু ‘সাদা জুলফি’ ব্যক্তিত্ব ঝুলিয়ে ব্যক্তিগত হীনমন্যতাগুলিও সকলের সাথে অনায়াসেই শেয়ার করা যায়। এটাই মন্দ কি! যেমন: ড. জাফর ইকবাল, হাসানুল হক ইনু, মুনতাসির মামুন, আনিসুল হক (মেয়র আনিস ভাই নন, মতিউরের আনিস) থেকে শুরু করে মুক্তচিন্তাবিদরা সহ থাবা-বাবা ইত্যাদি।
 
এসব নাস্তিকরা পশুদের চেয়ে খারাপ, কারণ পশুদের পশুত্ব রয়েছে; পশুরা পশুত্বের বাইরে কিছুই করতে পারে না- কিনতু নাস্তিকরা পশুত্বের চেয়েও নীচে নামতে পারে; তাদের কে আটকায়?
 
আর যদি, বর্তমান হাসিনা মার্কা আওয়ামী লীগের মতো সরকারের প্রসন্ন সমর্থন থাকে তাদের উপর- তাহলে তো সোনায়-সোহাগা!
   Send article as PDF