ফাষ্ট টাইম টু ইন্ডিয়া

ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানায় বেশ কয়েকটি কলেজ রয়েছে- তার মধ্যে ইছামতি কলেজ একটি।
 
ঐ কলেজের প্রিন্সিপাল’কে নিয়ে কি একটা ঝামেলা হওয়ায় তৎকালিন সভাপতি (এবং বিমান প্রতিমন্ত্রী) আব্দুল মান্নান সাহেব কলেজের সবচে ‘ফ্রেস ব্লাড’ কাউকে কালেজের দায়িত্ব দেবার জন্য মনস্থির করলেন।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবেমাত্র অনার্সসহ মাষ্টার্স সম্পন্ন করা স্বপন (পুরো নামটা ভুলে গেছি) সাহেব হয়ে গেলেন ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।
 
আর তখন নবাবগঞ্জে আমার কমপিউটার স্কুলটি মাত্র চালু করেছি।
আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে কি একটা কাজে যেন আমার অফিসে আসলেন ভদ্রলোক।
 
মাষ্টার মশাইকে আমার পছন্দ হলো- ফিটফাট, স্মার্ট ম্যান।
তিনিও যেন কিভাবে আমাকেই বেছে নিলেন।
 
তারপর যা হয়, প্রায়ই বিকেলে কলেজ থেকে সরাসরি চলে আসতেন আমার অফিসে, চুটিয়ে আড্ডা দিতাম দু’জনে। মাঝে মধ্যে আমিও চলে যেতাম প্রিন্সিপাল সাহেবের রুমে।
 
ভালই চলছিল।
 
একদিন হঠাৎ আলাপ করলাম, ইন্ডিয়া যাবো এবং নেপাল যাবো।
 
দু’জন মিলে অনেক গল্প করলাম প্রস্তাবিত সফর নিয়ে।
আমার তখনও পাসপোর্ট হয়নি, পাসপোর্ট করতে দিলাম।
 
স্বপন ভাইয়ের পাসপোর্ট করা ছিল।
রমজান মাস চলে আসলো।
হঠাৎ স্বপন ভাইয়ের কোন খবর নেই।
 
তখন তো আর মোবাইল সেভাবে বাজারে আসেনি- তাছাড়া আমাদের ওদিকটায় নেটওয়ার্কও আসেনি।
 
রমজানের শেষের দিকে পাসপোর্ট হাতে পেলাম।
স্বপন ভাইয়ের জন্য অধৈর্য্য হয়ে অপেক্ষায় রয়েছে।
 
তিনি আসলেন ঈদের পরপর।
জানালেন ইন্ডিয়া ঘুরে আসলেন। প্রায় মাস খানেক বেড়িয়ে আসলেন।
 
আরও জানালেন, দার্জিলিং এর মদ খুব সস্তা। গ্যাংটকে সংগু লেকটি দেখতে দারুন, শীতে পানি সম্পূর্ণ বরফ হয়ে থাকে এবং তার উপর দিয়ে হাটা-চলা করা যায়, মনে হয় গ্লাসের উপর দিয়ে হাঁটছি; ওখানকার মেয়েরাও খুব ভালো। আগ্রায় খুব সস্তায় জুতা পাওয়া যায়, আমাকে দেখালেন তার পায়ের জুতা।
 
আমি জানতে চাইলাম, কাঠমানডু যান নাই?
হ্যাঁ, গিয়েছি তো। খুব সুন্দর শহর, পরিচ্ছন্ন, রাজকীয় ইত্যাদি। কিন্তু তার গলায় জোর কম।
 
স্বপন ভাই আইডয়া নিয়ে- আমাকে না জানিয়ে বিশ্ব জয় করে ফিরলেন! আর আমি ঘরে বসে রয়েছি!
 
শীগ্রই আমাকে যেতে হবে।
 
পরদিনই ঢাকার ধানমন্ডির ২ নাম্বার সড়কে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে গেলাম খবর নিতে; জানলাম খুব সকালে এসে লাইনে দাড়াতে হবে। ডলার এনডোর্স করতে হবে, ইত্যাদি।
 
তখন আমি ডলার এনডোর্সও বুঝি না, কিভাবে করে কে জানে?
কয়েকজন দালাল পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। বলল, ১২০টাকা যদি দিই তাহলে কাল সন্ধ্যায় সবকাজ কম্পিলট করে ভিসা সহ পাসপোর্ট দিয়ে দেবে, আমার কোন ঝামেলা নেই, শুধু ছবি লাগবে।
 
সব তো রেডীই ছিল।
টাকা চাইলো না, বলল ভিসাসহ পাসপোর্ট হাতে পেয়ে টাকা দিতে; মনে হলো ভালো দালাল। দিয়ে দিলোম আমার অনেক সাধের পাসপোর্ট।
 
পরদিন বিকেলে যথাসময়ে আসলাম আবার ইন্ডিয়ান হাই কমিশন এর ভিসা অফিসের সামনে। কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখলাম দালাল আমাকে খুঁজছে। কাছে এসে বলল টাকা দেন, পাসপোর্ট রেডী।
 
স্বপ্নের ইন্ডিয়ান ভিসার সিলটি লাগানো দেখলাম।
মনটা ভরে গেল। ১০০ ডলার এনডোর্স করা দেখলাম- ঢাকা ব্যাংকের সিল।
 
জীবনে প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ, কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
 
আমার কমপিউটার স্কুলে তখন আমার এক ক্লাসমেট বনশ্রী পাল কমপিউটার শিখতো। তার বড়বোন তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাষ্টার্স কমপ্লিট করে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইডি গবেষনারত। তার একটা থিসিস পেপারে প্রিন্টিং এর একটা কি টেকনিকেল প্রব্লেম ছিল, আমি একটু দক্ষতার সাথে সমাধান করে দেয়াতে আমি ওদের বাসায় খুব প্রিয়মানুষ ছিলাম। ওর বাবা হিরালাল পাল শিক্ষক মানুষ তিনিও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বনশ্রীর দুই ভাই তখন কোলকাতায় পড়াশোনারত।
 
একদিন বনশ্রী আমার হাতে একটি চিঠি গুজে দিলো, আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম- এটা আবার কিসের চিঠি? জীবনে মেয়েদের কাছ থেকে প্রেমের চিঠিতো কম পাইনি, নতুন কোন ঝামেলা না তো!
 
চিঠিটা খুললাম, না বনশ্রীর বাবা চিঠিটি লিখেছেন আমাকে।
 
পুরো চিঠিটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে পেললাম।
গুটিগুটি হাতের লেখায় ভদ্রলোক আমাকে কোলকাতা পর্যন্ত যাবার ব্যাপারে বাস্তব দিক নির্দেশনা দিয়ে একটি চিঠি লিখেছেন।
 
আমি খুবই অবাক এবং প্রচন্ড খুশী হয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকে সেই চিঠিটি পেয়ে- যা আমার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।
 
বেনাপোল এবং হরিদাশপুর স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশন ও কাষ্টম্স কর্মকর্তারা হলো এই পৃথিবীর সবচে বাজে এবং অসভ্য প্রাণী। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি লোক নিয়োগ করে প্রতিদিন দু্ই বেলা করে ওদের চাপড়াতাম।
 
কড়া সিষ্টেমের কারণে বর্তমানে ভারতীয় পাড়ের কর্মকর্তারা বর্তমানে একটু-টুকু সভ্যতা শিখেছে; তবে বাংলাদেশীরা সভ্য হবে- এটা কি সম্ভব?
 
যা-ই হোক ওদের ঘুষ দেয়া ছাড়া যাওয়া আসা করা যাবে না।
 
আমি ঘুষ না দেয়া মানুষ, তাছাড়া তখন বয়সও অনেক কম- রক্ত, যুক্তি দুটোই আমার শক্ত; আমি ঘুষ দেইনি। ফেরার সময় বিডিআর এর একজন বয়স্ক অফিসার আমাকে দাড়িয়ে স্যালুট দিয়েছিলেন পুরো বিষয়টা দেখে, পরিস্কার বলেছিলেন- আপনার মতো লোকদের দেখলে আমি স্যালুট দিই, যদিও আপনি আমার ছেলের বয়সী এবং আমি একজন অফিসার।
 
দাদাদের দেশে গেলাম।
তখন ডাইরেক্ট কোন বাস সার্ভিস ছিল না।
 
হিরালাল পাল সারের নির্দেশনা অনুযায়ী হরিদাশপুর থেকে বনগাঁ অবধি একটি রিক্সা নিলাম ১০ রুপিতে, রাস্তায় স্যারের নির্দেশনানুযায়ী ২রুপি চাঁদাও দিলাম তারপর ১৬রুপিতে বনগাঁ রেল ষ্টেশন থেকে টিকেট নিয়ে তিন ঘন্টায় পৌছে গেলাম স্বপ্নের শিয়ালদহ ষ্টেশনে।
 
ওখান থেকে ট্যাক্সি ক্যাবে করে চলে গেলাম জাকারিয়া ষ্ট্রিটে।
৬ থেকে ৮ টাকায় গরুর মাংস দিকে পেট ভরে ভাত খাওয়া যেত তখন।
 
একদিন গেলাম নিউ মার্কেট, ওখানে একটা খুব দামী রেষ্টুরেন্টে খেলাম আমরা তিনজন দুপুরের খাবার। ৭৫ রুপি বিল হলো, ৫ রুপি বকশিশ পেয়ে ওয়েটার পারলে আমার পা ধরে সালাম করে!
 
বাংলাদেশের কোন সিনেমা হলে যেয়ে আমি সিনেমা দেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম ১৯৯৩ সালে আর ইন্ডিয়া এলাম ১৯৯৬ সালে। দেখলাম নিউ মার্কেটের কাছে একটা সিনেমা হলে ইংলিশ ‘দ্যা মাস্ক’ ছবিটি চলছে।
 
আগ্রহ হলো, দেখলাম- হলের পরিবেশ দেখে চমকে উঠলাম- এরা এতো সভ্য। প্রচুর বিদেশী নারী-পুরুষও সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখছে।
 
কোলকাতা আসার পরপরই খেয়াল করলাম প্রচুর সাদা চামড়ার টুরিষ্ট এখানে; আর সাদা চামড়ার প্রতি দুর্বলতা আমার আরো অাগে থেকেই। খুব ভালো লাগছিল কোলকাতা শহর।
 
হিরালাল স্যার আমাকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, ‘কোলকাতা তথা ভারতবর্ষের কোথায় বাংলায় কথা বলবে না। কোলকাতায় বাংলা চললেও তুমি বলবে ইংলিশে। এতে ওরা বুঝবে না তুমি কোন দেশের বা কোন রাজ্যের, তোমাকে বিদেশী ভেবে সম্মান করবে। আর বাংলা বললে তোমাকে চিনে ফেলবে এবং বাংলাদেশীদের সাথে ওরা অসুন্দর আচরণ করে; কাজেই তুমি সাবধান থাকবে। আর পুলিশ ধরলে কোন বাংলা যেন তোমার মুখ থেকে না বের হয়। ওরা ইংলিশ শুনলে তোমাকে ঘাটাবে না।
 
চমৎকার কাজে দিয়েছিল স্যারের ফ্রি পরামর্শগুলি আমার জীবনে।
ইংলিশের উপর এতটা আস্থাও আমার তখন থেকেই শুরু।
 
সন্ধ্যার পর একদিন খিদিরপুর ফেন্সি মার্কেট থেকে ফিরছি জাকারিয়া ষ্ট্রিটে, হঠাৎ পুলিশ গাড়ী থামালো, এবং প্রশ্ন করলো কোথায় যাচ্ছি।
 
আমি ইংলিশে চটপট বলে দিলাম ‘জাকারিয়া ষ্ট্রিট ফ্রম খিদিরপুর’। পুলিশ গাড়ী ছেলে দিল।
 
আমার সাথে গিয়েছিলেন আমার এক বন্ধু কাম মামা আহসানউল্লাহ খান। পরদিনই ওনার তার ছোট মেয়ের জন্য কান্না শুরু হয়ে গেল; সে নাকি মেয়েকে না দেখে থাকতেই পারছে না।
 
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বাংলাদেশে তার নিজ বাড়ীতে একটা চিঠি পাঠাবেন কোলকাতা থেকে। এনভেলাপ কেনা হলো, টিকেটও কেনা হলো। মামা নিজেকে নিজেই চিঠি লিখলেন এবং খামের মুখ বন্ধ করার জন্য তার চাই ‘ঘাম’।
 
কয়েকটা টং দোকানে খোঁজ করেও কোন ঘাম পাওয়া গেল না। শেষে এক টং দোকাদার তাকে ১রুপি দিতে বলল। মামা দিলেন ১রুপি। দোকানদার একটা ছোট কৌটা ধরিয়ে দিল।
 
মামা তাড়াতাড়ি কৌটা খুলে ঘাম বের করে এনভেলাপে লাগালেন, কিন্তু আঠা তো কাজ করছে না। আমি হাতে নিয়ে দেখলাম সেটা ঘাম না, নারিকেল তেল।
 
মামা, পুরোপুরি হতাশ।
বললেন, ভাগিনা তুমিই ঠিক করো। এই শালাদের সাথে ইংরেজীতে কথা বলাই বুদ্ধিমানের কাজ। পরে মামাকে নিয়ে গেলাম খিদিরপুর পোস্ট অফিসে, সেখান থেকে ঘামের ব্যবস্থা করে তারপর মামা চিঠিটি নিজের কাছে পোষ্ট করেছিলেন।
 
কোলকাতার চিড়িয়াখানা দেখলাম, সাপের একোরিয়ামস দেখলাম।
বিড়লা প্লানেটারিয়াম এ তারাও দেখলাম- সে এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। তাজমহল খ্যাত কোলকাতার বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া মেমেরিয়ালে ঘুরলাম।
 
কোলকাতার মেট্রো রেলে এর সাবওয়েতে গেলাম এমাথা থেকে ওমাথা।
 
অদ্ভৎ এক আনন্দ।
জীবনে প্রথমবার মাটির নীচ দিয়ে টেন! মজা তো হবেই।
 
কোলকাতার ব্ল্যাংকিং ষ্টিটে সস্তায় জুতা পাওয়া যায়।
আহসান মামা সস্তায় জুতা কিনবেন। কয়েকটা দোকান দেখলাম, পছন্দ হচ্ছে না। প্রায় সবগুলি দোকানদারই চায়নিজ।
 
কোলকাতায় জুতার ব্যবসায় নেতৃত্ব তখনও ‘চায়নিজ ইন্ডিয়ান’দের হাতেই। একটা দোকানে এক জোড়া জুতা পছন্দ করলেন মামা।
 
কিন্তু চাইনিজ দোকানদার মামাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
সে ব্যস্ত অন্য কাষ্টমার নিয়ে।
 
মামা এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কানাচোদা, কথাই তো শুনে না!’
 
চাইনিজ দোকানদার মুহূর্তে মামার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ইউ কানাচোদা’।
 
আমরা তো দৌড়!
   Send article as PDF